- ফ্লোরা সরকার
- ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:০৩, আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:০৮
রাশিয়ার বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’ সিনেমাটি ১৯২৫ (নির্বাক যুগের সিনেমা) সালের ডিসেম্বর মাসে যখন মুক্তি পায়, তখনই সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। যেটি এখনো পর্যন্ত দর্শকের মধ্যে একইরকম আবেদন রেখেছে। তার প্রধান কারণ শুধু রাজনৈতিক এবং বিপ্লবী সিনেমা বলে না। অন্যতম কারণ হলো, এই চলচ্চিত্রে কোনো নায়ক নেই। জনতাই নায়ক। হলিউড সহ অন্যান্য দেশ যখন নায়ক-নায়িকাভিত্তিক গ্ল্যামারাস ছবি নির্মাণের পেছনে ছুটছে, আইজেনস্টাইন তার প্রজ্ঞা এবং মেধা দিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘জনতা নায়ক’ ভিত্তিক সিনেমা ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’।
অনেকটা মঞ্চ নাটকের আদলে পাঁচ অঙ্কে বিভক্ত করে পুরো সিনেমাটি নির্মাণ করা হয়েছে। পোটেমকিম জাহাজের নাবিকেরা গোপন আলোচনার ভিত্তিতে রাশিয়ার অভ্যন্তরে ইউক্রেনের কাছে টেনভ্রা দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে বিপ্লবে অংশ নিতে। প্রথম অঙ্কেই (এই অঙ্কের নাম দেয়া হয়েছে ‘মানুষ ও পোকামাকড়’) দেখা যায়, জাহাজের ডেকে নাবিক এবং খালাসিদের জন্য যে গোস্ত রান্না করে রাখা হয়েছে, সেগুলোতে পোকামাকড়ে ভরে গেছে। ক্যামেরার ডিপ ক্লোজে দেখানো হয়। সেটা দেখে একজন নাবিক বলে ওঠে, এই গোস্ত কোনো কুকুরও খেতে পারবে না। তবু জাহাজের অফিসার বা কর্তা ব্যক্তিরা সেটা খেতে যখন বাধ্য করে, শুরু হয় প্রতিবাদ। ভাকুলিনচাক নামে একজন নাবিক এই ঘটনার আগেই খালাসি ও অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘কমরেড ভাইরা! সময় এসেছে কথা বলার। মুখ খোলার। তাহলে আর অপেক্ষা কেন? সমস্ত রাশিয়া জেগে উঠেছে। আমরা কি তবে সবার শেষে থাকব?’ যে প্রতিবাদের আগুন আগেই জ্বলেছিল, এখন এই গোস্তের ঘটনা সেখানে পেট্রল ঢেলে দিলো। অফিসারদের মেরে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হলো। জাহাজ এগিয়ে চলল।
ইতিহাসে ওদেসার সিঁড়ি তার দীর্ঘতার জন্যে বিখ্যাত হয়ে আছে। এই সিঁড়ির সঠিক মূল্যায়ন করেছেন আইজেনস্টাইন চতুর্থ অঙ্কে ‘ওদেসার সিঁড়ি’ শিরোনামে। এখানে আমরা দেখা যায়, বিপ্লবে অংশ নেয়ার জন্য অনেক জাহাজ সেখানে ভেড়ে। তাদের সাথে একত্রিত হওয়ার জন্য শতশত মানুষ এসে জড়ো হয়। কিন্তু সেই সময়ের স্বৈরাচার শাসক জারের সৈন্যরা তাদের ওপর এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণ শুরু করে। একটা শিশু প্যারাম্বুলেটর সহ সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে পড়তে থাকে, মায়ের আর্তনাদ, অসহায় মানুষের এলোপাথাড়ি দৌড়াদৌড়ির দৃশ্যগুলো সিনেমাটিকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে।
‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’ মূলত ১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে। ইতিহাসে যা Bloody Sunday নামে চিহ্নিত হয়ে আছে। বাস্তবে এই বিপ্লব সার্থক না হলেও, ছবিতে বিপ্লবের সার্থকতা দেখানো হয়েছে। ছবিটি সম্পর্কে পরবর্তীতে পরিচালক আইজেনস্টাইন তার আত্মজীবনীমূলক ‘Beyond the stars : The memoirs of Sergei Eisenstein (edited by Richard Taylor, Translated by William Powell)’ বইটিতে বলেছেন ১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সার্থক না হলেও, এই বিপ্লব আমাদের পরবর্তী বিপ্লবের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। এভাবেই গোটা ছবিতে আমরা দেখতে পাই, রাষ্ট্রের কোনো সঙ্কটে জনগণের অংশগ্রহণই যে শেষ কথা। তারাই একমাত্র নায়ক হয়ে ওঠে।
ঠিক একইরকম চিত্র আমরা বাস্তবে দেখলাম ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশে। কোনো নেতৃস্থানীয় নেতা সেখানে ছিলেন না। প্রায় সব বড় নেতাদের মামলা, জেল ইত্যাদি দিয়ে কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম নেতাহীন সমাবেশে হঠাৎ করে জনগণই নেতা হয়ে উঠলো। জনজনারণ্যে গোলাপবাগের মাঠ ছাড়িয়ে রাস্তায় উপচে পড়লো মানুষ। একটা রাষ্ট্র যখন দুর্নীতি, অত্যাচার, নিপীড়ন, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদিতে ডুবে যেতে থাকে, সেই ডুবন্ত রাষ্ট্রকে একমাত্র জনগণই পারে তুলে আনতে। জনগণের কত শক্তি, কত ক্ষমতা সেটা আমরা এই সমাবেশের মধ্যে দিয়ে বাস্তব প্রমাণ পেলাম। সেখানে যারা গিয়েছিল, তারা কেউ ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’ দেখে নাই, বিপ্লবের অর্থ বোঝে না। কিন্তু পরিবর্তন যে দরকার সেটা তারা তাদের বোধ দিয়ে বুঝতে পেরেছে। এই বোধ সবার ভেতরেই থাকে এবং আছে। ঠিক সময়ে সেটা জেগে উঠে এবং উঠতেই থাকে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব