জনদুর্ভোগ : সরকার বনাম সিন্ডিকেট
- তৈমূর আলম খন্দকার ৩০ নভেম্বর ২০১৯
প্রতিনিয়তই হঠাৎ কোনো-না-কোনো জনদুর্ভোগ দেখা দেয়, যা স্বাভাবিক নয় বরং কৃত্রিম উপায়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই। প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম দুর্যোগের মধ্যে পার্থক্য হলো, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া যায়, যার ফলে জনগণ প্রকৃতির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। প্রকৃতি সব সময়ই প্রতিশোধপরায়ণ। একে বাধাগ্রস্ত করলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। কিন্তু কৃত্রিম দুর্যোগ সৃষ্টি হয় একটি শ্রেণী কর্তৃক অঢেল বিত্তশালী হয়ে এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত ও ব্যবহারের মাধ্যমে অতিমাত্রায় মুনাফা অর্জনকে টার্গেট করে যখন সঙ্ঘবদ্ধভাবে অপরাধ করা হয়। তখনই এই সঙ্ঘবদ্ধতাকে মিডিয়ার ভাষায় ‘সিন্ডিকেট’ বলা হয়, যারা একত্রে কোনো বিষয়ের ওপরে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেদের ফায়দা লোটার জন্য জনগণের পকেট কাটে।
শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ধানের ক্ষেতে আগুন দেয়া, কোরবানির চামড়ার মূল্য না পাওয়ায় মাটির নিচে পুঁতে রাখা, বাজারে পেঁয়াজ থাকা সত্ত্বেও ‘স্বর্ণের (রূপক অর্থে) মূল্যে’ পেঁয়াজ বিক্রি, মজুদ থাকা সত্ত্বেও লবণের সঙ্কট প্রভৃতি ঘটনা সিন্ডিকেটের কাজ বলে সরকার ‘সিন্ডিকেট’ ধরা হবে বলে মন্তব্য করছে। কিন্তু সিন্ডিকেট আর ধরা পড়ছে না। ক্যাসিনো ও মানিলন্ডারিং সিন্ডিকেট কথিত অভিযানের জালে যে ধরা পড়ল তাদের সবাই সরকারি ঘরানার শুধু সমর্থক নয় বরং নেতা গোছের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত বা সরকারের ক্ষমতাবান ব্যক্তি ছাড়া সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ সংঘটিত করা সম্ভব নয়। ১৯৮০ সালে আমেরিকার তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান কর্তৃক গঠিত কমিশন এ মর্মে মতামত ব্যক্ত করেছিল, “A series of charactercstics of criminal group,” “protector and specialist support” necessary for organized crime. অর্থাৎ অপরাধী চক্রকে সুরক্ষা দেয়া ও বিশেষায়িত সমর্থন ছাড়া একটি সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ হতে পারে না। এ চৎড়ঃবপঃড়ৎ এবং ংঢ়বপরধষরংঃ ংঁঢ়ঢ়ড়ৎঃ দেয়া কাদের পক্ষে সম্ভব? ক্ষমতার যারা ক্রীড়নক, যারা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে পারে, যাদের অঙ্গুলি নির্দেশে ক্ষমতার মানদণ্ড ওঠানামা করে তাদের ইঙ্গিত বা পরামর্শ ছাড়া অপরাধী চক্রকে প্রোটেকশন দেয়ার যোগ্যতা কে রাখতে পারে?
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতামত এই যে,ÒGreat consensus in the literature that organized crime functions as a continuing enterprise that rationally works to make a profit through illicit activities and that it ensures its existence through the use of threats or force and through corruption of public officials to maintain a degree of immunity from law enforcement. There also appears to be some consensus that organized crime tends to be restricted to those illegal goods and services that are in great public demand through monopoly control of an illicit market (m~Î : Introduction to organized Crime).”
ওই সূত্র মোতাবেক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের সমর্থন সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ সংঘটনের জন্য অপরিহার্য। ওই সূত্র থেকে আরো একটি বিষয় অতীব স্পষ্ট, সিন্ডিকেটের অপরাধ করা বা হওয়ার জন্য দরকার “এৎবধঃ চঁনষরপ উবসধহফ ঃযৎড়ঁময সড়হড়ঢ়ড়ষু পড়হঃৎড়ষ ড়ভ ধহ রষষরপরঃ সধৎশবঃ.” অর্থাৎ সিন্ডিকেটের টার্গেট এমন বস্তু যার “চঁনষরপ উবসধহফ” আছে সে ধরনের বস্তুর ওপর সড়হড়ঢ়ড়ষু পড়হঃৎড়ষ প্রতিষ্ঠা। পেঁয়াজ একটি অপরিহার্য খাদ্য উপাদান, যার চঁনষরপ উবসধহফ অনস্বীকার্য এবং এর ওপর সিন্ডিকেটদের সড়হড়ঢ়ড়ষু পড়হঃৎড়ষ (একচ্ছত্র আধিপত্য) কায়েমের কারণেই বাজারে পেঁয়াজ থাকা সত্ত্বেও এর মূল্য নির্ধারিত হচ্ছে আকাশচুম্বী, যা কল্পনা করাও জনগণের ধারণার মধ্যে ছিল না। অন্য দিকে সিন্ডিকেটদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখার জন্য তথ্য সরকারের কাছে থাকা জরুরি, কিন্তু এতেও সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। এ মর্মে গবেষক Anderson বলেছেন, There is a need for information about organized criminal activity itself by which the governments new legislation and its expanding level of effort can be evaluated. সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ প্রতিরোধে সরকারের দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি যে মতবাদ প্রকাশ করেছেন সে ক্ষেত্রেও এ সরকার দায়িত্ববান ছিল কি?
পেঁয়াজ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে অন্যতম। হঠাৎ কল্পনাতীতভাবে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি সরকার কোনো মতেই স্বাভাবিক করতে পারছে না, বরং তাদের কথা ও বাজারমূল্যের গতিধারা চরম সমন্বয়হীনতায় ভুগছে। সরকার বলছে, পেঁয়াজ প্লেনে উঠেছে। কিন্তু বাজারমূল্য স্থিতিশীল নেই, সরকারি আশ্বাসের ওপর মানুষ ভরসা রাখতে পারছে না। আমদানি রফতানির নিয়ন্ত্রণ এবং শুল্ক আদায়ের জন্য সরকারের একটি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর রয়েছে। যেকোনো ঘটনা ঘটার আগেই সম্ভাব্য অপরাধের সূত্র খুঁজে বের করাই গোয়েন্দাদের কাজ। অথচ তারা তথ্য খোঁজার জন্য মাঠে নেমেছেন ঘটনা ঘটার পরে।
পেঁয়াজের অতিরিক্ত দামের রহস্য উদঘাটনের ২৭ নভেম্বর ৪১ জন পেঁয়াজ আমদানিকারককে শুল্ক গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন বলে জানা যায়। মিডিয়ার সূত্র মতে, ‘কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টিকারী অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করতে ৩৩২ পেঁয়াজ আমদানিকারকের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন শুল্ক গোয়েন্দা। বাংলাবান্ধা, বেনাপোল, ভোমরা, হিলি, সোনা মসজিদ, টেকনাফ, চট্টগ্রাম ও ঢাকা কাস্টম হাউজ দিয়ে চলতি বছরের আগস্ট থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে ১৬৭ হাজার ৮০৬ দশমিক ৪৭ মেট্রিক টন। তারপরও অতিরিক্ত মূল্যের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। অনেক আমদানিকারকের বিরুদ্ধে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আমদানিকৃত পেঁয়াজ অবৈধভাবে মজুদ করার অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া রয়েছে মানিল্ডারিংয়ের অভিযোগও (২৭-১১-২০১৯ তারিখের জাতীয় পত্রিকা)।’
মন্ত্রীদের চটকদার বক্তব্য আর প্রশাসনিক ব্যবস্থা কোনো মতেই জনগণের চাহিদা বা প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। প্রশাসন জনগণের চাহিদার সম্পূরক হিসেবে চলতে গিয়ে নিজেরাই নিজেদের প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রশাসন মনে করে, জনগণের চাহিদা পূরণের চেয়ে সরকারের মদদপুষ্ট থাকাই তাদের প্রধান দায়িত্ব। যদি তা হয়ে থাকে তবে পেঁয়াজের চাহিদা ও সরবরাহের সঠিক তথ্য তাদের কাছে নেই কেন? এ প্রশ্নগুলোর কোনো জবাব নেই এ জন্য যে, প্রশাসন দলীয় ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। ফলে পেশাদার দায়িত্বের চেয়ে দলবাজি পাচ্ছে প্রাধান্য, ফলে অধিক হারে লাভবান হচ্ছেন আমলারা; যারা প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বরপুত্র।
নেতৃস্থানীয় আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রের ঋবফবৎধষ ইঁৎবধঁ ড়ভ ওহাবংঃরমধঃরড়হ-সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ বলতে যে সংজ্ঞা দিয়েছে তা নিম্নরূপ-
“An organized crime is any crime committed by a person occupying, in an established division of labor, a position designed for the commission of crimes providing that such division of labor includes at least one position for a corrupter, one position for a corruptee, and one position for an enforcer (m~Î : Donland Cressey 1969 Bs).
সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ সিন্ডিকেটকে দমন করতে হলে ঋইও-এর সংজ্ঞা মোতাবেক “ঈড়ৎৎঁঢ়ঃবৎ, ঈড়ৎৎঁঢ়ঃবব” এবং “ঊহভড়ৎপবৎ”কে বা কারা তা সরকারকে খুঁজে বের করতে হবেই। অন্যথায় মন্ত্রীদের বাণী নিছক মুখরোচক বক্তব্য হিসেবে আলোচিত হবে, কিন্তু জনদুর্ভোগ কমবে না। সরিষায় যখন ভূত থাকে, তা দিয়ে ভূত তাড়ানো যায় কি?
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail : [email protected]