জমিনে রক্ত, বাতাসে বারুদের গন্ধ: তীর্থযাত্রীদের মোক্ষ লাভ হবেতো!

 আমার দেশ
৮ ডিসেম্বর ২০২২

মো. শাহ আলম

মো. শাহ আলম

মো. শাহ আলম

বিস্ফোরণের জন্য দরকার ইগনিটর, ডেটোনেটর, স্ট্রাইকার। এগুলোর কোনটা নাহলে স্তূপীকৃত বারুদ থাকলেও বিস্ফোরণ ঘটে না। ইগিনিটর, ডেটোনেটর, স্ট্রাইকার এগুলো যথাযথভাবে থাকলেও বিস্ফোরণ আবার সাপেক্ষ ব্যাপার, নির্ভর করে বারুদ বিস্ফোরণ-যোগ্য অবস্থায় আছে কি না। ভেজা বা আর্দ্র বারুদে ইগনিটর, স্ট্রাইকারের ক্রিয়া নিষ্ফলা। বারুদ বিস্ফোরণ-যোগ্য অবস্থায় থাকলে যেকোন ভাবে একটি স্ফুলিঙ্গ দরকার মাত্র। ঠিক অবস্থা, ঠিক সময়, ঠিক ক্রিয়া তিনের সন্নিপাত না হলে কোন ক্রিয়া থেকে কোন কিছু উৎপাদন হয় না। বিস্ফোরণের ব্যাপারটিও তাই।

তীর্থযাত্রীর মোক্ষলাভের সাথে বারুদ ও বিস্ফোরণের সম্পর্ক কি, এমন জিজ্ঞাসা পাঠকের মনে আসতেই পারে। সম্পর্ক আছে, বলছি। পলিটিক্সের শাস্ত্রে “গণ-বিস্ফোরণ” বলে কোন পরিভাষা না থাকলেও বাংলাদেশে শব্দটি চালু আছে। এটা “সৃজনশীলতা” বটে। অন্যদিকে বন্ধ্যা হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিকরা এদিকে বেশ উৎপাদী। নানান কিসিমের খেতাব, তোষণ, ভজন, স্তুতি বন্দনার উদ্ভাবন ও ব্যবহারেও তারা, দুষ্কর্ম, দুর্নীতি ও দৌরাত্ম্যের মত সমান সিদ্ধহস্ত।

দুর্দম্য গণ-উত্থান (mass upsurge) বোঝানোর জন্য তারা শব্দটি মূদ্রণ করেন, যদ্দূর মনে করতে পারি শব্দটি শুনেছি বিএনপি নেতাদের মুখে। বেগম খালেদা জিয়াকে বিশেষ আদালতের বিচারক আক্তারুজ্জামান ২০১৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি জিয়া অর্পেনেজ ট্রাষ্ট অর্থ আত্মসাৎ মামলায় কারাদণ্ড দিয়েছিলেন, পল্টনের কার্যালয়ে আরাম কেদারায় বসে দলের নেতারা সেদিন গণবিস্ফোরণের উত্তাপ অনুমান করেছিলেন বলে জানা গিয়েছিলো, যদিও ঢাকা শহরের কিংবা বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ করুণ, অসহায়, বিষণ্ণ শীতলতায় এক প্রকার অবশ অনুভূতি যাপন করেছিলেন। সেদিন কোন ডাক, আহ্বান, নেতৃত্ব ও নির্দেশনা দেখেনি সে বিপন্ন, বিষণ্ণ, দুঃখভারাক্রন্ত মানুষ। বরং দণ্ড ঘোষণার পরে মানুষ সাক্ষী হয়েছিলো মহাসমারোহে সতী বিসর্জনের এক বীরভঙ্গির শোভাযাত্রার, যে শোভাযাত্রা দিয়ে নাজিমউদ্দীন রোডের নির্জন কারা বেষ্টনীর ভেতরে খালেদা জিয়ার বিসর্জন কাণ্ড সম্পন্ন হয়েছিলো।

অধুনা ঘুমন্ত (অনানুষ্ঠানিক বিলুপ্ত) ২২ দলীয় জোট নেতাদের কারো জবানীতে সেদিনের বিবরণ যা শুনেছিলাম – ভোরবেলা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একান্ত সচিব জোটের শরীক নেতাদের ফোন করে বলেছিলেন মহাসচিবের অভিপ্রায় আপনারা আজ বিএনপির পল্টনের কার্যালয়ে সকাল থেকে যেন উপস্থিত থাকেন। তবে মহাসচিব নিজে শরীক দলের কোন নেতার সাথে কথা বলেননি কিংবা অনুরোধ করেননি। মির্জা ফখরুল নিজে কথা বলেননি শরীক দলের নেতাদের সাথে। জোটের সবচাইতে বড় দল, যারা বাংলাদেশের সরকারে ছিলেন বার কয়েক, বর্তমানে সরকারে না থাকলেও অপেক্ষমাণ বা ছায়া সরকার, সে কারণে বড় দলের বৃহৎ নেতা হিসেবে মির্জা সাহেবের আত্মশ্লাঘা হয়তো তাঁকে বাধা দিয়ে থাকবে তুলনামূলক নিরতিশয় ক্ষুদ্র দলের নেতাদের সাথে স্বয়ং কথা বলে অনুরোধ জানাতে। তা না হলে এমন এক সঙ্গিন পরিস্থিতিতে কিসে তাঁকে নিবৃত্ত করতে পারে শরিক দলের নেতাদের সাথে নিজে কথা বলে পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাৎক্ষণিক শলাপরামর্শের মাধ্যমে করণীয় বিষয়ে একটা সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেবার মত অবস্থা তৈরি করতে!

বাংলাদেশের বাস্তবতায় এমন মনোবৃত্তি বা আচরণ তেমন ধর্তব্য বা বিবেচনাযোগ্য নয় হয়তো, কিন্তু এ মনোবৃত্তি বা আচরণ দ্বারা ‘রাজনীতি’র চরিত্র, গণতন্ত্রের হাল, নাগরিক-বোধ অনেক কিছু বিচার করা যায়, উপলব্ধি করা যায় অবশ্যই। পলিটিক্স শ্লাঘার বিষয় নয়। পলিটিক্স সংযোগ ও সম্পর্কের বিষয়। এই অবজ্ঞা জোটের অনেক নেতাকেই নিরুৎসাহিত করে থাকবে সেদিন পল্টনে আসতে। দুটি বা তিনটি দলের দু’তিনজন নেতা এসেছিলেন মাত্র। তাঁরাও পল্টনের কার্যালয়ে ঘন্টা দুয়েক থেকে বিএনপি নেতাদের বিশ্রম্ভালাপ ছাড়া আর কিছু না দেখে নিজদের অপ্রয়োজনীয় উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ফলে নিজ নিজ ঘরে ফিরে যান।

বিগত এক যুগে বহুবার বিএনপির জন্য ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণ হাজির হয়েছিল জনতার দাবানল সৃষ্টি করার জন্য। নেতৃত্বের সঙ্কল্প ও দ্বিধাহীনতার অভাবে প্রতিটি মাহেন্দ্রক্ষণ নিরবে হারিয়ে গেছে ইতিহাসের বিস্মৃতির গর্ভে। প্রতিবারেই শেখ হাসিনা নতুন করে শক্তি ও সঞ্জীবনী লাভ করেছেন, দমন পীড়ন জোরদার করেছেন।

শেখ হাসিনা এবং তার পারিষদবর্গ তিনটি ধারণা বাংলাদেশে – বাংলাদেশের মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছেন। এ তিনটি জিনিস: “রাজনীতি” হলো চটপটে মিথ্যা ও বানোয়াট কথা বলা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং মারপিট ও খুনখারাবি। ফিল হাল আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহমদ বললেন “রাজনীতিতে মারপিট আছে” এবং দলের লোকদের উপদেশ দিলেন, “খেলা হবে” কথাটি যেন তারা ইস্তেমাল না করেন। তোফায়েল আহমদ গয়রহ সেই ষাটের দশক থেকে রাজনীতিতে মারপিট ও খুনখারাবির অনুশীলন করে আসছেন, কালের নথিতে সে সব রক্ষিত আছে।

আরেকটা ধারণা, আন্দোলন হলো ভাঙচুর, খুন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা ও দমন পীড়ন উপেক্ষা করে আইন শৃঙ্খলা উল্টে দিতে পারা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর প্রাবল্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হওয়া। এ অর্থে বিএনপি কখনো আওয়ামী লীগের সংজ্ঞার আন্দোলন করতে সক্ষম হয়নি এবং সে সক্ষমতা আদৌ রাখে কি না সে সত্যের মুহূর্ত এখন বিএনপির সামনে হাজির।

তিনটি ধারণার কথা বলেছিলাম। আরেকটি ধারণা হল, এটাও শেখ হাসিনার অবদান। তা হলো সরকারী দফতরের চেয়ার যে কোন ধরনের আইনি ও নৈতিক সীমা পরিসীমা থেকে মুক্ত অপরিমেয় “ক্ষমতা” চর্চার উৎস। যার জন্য কোন প্রকার নিয়ম নীতি ও জবাবদিহিতা নাই। প্রধানমন্ত্রী সর্বময় কর্তৃত্ব ও কুওয়তের ধারক ও বিচার আচার আইন আদালত সবকিছুর নিয়ন্ত্রক প্রধানমন্ত্রী।

বিএনপি কিংবা দেশের অন্য কোন রাজনৈতিক দল কখনো এ সকল ধারনা ও শেখ হাসিনার মুখের ভাষার সমালোচনা করেনি, কিংবা করার প্রয়োজন মনে করেনি। ফলে জনমনে, গত একযুগে বেড়ে ওঠা তরুণ নাগরিকদের মনে সরকার ও রাজনীতির এই ধারনা প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। পরিহাস এই যে, সরকারী দফতেরর নীতিনির্ধারক পলিটিক্যাল দায়িত্ব পাবলিক সার্ভিস এবং পদাধিকারীরা যে পাবলিক সার্ভেন্ট এটা পলিটিশিয়ানদের ধারনা, কল্পনা ও উপলব্ধির বাইরে। ফলত তাদের মুখেও বরাবরই “ক্ষমতা” শব্দটিই উচ্চারিত হয়। এ বিষয়ে বারান্তরে আরও আলাপ তোলার এরাদা রেখে আজকের মূল প্রসঙ্গে আসা যাক।

গত দেড় মাসে বিএনপি দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাতটা জনসমাবেশ করেছিলো। বিএনপির তরফ থেকে শান্তিপূর্ণ রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও বিভিন্ন জায়গায় এসব সমাবেশ উপলক্ষে পুলিশের গুলিতে দলের ৭ জন কর্মীকে পুলিশ হত্যা করেছে। গেলো এক সপ্তায় ৭ হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। একের পর লাশ গুণেও মানুষ সরকারী তরফের নানান বাধা অবরোধ অগ্রাহ্য করে হামলা, মামলা ও মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে সাধারণ মানুষ যোগ দিয়েছে, এবং দিচ্ছে। খাদ্য খাবারের পুঁটলি ও কাঁথা কম্বল নিয়ে মানুষ এসেছে পায়ে হেঁটে, ভেলায় চড়ে, নৌকায় চড়ে। দলে দলে এসেছে যেন তীর্থযাত্রী দল মহা মোক্ষ লাভের আশায়। মোক্ষ – মুক্তি।

ঢাকার বাইরের সমাবেশগুলো যেমন শান্তিপূর্ণ ছিলো, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বারবার বলে আসছিলেন ঢাকার পল্টনের সমাবেশটাও শান্তিপূর্ণ হবে। ঢাকায় লোকের আগমন শুরু হয়েছিলো এক তারিখ থেকেই বা তারও আগে থেকেই। ধীরে ধীরে দিনে দিনে পল্টনে লোকের সমাগম বৃদ্ধি-পাচ্ছিলো। তবে ১০ ডিসেম্বরের তিনদিন আগেই, এই নিবন্ধ যখন লিখছি, খবর পাওয়া গেলো ঢাকার পল্টনে আজ দু’জনের মৃত্যু হয়েছে পুলিশের গুলিতে। পুলিশ তাণ্ডব চালিয়েছে পল্টনের কার্যালয়ে, গ্রেফতার করেছে কয়েক শ।

এই তিন দিনে কি ঘটবে! তীর্থযাত্রী জনতার স্রোত ঢাকা মুখী থাকবে না কি বাতাসে বারুদের গন্ধ পেয়ে ফিরে যাবে! পল্টনে কি তারা আসবে! আসতে পারবে! স্ট্রাইকার বা সেই ইগনিটর আছে? বিস্ফোরণ ঘটবে! তীর্থযাত্রীদের মোক্ষ লাভ হবে!

লন্ডন, মঙ্গলবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২২

লেখক: শিক্ষাবিদ, চিন্তক ও সিটিজেন এক্টিভিস্ট।