২০১৭ সালের অক্টোবরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন আব্দুছ ছালাম আজাদ। ওই সময়ে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল ৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
এখন ব্যাংকটির ঋণ বেড়ে হয়েছে ৮৫ হাজার ২০৬ কোটি টাকা, আর খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, গত সাড়ে পাঁচ বছরে ঋণ বিতরণ ও খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বয়সের কারণে আব্দুছ ছালাম আজাদ এবার অবসরে যাবেন। তাঁর মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২৯ এপ্রিল।
জনতা ব্যাংক একসময় ছিল সরকারি খাতের সেরা ব্যাংক। সবচেয়ে ভালো শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা ছিলেন ব্যাংকটির গ্রাহক। এখন দেশের অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপি অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ এবং প্রভাবশালী বেশ কিছু ব্যবসায়ী ব্যাংকটির বড় গ্রাহক। আব্দুছ ছালাম আজাদের বিরুদ্ধে ঋণ বিতরণে নানা অনিয়ম খুঁজে পেলেও শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা নিতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। উপরন্তু, তাঁর মেয়াদ এক দফা বাড়িয়ে ৬৫ বছর পর্যন্ত এমডি পদে থাকার সুযোগ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
কয়েক বছর আগেও জনতা ব্যাংককে বিবেচনা করা হতো অন্য সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য তহবিলের উৎস হিসেবে। তবে বর্তমানে প্রতিদিন কমবেশি আট হাজার কোটি টাকা ধার করে চলতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে।
কয়েক বছর আগেও জনতা ব্যাংককে বিবেচনা করা হতো অন্য সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য তহবিলের উৎস হিসেবে। তবে বর্তমানে প্রতিদিন কমবেশি আট হাজার কোটি টাকা ধার করে চলতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে। ফলে সব মিলিয়ে ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে।
তবে জনতা ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি খারাপের দায় পুরোপুরি নিজের কাঁধে নিতে রাজি নন আব্দুছ ছালাম আজাদ। ১৭ এপ্রিল আব্দুছ ছালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে থেকেই কিছু ঋণ খেলাপি অবস্থায় ছিল, তবে তা দেখানো হয়নি। আমার মেয়াদেও হয়তো এসব ঋণে ভালো পরিচর্যা হয়নি। এ কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে।’
আব্দুছ ছালাম আজাদ আরও বলেন, ‘আমি যাওয়ার আগে শীর্ষ খেলাপিদের নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছি। ফলে, সামনের দিনে ব্যাংকের পরিস্থিতি ভালো হয়ে যাবে। চলতি বছরে অন্য ব্যাংকের আমানত কমলেও আমাদের দুই হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। অন্য ব্যাংকের মতো আমরা অবলোপন করে খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখাইনি।’
জনতা ব্যাংকের এই বিদায়ী এমডি মনে করেন, ব্যাংকটির পরিস্থিতির এরই মধ্যে উন্নতি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও ভালো হবে।
আমি যাওয়ার আগে শীর্ষ খেলাপিদের নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছি। ফলে, সামনের দিনে ব্যাংকের পরিস্থিতি ভালো হয়ে যাবে। চলতি বছরে অন্য ব্যাংকের আমানত কমলেও আমাদের দুই হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। অন্য ব্যাংকের মতো আমরা অবলোপন করে খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখাইনি।
আব্দুছ ছালাম আজাদ, এমডি, জনতা ব্যাংক
বেড়েছে ঋণ বিতরণ, সঙ্গে খেলাপি ঋণও
২০১৭ সালে জনতা ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ছিল ৬৪ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা ও বিতরণ করা ঋণ ছিল ৪৫ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে আমানত ও ঋণ বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে ১ লাখ ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা ও ৮৫ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, ২০২২ সালে যা বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। অবশ্য ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৮ হাজার কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই হয়েছিল।
খেলাপি ঋণ বাড়লেও আমদানি-রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে জনতা ব্যাংকের। ২০১৭ সালে আমদানি অর্থায়ন ছিল ১৪ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকার, ২০২১ সালে যা বেড়ে হয় ২৭ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। ২০২২ সালে আমদানি বেড়ে হয় ৪৮ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের ২০১৭ সালে রপ্তানি হয়েছিল ১৩ হাজার ৯৯২ কোটি, ২০২১ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ১১৪ কোটি টাকায়। ২০২২ সালে রপ্তানি বেড়ে হয় ২১ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা।
একসময় ভালো মুনাফা করার ব্যাংক হিসেবেও পরিচিতি ছিল জনতা ব্যাংকের। ২০১৩ সালে ব্যাংকটি ৯৫৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল। ২০১৭ সালে নিট মুনাফা হয় ২৬৮ কোটি টাকা।
এরপর ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে মুনাফার পরিমাণ কমে ৩০ কোটি টাকার নিচে চলে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি ছাড়ের ফলে ২০২১ সালে ৩০০ কোটি টাকা মুনাফা করার সুযোগ পায় জনতা ব্যাংক। ২০২২ সালের হিসাব চূড়ান্ত হলে অনেকটা একই পরিমাণ মুনাফা হবে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।
ব্যাংকটিতে নতুন এমডি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মো. আবদুল জব্বার। বর্তমানে তিনি কৃষি ব্যাংকের এমডি। তবে আগে একসময় মো. আবদুল জব্বার জনতা ব্যাংকের ঋণ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন।
খেলাপিদের নিয়ে বিপদে জনতা
শীর্ষ খেলাপি গ্রাহক অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণ ব্যাংক খাতে আলোচিত একটি বিষয়। ২০২০ সালে জাতীয় সংসদে পেশ করা শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকায় প্রথম স্থানে ছিল গ্রুপটি। বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ১৮টি প্রতিষ্ঠান খুলে জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নেন এগুলোর প্রকৃত মালিক মো. ইউনুছ ওরফে বাদল একাই।
পরে সুদসহ এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। বর্তমান এমডি আব্দুছ ছালাম আজাদ যখন জনতা ব্যাংক ভবন শাখার ব্যবস্থাপক, তখন এসব ঋণ দেওয়া হয়। হল-মার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির পর অ্যাননটেক্সকে দেওয়া জনতা ব্যাংকের ঋণই ছিল ব্যাংক খাতে আলোচিত ঋণ কেলেঙ্কারি। এটি ‘একক ঋণের বৃহত্তম কেলেঙ্কারি’ হিসেবে তখন পরিচিতিও পেয়েছিল।
তবে অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণ জনতা ব্যাংক থেকে মুছে ফেলার জন্য পাওনা সুদের পুরোটা মওকুফের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। এরপর এই ঋণ কিনে নেওয়ার কথা চট্টগ্রামের একটি গ্রুপের। শর্ত হলো, অ্যাননটেক্সের কাছে পাওনা ঋণের মধ্যে ৪ হাজার ৮২০ কোটি টাকা আগামী জুন মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
অর্থ পাচার ও ব্যাংকঋণে অনিয়মের দায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে অভিযুক্ত চামড়া ব্যবসায়ী ক্রিসেন্ট গ্রুপ জনতা ব্যাংকের অন্যতম খেলাপি গ্রাহক। ব্যাংকটিতে তাদের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৬৮৩ কোটি টাকার ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়েছে।
এটি পূরণ হলেই কেবল ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকার সুদ মওকুফ পাবে অ্যাননটেক্স।
জানা গেছে, এই ঋণ কিনে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল চট্টগ্রামভিত্তিক গ্রুপটি। তবে তাদের মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো তারল্য-সংকটে পড়ায় এ প্রক্রিয়া থমকে গেছে বলে ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে, অর্থ পাচার ও ব্যাংকঋণে অনিয়মের দায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে অভিযুক্ত চামড়া ব্যবসায়ী ক্রিসেন্ট গ্রুপ জনতা ব্যাংকের অন্যতম খেলাপি গ্রাহক। ব্যাংকটিতে তাদের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৬৮৩ কোটি টাকার ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়েছে। বিদেশ থেকে তাদের ৫০ লাখ ডলারের রপ্তানি আয় দেশে আনার প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া আরও কিছু খেলাপি গ্রাহক অর্থ পরিশোধ করছে বলে জানিয়েছেন আব্দুছ ছালাম আজাদ।
জনতা ব্যাংকের এমডি প্রথম আলোকে বলেন, ক্রিসেন্ট আবার ব্যবসা শুরু করেছে। তাদের ৫০ লাখ ডলার দেশে আসবে। ফলে এই গ্রাহক দ্রুত নিয়মিত হয়ে যাবে। অ্যাননটেক্সের ঋণ নিয়মিত হয়েছে, সুদ মওকুফ করা হয়েছে। একটি পক্ষ কিনে নিতে চাইছে। বিষয়টি চূড়ান্ত হলেই ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
ব্যাংকটি জানায়, গ্রাহকদের মধ্যে বিআর স্পিনিংয়ের ৬০০ কোটি টাকা ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়েছে। এ ছাড়া হাবিব হোটেল (হলিডে ইন), ইব্রাহীম টেক্সটাইল, লিতুন ফেব্রিকসের ঋণ নিয়মিত করার চেষ্টা চলছে।
আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, চলতি বছর এসব ঋণ নিয়মিত হয়ে যাবে। ফলে, খেলাপি ঋণ ১১ থেকে ১২ শতাংশে নেমে আসবে, যা হবে রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ১৮ শতাংশ ছিল খেলাপি।
তিন শাখায় কেন্দ্রীভূত ৬০% ঋণ
জনতা ব্যাংকের তিনটি শাখায় কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে ব্যাংকটির বেশির ভাগ ঋণ। এই তিন শাখার কিছু বড় গ্রাহকই ব্যাংকটির বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অ্যাননটেক্সের ঋণও ছিল এই তিন শাখার দুটিতে।
ব্যাংকের শাখা তিনটি হলো ঢাকার জনতা ভবন করপোরেট শাখা ও লোকাল অফিস এবং চট্টগ্রামের সাধারণ বীমা ভবন করপোরেট শাখা। ব্যাংকটির ৮৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ এই তিন শাখার অধীন। আর প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া গ্রাহকেরাও মূলত এই তিন শাখার গ্রাহক।
জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ১০ খেলাপি গ্রুপের তিনটি সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকটির শীর্ষ ৩০ ঋণগ্রহীতা গ্রুপের মধ্যে ‘ভালো প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপ’ বলে পরিচিতরা নেই বললেই চলে।
ব্যাংকটির ঋণগ্রহীতাদের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এর শীর্ষে রয়েছে অ্যাননটেক্স। এরপর রয়েছে চট্টগ্রামের শীর্ষ এক ব্যবসায়ী। এরপরই চামড়া খাতের ক্রিসেন্ট গ্রুপ। তালিকায় এর পরের অবস্থান জ্বালানি খাতের একজন ব্যবসায়ী ও সরকারের একজন উপদেষ্টার গ্রুপ। এরপর আবারও চট্টগ্রামের গ্রুপটির একটি প্রতিষ্ঠান। তারপর থারমেক্স গ্রুপ।
জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ১০ খেলাপি গ্রুপের তিনটি অবশ্য সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকটির শীর্ষ ৩০ ঋণগ্রহীতা গ্রুপের মধ্যে ‘ভালো প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপ’ বলে পরিচিতরা নেই বললেই চলে। ফলে, জনতা ব্যাংক একটি বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।