- গোলাম মাওলা রনি
- ০১ জুলাই ২০২১
জনপ্রতিনিধি এবং আমলাদের দ্বন্দ্ব এ দেশে যে সময়ে শুরু হয়েছিল তখন অবশ্য বাংলা ভাষায় রাতের ভোট, ভোটচোর, ভোট ডাকাত, বিনাভোটের এমপি কিংবা অটোপাসের এমপি ইত্যাদি জঘন্য শব্দমালা সংযুক্ত হয়নি। তখনকার দিনে কোনো স্বল্পশিক্ষিত ব্যক্তিত্বহীন অথবা অযোগ্য প্রকৃতির জনপ্রতিনিধি যদি আমলাদের সামনে যেতেন তবে খুব কৌশলে তাদের তাচ্ছিল্য করা হতো। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই জনপ্রতিনিধিদের অপমান করা হতো না। কারণ প্রশিক্ষিত আমলাতন্ত্র জনপ্রতিনিধিদের মর্যাদা সম্পর্কে জানতেন- কিন্তু যখন দেখতেন মর্যাদার সঙ্গে যোগ্যতার মিল নেই তখন ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ভক্তি প্রদর্শন করতে পারতেন না। কিন্তু যারা সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত সজ্জন এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন তারা আমলাদের কাছ থেকে এতটা সৌজন্য পেতেন যা তিনি অন্য কারো কাছে পাওয়া তো দূরের কথা আশাও করতেন না।
স্বাধীন বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধিরা প্রথম ব্যাপক হারে আমলাতন্ত্র দ্বারা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হতে থাকেন এরশাদ জমানায়। ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির টিকিটে এমন কিছু অদ্ভুত মুখচ্ছবিযুক্ত নারী-পুরুষ এমপি-মন্ত্রী-উপজেলা চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে অভিষিক্ত হন যাদের দেখে সুশিক্ষিত আমলারা তো বটেই সাধারণ জনগণও নানা রকম কানাঘুষা আরম্ভ করে দেন। ভোট জালিয়াতি, ব্যালটে এক রকম এবং রেজাল্ট শিটে অন্য রকম অথবা সার্কিট হাউজগুলোতে বসে তৎকালীন গোয়েন্দা কর্তাদের তালিকা অনুযায়ী প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করার পর মনুষ্য সমাজে যে প্রতিক্রিয়া হতো তার কারণে তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ অসম্ভব ছিল না। শুধু কি তাইÑ ওই আমলাদের ওইসব লোকজন যারা জীবিত রয়েছেন তারা লজ্জায় নিজেদের আড়াল করে রাখেন এবং যারা মারা গেছেন তাদের আওলাদ-আওতাদরা ভুলেও নিজেদের পরলোকগত আত্মীয়ের তথাকথিত জনপ্রতিনিধির তকমাটি উচ্চারণ করতে সাহস পান না।
জাতীয় পার্টির মতো আওয়ামী লীগের বাকশালী চরিত্র এবং বাকশালী সরকারের অধীন যারা বাকশালী কায়দায় দলীয় পদ পেয়েছিল এবং জনপ্রতিনিধির তকমা হাসিল করেছিল তাদের আওলাদ-আওতাদরা সেই থেকে আজ অবধি সব কথা বললেও বাকশালী চরিত্র এবং পদ-পদবি সম্পর্কে কিছুই বলেন না। পাকিস্তান জমানার আইয়ুব শাহীর প্রভাবশালী বিডি মেম্বররা অথবা মুক্তিযুদ্ধকালীন সীমাহীন প্রভাবশালী রাজাকার-আলবদর-আলশামস সদস্যদের আওলাদরা তাদের পূর্বসূরিদের রাজনৈতিক পদ-পদবির কথা যে কিভাবে চেপে যান তা আমরা সবাই জানি।
আমরা যদি বিএনপি আয়োজিত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন পর্যালোচনা করি তবে দেখব, সেই নির্বাচনে ৩০০ এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন, পরবর্তীতে ৩০ জন মহিলা এমপিও হয়েছিলেন যাদের নিয়ে ষষ্ঠ সংসদ বসেছিল এবং সেই সংসদে যে আইন পাস হয়েছিল সেই আইনের ওপর ভিত্তি করেই একই বছর ১২ জুন সপ্তম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তো এখন যদি সেই ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে যারা এমপি হয়েছিলেন তারা কোনো আমলা তো দূরের কথাÑ কোনো পাগল-ছাগলের কাছে গিয়ে বড়াই করে বলেন- আমরা সাবেক জনপ্রতিনিধি! আমাদের সম্মান করো, পাত্তা দাও, মান্য করো। তবে সেখানে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে যাবে। অর্থাৎ পাগলরা হাসতে হাসতে মরে যাবে এবং ছাগলরাও ম্যাঁ ম্যাঁ করতে করতে কাউয়া-মুরগি ও বকে পরিণত হবে!
আপনি যদি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এবং ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন ও ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের তুলনা করতে চান এবং বিএনপির সেই কলঙ্ক বড় নাকি বর্তমান জমানার কলঙ্ক বড় তাহলে সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞাসা করা লাগবে না। আপনি প্রথমে পাবনার পাগলা গারদে আটক বদ্ধ উন্মাদ-উন্মাদিনীদের মতামত গ্রহণ করুন। তারপর হাইকোর্ট মাজার, মীরপুরের শাহ আলীর মাজার প্রভৃতি এলাকায় যেসব অর্ধউলঙ্গ অথবা পরিপূর্ণ জন্মদিনের পোশাক পরিহিত জটাধারী রয়েছে তাদের বক্তব্য রেকর্ড করুন। সব শেষে নিউ মার্কেটের মুরগি পট্টিতে যান। ওখানে সাত সকালে যারা মুরগির বর্জ্য পরিষ্কার করেন তাদের মন্তব্যগুলো লিখে নিন। এরপর আপনি কোনো বুদ্ধিজীবী, রাজনীতি বিশ্লেষক বা বিশেষজ্ঞের কাছে উল্লেখিত মতামতগুলোর বিষয়ে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করুন। দেখবেন- লোকটি বোবা-বধির, অন্ধ এবং অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছেন।
আজকের নিবন্ধের শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনার সুবিধার জন্য উল্লেখিত ভূমিকা টানতে হলো। এবার মূল প্রসঙ্গে যাচ্ছি। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কিছু মহল থেকে গাল ফুলিয়ে প্রচণ্ড অভিমানের স্বরে এবং কণ্ঠে বিষণ্নতার বিউগল বাজিয়ে এ কথা বলার চেষ্টা হচ্ছে যে, আমলারা জনপ্রতিনিধিদেরকে পাত্তা দিচ্ছেন না অথবা জনপ্রতিনিধিরা প্রজাতন্ত্রে কর্মরত আমলাদের কাছ থেকে সামান্যতম সম্মান তো পাচ্ছেনই না বরং উল্টো এমন সব তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং অবমাননাকর ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছেন, যা ভাষায় প্রকাশ করা দুরূহ। অভিযোগকারীদের মতে এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের রাজনৈতির সঙ্কট দেখা দেবে। কোনো ভদ্রলোক রাজনীতিতে আসবেন না এবং দেশ পরিচালনায় রাজনীতিবিদের কোনো ভূমিকা থাকবে না।
আপনি যদি উপরিউক্ত অভিযোগ সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে চান তবে অবশ্যই আপনাকে কতগুলো প্রশ্ন করতে হবে। আর সেগুলো হলো : দেশে এখন কিসের রাজনীতি এবং কার রাজনীতি চলছে? এই দেশে আপনি কাদের রাজনীতিবিদ বলবেন এবং কেন বলবেন? সর্বশেষ প্রশ্ন হলো, রাজনীতির হালআমলের রীতিনীতি এবং চলমান রাজনীতির বাই প্রোডাক্ট পোশাকধারী রাজনীতিবিদদের কেন আমলারা অথবা জনগণ পাত্তা দেবে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আপনাকে লন্ডন-আমেরিকা যাওয়ার দরকার নেই। পদ্মা সেতুর জাজিরা পয়েন্ট, নির্বাচন কমিশন অফিস এবং সচিবালয়ের গেটের সামনে ঘণ্টাখানেক ঘুরলেই সব প্রশ্নের ফকফকা উত্তর পেয়ে যাবেন এবং তখনই আপনি বুঝে যাবেন যে, চলমান সময়ে জনপ্রতিনিধিদের ওপর আমলাদের প্রাধান্য কেন অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
আপনি যদি আজকের নিবন্ধের উপরিউক্ত অংশটুকু পড়ার পর আমার প্রতি বিরক্ত বোধ করেন এবং বলে ফেলেন, আরে মিয়া, এই দুর্দিনে পকেটের পয়সা খরচ করে নয়া দিগন্ত পত্রিকা কিনলাম। চটকদার শিরোনাম দেখে আপনার লিখিত উপসম্পাদকীয় পড়তে আরম্ভ করলাম। কিন্তু আপনি নিজে কিছু না বলে সবকিছু আকার ইঙ্গিতে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার চেষ্টা করছেন। দেশে কঠোর লকডাউন চলছে, অনেকের ঘরে চাল নেই, ডাল নেই, পকেটে পয়সা নেই। তার ওপর রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের টহল। গাড়ি ঘোড়া সব বন্ধ। বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ জনপ্রতিনিধিরা কেন অপমানিত হচ্ছেন সেই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আপনি একবার পাবনায় পাগলা গারদে যেতে বলছেন আবার হাইকোর্ট মাজার, মিরপুর মাজারের জটাধারী ভণ্ড পাগল-পাগলীদের কাছে যেতে বলছেন! এটা কোনো কথা হলো! আপনার কথাবার্তা শুনে তো মনে হচ্ছে, আপনাকেই পাবনা পাঠানো উচিত!
আপনারা যারা উপরিউক্ত কথার পাশাপাশি চরম বিরক্ত হয়ে আমাকে ভোটচোর বা ভোট ডাকাতের বাচ্চা বলে গালি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং এ কথাও বলার চেষ্টা করছেন যে, দাঁড়াও চান্দু! তোমারে বগলের মধ্যে পেয়ে নেই, এমন চাপ দিমু! তখন বুঝবা মাইনকার চিপা কারে বলে! ব্যাটা ফাজিল! যে লোক ভোট দিতে পারে নাই তার নিকট জনপ্রতিনিধির সম্মান বয়ান করতে এসেছিস। যে অগণিত মানুষ ভোট দিতে গিয়ে পোষা কুকুরদের কামড় খেয়েছে, জেলে গিয়েছে, ভোট দেয়া তো দূরের কথা ভোটকেন্দ্রের ধারে কাছে যেতে পারেনি অথচ এখন আবার তাদের নিয়ে মায়াকান্না করছ। আপনারা যারা এমন কথা বলার চেষ্টা করবেন তাদের আমি কাগজের বাঘ, তাসের ঘর এবং ব্যাটারিচালিত রিমোট কন্ট্রোল পুতুলের কাহিনী বলে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করব। পৃথিবীর কোনো সমাজেই কাগজের বাঘকে কেউ ভয় পায় না, নেহায়েত শিশুতোষ আনন্দের জন্য কাগজের বাঘ তৈরি করা হয়। আবার মাঝে মধ্যে কোনো কোনো শিল্পী বাহারি রংচং লাগিয়ে বিভিন্ন আকৃতির কাগজের বাঘ বানিয়ে দর্শকদের আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করেন। কাগজের বাঘে প্রাণের সঞ্চার করা অসম্ভব। এই বাঘকে কেউ সমীহ করে না। বরং ছেলে বুড়ো-গুড়ো সুযোগ পেলেই কাগজের বাঘের কানগুলো মলে দেয়, লেজ ধরে টান দেয় এবং মাঝে মধ্যে ধাক্কা দিয়ে চিৎ করে ফেলে দেয়।
একইভাবে ব্যাটারিচালিত রিমোট কন্ট্রোল পুতুলও এক ধরনের খেলারসামগ্রী। শিশুতোষ আনন্দের জন্যই এগুলো তৈরি হয় এবং দুনিয়ার শত কোটি অবুঝ শিশুকে প্রবোধ দেয়ার জন্যই দেশে দেশে অজ¯্র পুতুল তৈরি করা হয়। শিশুরা এসব পুতুল নিয়ে খেলে-মাঝে মধ্যে পুতুলগুলোকে আছাড় মারে এবং রিমোট দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে প্রায়ই ব্যর্থ হয়ে বিভিন্ন ভারী জিনিসপত্রের সাথে পুতুলের সংঘর্ষ ঘটিয়ে যন্ত্রগুলোর হাত-পা-নাক-কান ভেঙে ফেলে। এর বাইরে পুতুলের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেলে বা রিমোট নষ্ট হয়ে গেলে ওগুলোর কি অবস্থা হয়, তা আমরা কমবেশি জানি।
আমরা আজকের আলোচনার একদম প্রান্তসীমায় চলে এসেছি। এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে সংক্ষেপে কিছু বলে প্রসঙ্গের ইতি টানব। দেশের প্রচলিত বিধিবিধান অনুসারে আমলাতন্ত্রের কোনো সাধ্য নেই জনপ্রতিনিধিদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার। একটি আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য- আমলাতন্ত্রের বিকল্প নেই। উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পরবর্তীতে প্রবল প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে শিক্ষিত সম্প্রদায় আমলাতন্ত্রে প্রবেশ করে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা ছাড়া আমলাতন্ত্রে টিকে থাকা অসম্ভব। ফলে রাষ্ট্রের যেকোনো শ্রেণিপেশার চেয়ে আমলাতন্ত্রের রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য; যার কারণে তারা কখনো কারো আনুগত্য করে অথবা অন্যকে নিজেদের আনুগত্যের বেড়াজালে আবদ্ধ করে ফেলে।
আমাদের সংবিধান এবং অন্যান্য লিখিত-অলিখিত বিধিবিধান মতে, আমলা এবং জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুনির্দিষ্ট করা আছে। সুতরাং নীতি-নৈতিকতা, আইন-কানুন এবং প্রথামতে কেউ কাউকে তাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই। কিন্তু যেখানে আইনের ব্যত্যয় ঘটে, নীতি-নৈতিকতার কবর রচনা হয় এবং অবৈধ ও অন্যায়ভাবে কোনো পদ-পদবি সৃষ্টি হয় তখন সেই সব পদ-পদবিধারীরা সব সময়ই অপমান-লাঞ্ছনা বা গঞ্জনার শিকার হন। দ্বিতীয়ত, যিনি নির্মাণ করেন তিনি সবসময়ই নির্মিত বস্তুর ওপর কর্তৃত্ব করেন। প্রকৃতির এই চিরন্তন সত্যকে অস্বীকার করার সাধ্য কোনো জীবের পক্ষেই সম্ভব নয়। সুতরাং যারা সম্মান দাবি করছেন বা নিজেদের জনপ্রতিনিধি বলে প্রচার করছেন তারা আল্লাহর ওয়াস্তে একটু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো তারা কিভাবে জনপ্রতিনিধি হয়েছেন, কে তাদেরকে জনপ্রতিনিধি বানিয়েছে এবং কেন তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা অপমান করা হচ্ছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য