নিজস্ব প্রতিনিধি
র্যাব এবং পুলিশের নির্যাতন ও নিপীড়নে বছরে কতজন নিরীহ মানুষ নিহত হলো বা কতজন গুম হলো এই পরিসংখ্যান নিয়ে মানুষের এখন আর আগ্রহ নেই। কারণ গত এক দশকে দেশের সাধারণ মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে যে, ভিন্নমত দমন করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ পুলিশ ও র্যাবকে কত নির্মমভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। গুম-খুন ছাড়াও ভিন্নমতকে দমনে পুলিশ-র্যাবসহ আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী গুলো নানা পদ্ধতিতে নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এই মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়নের ঘটনা দেখতে দেখতে নিরীহ মানুষ ফুঁসে আছে। খুন-গুম করার পর তা নিয়ে পুলিশ ও র্যাব যে নির্লজ্জ মিথ্যাচার করে তা নিয়েও মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত।
এছাড়া, র্যাব বা পুলিশের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে পরিসংখ্যান মানবাধিকার সংগঠনগুলো দেখায়, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি বলে বিশ্বাস করেন বাংলাদেশের মানুষ।
আর তাই এই দুই বাহিনীর বিরুদ্ধে দিন দিন মানুষের ক্ষোভ দানা বাঁধছে। সুযোগ পেলেই এই ক্ষোভের বহি:প্রকাশও দেখা যায় সাধারণ মানুষের মধ্যে।
১/১১-এর জরুরী আইনের সেনা-শাসিত নির্বাচনের পর ক্ষমতায় জেঁকে বসা শেখ হাসিনা ভিন্নমত দমনে নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করে চলেছেন পুলিশ-র্যাবকে। এই দুই বাহিনী ছাড়াও তাকে অন্যায়ভাবে মসনদ ধরে রাখতে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে সহায়তা করছে সেনাবাহিনীর কয়েকজন জেনারেল।
যদিও ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় ইশতেহারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ সব ধরণের মানবাধিকার লংঘন বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। বিদেশী মানবাধিকার সংগঠন গুলোর কাছেও একই প্রতিশ্রতি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, ক্ষমতায় গিয়ে বেমালুম ভুলে গেছেন এই প্রতিশ্রুতির কথা। এখন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা র্যাব ও পুলিশ দিয়ে তিনি করাচ্ছেন না। যা দেশের মানুষের মনে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষত সৃষ্টি করছে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে হিউম্যান রাইট ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক ডিরেক্টর ব্র্যাড এডামসের একটি লেখা ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। সেখানে ব্র্যাড এডামস লেখেন, ‘২০০৮ সালে লন্ডনে নির্বাসনে থাকা শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বোনের বাসায় দেখা করেছিলাম, তখন তিনি তার দেশের মানুষের অধিকার রক্ষায় পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, যদি পরবর্তী নির্বাচনে জিততে পারেন, তাহলে এই চর্চা (বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড) বন্ধ করবেন। তিনি তীব্রভাবে এর সমালোচনা করে বলেছিলেন, “আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আমি এ ধরনের হত্যাকাণ্ড হতে দেব না।”
ব্র্যাড এডামসের লেখা থেকে জানা যায়, “শেখ হাসিনার এক দশকের শাসনামলে এসব বাহিনীর বিরুদ্ধে ২,৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। আইজিপি হওয়ার আগে বেনজির কয়েক বছর ধরে কুখ্যাত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) দায়িত্বে ছিলেন। তার আমলেই র্যাব কমপক্ষে ৮০টি গুম ও ৪৫০টিরও বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। ২০১৭ সালের এপ্রিলে, বেনজির আহমেদ যখন র্যাবের দায়িত্বে ছিলেন, তখন সুইডিশ রেডিও ওই বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার গোপনে রেকর্ডকৃত বক্তব্য প্রকাশ করে, যেখানে তিনি বলছিলেন, র্যাব নিয়মিতভাবে লোকজনকে উঠিয়ে নেয়, হত্যা করে ও মরদেহ ফেলে দেয়।”
এসব ধারাবাহিক নিষ্ঠুর নির্যাতনের ফলে ফুঁসে আছে দেশের মানুষ। সম্প্রতি দেশব্যাপী কয়েকটি ঘটনায় এই দুই বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে দেখা গেছে ।
হাসপাতালে এএসপিতে পিটিয়ে হত্যা:
গত ৯ নভেম্বর রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে চিকিৎসার নামে অত্যন্ত নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমকে।
বরিশাল মহানগর ট্রাফিক পুলিশের সহকারী কমিশনার আনিসুল করিম (৩৫) মানসিক চিকিৎসার জন্য ওই হাসপাতালে যান।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, বেলা আনুমানিক ১১টা ৪৫ মিনিটে আসামিরা আনিসুল করিমকে হাসপাতালের দোতলার একটি রুমে মারতে মারতে ঢুকায়। তাকে রুমের ফ্লোরে জোরপূর্বক উপুড় করে ৩-৪ জন হাঁটু দিয়ে পিঠের ওপর চেপে বসে। কয়েকজন পিঠমোড়া করে ওড়না দিয়ে তার দুই হাত বাঁধে। কয়েকজন কনুই দিয়ে ঘাড়ের পেছনে ও মাথায় আঘাত করে। একজন মাথার ওপরে চেপে বসে এবং আসামিরা সকলে মিলে পিঠ, ঘাড়সহ শরীরের বিভিন্নস্থানে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি মারে। ফলে আনিসুল করিম নিস্তেজ হয়ে পড়েন।
এদিকে, এই ঘটনার পরপরই হাসপাতালের কর্মীরা দাবি করেন, তাদের সঙ্গে পুলিশ পরিচয়ে খারাপ ব্যবহার করেছিলেন নিহত আনিসুল করিম।
অর্থাৎ পুলিশের প্রতি আগে থেকে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ তারা ঝেড়ে দেন এই কর্মকর্তার ওপর। যদিও তারা ভাবতেই পারেননি যে নির্মম এমন কাণ্ডে মারা যাবেন তরুণ এই পুলিশ অফিসার।
লালমনিরহাটের ঘটনা:
শুধু গুমই নয়, রাজনৈতিক কাজেও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে গত এক যুগে র্যাব ও পুলিশের সদস্যরা সাদা পোশাকে ইচ্ছেমতো মানুষের বাসায় ঢুকে তল্লাশি করেছে। জঙ্গি তকমা দিয়ে ধরে নিয়ে গেছে অনেক মানুষকে, অনেককে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাও করা হয়েছে। এমনকি বাসায় তাবলিগ জামায়েতের বই “ফাজেয়েলে আমল” পাওয়ার পর এটাকেও “জঙ্গিবাদী” বই হিসেবে আখ্যা দিয়ে গণমাধ্যমের সামনে প্রচার করার নজির রয়েছে র্যাবের বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগের দু:শাসনে এমন শত শত ঘটনার নজির রয়েছে। ফলে দেশের মানুষ দিন দিন ফুঁসে উঠছে। কখনও কখনও প্রতিবাদ করলেও, রক্তাক্ত উপায়েই তা দমন করছে আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও তাদের পেটোয়া ছাত্রলীগ। যেমনটা তারা গণহত্যা চালিয়েছিলো শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এমন স্বেচ্ছাচারিতা ফলে বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) লালমনিরহাটের একটি মসজিদে যখন দুই ব্যক্তি অস্ত্র তল্লাশির নাম করে ঢুকলো, তখনই দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন সাধারণ মানুষ।
গোয়েন্দা সংস্থার লোক পরিচয় দেয়ার পর ক্ষোভের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দেন তারা। এরপর সেই দুই তরুণ যা করলেন, তাতে জনগণের ক্ষোভ সকল সীমা অতিক্রম করল। অস্ত্র তল্লাশির নাম করে তারা মসজিদের র্যাকে থাকা কোরআন শরীফ, হাদিসের বই ও ধর্মীয় অন্যান্য মাসায়েল সম্পর্কিত বই ছুড়ে ফেলতে লাগলেন।
মসজিদে কোরআন রাখার র্যাকে যেকোনো মুসল্লির ঘাঁটাঘাঁটি নতুন কোনো ব্যাপার না। এবং তা করতে গিয়ে কোরআন বা ইসলামী অন্য কোনো কিতাব পড়ে যাওয়াও বিচিত্র কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু, গোয়েন্দা সংস্থার লোক পরিচয় দেয়ার পর থেকেই মসজিদে থাকা মুসল্লিদের মধ্যে আগে থেকে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ শুরু হয়। ফলে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত পবিত্র কোরআন শরীফ পড়ে যাওয়াকে ভালোভাবে নেয়নি সাধারণ মুসল্লিরা। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের রক্তাক্ত বহির্প্রকাশ ঘটান তারা। সেই তরুণকে পেটানোটা ছিলো মূলত গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ-র্যাবের ওপরই সাধারণ মানুষের আঘাত।
এসআই আকবরকে বেঁধে রাখা:
গত ৯ নভেম্বর সিলেটে বহুল আলোচিত রায়হান হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রধান আসামী পুলিশের এসআই আকবরকে সিলেটের কানাইঘাটের ইন্ডিয়া সীমান্তে ডোনা এলাকায় খাসিয়া তরুণরা পাকড়াও করে। সীমান্তবর্তী গ্রাম হওয়ায় এই খাসিয়াদের কাছে আগে থেকেই খবর ছিলো যে এসআই আকবর এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফলে তাদেরও পুলিশের ওপর আগে থেকেই ক্ষোভ ছিলো।
আকবরকে ধরার পর স্থানীয়দের ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা যায় স্থানীয় খাসিয়ারা, তাকে কোমরে, পায়ে ও বাহুতে নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে।
আকবরকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা, হাত জোড় করে তার কান্নার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর খাসিয়া তরুণদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষকে ধন্যবাদ দিতে দেখা যায়। আকবরের প্রতি ঘৃণাও প্রকাশ করেন মানুষ। বছরের পর বছর পুলিশের নির্মম ব্যবহার অতিষ্ঠ মানুষ তাই এসআই আকবরকে খাসিয়া তরুণদের হাতে এভাবে লাঞ্ছিত হতে দেখে উল্লাস প্রকাশ করেন।
সিনহা হত্যা:
টেকনাফে খুন, গুম আর নির্যাতনের রাজ্য কায়েম করেছিলেন প্রদীপ কুমার দাশ ও তার বাহিনী। এবং ওপরওয়ালাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদেই করে যাচ্ছিলেন তারা। ফলে সিনহা রাশেদকে হত্যার পর তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে ফেলেন সাধারণ জনগণ। প্রতিবাদে ফেটে পড়েন তারা।
এর আগে শতাধিক খুন করে পার পেলেও সিনহা হত্যার পর সাধারণ মানুষ তাদের সমস্ত রাগ উগরে ফেলতে কার্পন্য করেন নি। দেশ-বিদেশে মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়ায় কারাগারে যেতে হয় শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট এই সংখ্যালঘুপুলিশ কর্মকর্তাকে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে জনগণের এই ক্ষোভ দেখেও ফ্যাসিষ্ট শেখ হাসিনা এবং তাঁর তল্পিবাহক র্যাব পুলিশের কর্মকর্তাদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গণমানুষের ক্ষোভ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যায় সেটাই এখন দেখার বিষয়।