জনকণ্ঠে নজিরবিহীন বিদ্রোহ, সম্পাদককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ

24 Live Newspaper

দেশের অন্যতম পুরোনো দৈনিক পত্রিকা জনকণ্ঠে এক নজিরবিহীন অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে। পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক শামীমা এ খানকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে এর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের একটি অংশ। তারা নিজেরাই একটি ‘সম্পাদকীয় বোর্ড’ গঠন করে পত্রিকা পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছেন, যা দেশের গণমাধ্যম জগতে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

এই নাটকীয় পটপরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটে শনিবার, যখন মালিকপক্ষ নতুন নিয়োগ পাওয়া নয়জন কর্মীকে চাকরিচ্যুত করে। এর পাল্টা জবাবে ওই কর্মীরা একজোট হয়ে শুধু সম্পাদককেই অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেননি, বরং মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে ঢাকার হাতিরঝিল থানায় একটি মামলাও দায়ের করেছেন। ফলস্বরূপ, পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণের প্রিন্টার্স লাইন থেকে সম্পাদক ও প্রকাশকের নাম সরিয়ে ‘সম্পাদকমণ্ডলী কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত’ লেখা হচ্ছে।

জনকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শামীমা এ খান এই ঘটনাকে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ও ‘অবৈধ দখল’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তার অভিযোগের আঙুল পত্রিকাটির চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) অবসরপ্রাপ্ত মেজর আফিজুর রহমান এবং প্লানিং অ্যাডভাইজর ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা জয়নাল আবেদীন শিশিরের (শিশির) দিকে। শামীমা খানের দাবি, ‘ষড়যন্ত্র করে জনকণ্ঠ ভবনে মব সৃষ্টি করে অবৈধভাবে দখল করা হয়েছে।’

তবে এই অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন মেজর আফিজুর রহমান ও জয়নাল আবেদীন উভয়েই। জয়নাল আবেদীনের মতে, দখলের অভিযোগটি ‘আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ভাষ্য’। তিনি বলেন, ‘আমরা মালিকানা বা প্রকাশনায় নেই। কর্মরত সব সাংবাদিকের সর্বসম্মতিক্রমে পত্রিকা পরিচালনার জন্য শুধু একটি বোর্ড করেছি।’ তার দাবি, মালিকপক্ষ পত্রিকার ব্যানারে কালো রং ব্যবহার করে কর্মীদের জীবন বিপন্ন করেছে এবং প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা বেতন বকেয়া রেখেছে।

এই সংকটের শেকড় প্রোথিত রয়েছে গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরের দিনগুলোতে। অভিযোগ রয়েছে, তখন থেকেই পত্রিকাটিতে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি-সমর্থিত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়। গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের সিওও মেজর আফিজুর রহমান, যিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত ছিলেন, তার বিরুদ্ধেই মূলত এই নিয়োগগুলো দেওয়ার অভিযোগ। যদিও আফিজুর রহমান বলছেন, প্রতিষ্ঠানকে ‘নিরাপদ ও টেকসই’ রাখতেই তিনি পেশাদারির সঙ্গে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

সাম্প্রতিক সময়ে পত্রিকার ব্যানারের রং লাল ও কালো করা নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে। মালিকপক্ষের অভিযোগ, নতুন কর্মীরা নিজেরাই পত্রিকার টেম্পলেট কালো করে ‘সাবোটাজ’ করেছে এবং এটিকে ইস্যু বানিয়ে পত্রিকা দখলের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেছে।

শনিবার রাতে জনকণ্ঠ ভবনের সামনে এক সমাবেশে মীর জসিম নামে একজন নিজেকে নতুন সম্পাদকীয় বোর্ডের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘জনকণ্ঠ ও সম্পাদক হিসেবে যিনি আছেন, তাকে সম্পাদকের পদ থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছি। তবে তিনি প্রকাশক হিসেবে থাকবেন। তার দুই ছেলেকে জনকণ্ঠে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে।’

অন্যদিকে, শামীমা এ খানের অভিযোগ, নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টস বিভাগের তিনটি ফ্লোরের চাবি কেড়ে নিয়েছে এবং পুলিশি সহায়তা চেয়েও তিনি পাননি। তার ছেলে জিশাল আতিকুল্লাহ খান বলেন, ‘কয়েকজন কর্মচারী প্রতিষ্ঠান দখল করে উল্টো আমাদের বিরুদ্ধেই মামলা করেছে।’

পুরো ঘটনাপ্রবাহে মেজর আফিজুর রহমানের ভূমিকা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। তিনি পত্রিকা দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘ডুবন্ত এ প্রতিষ্ঠান দখল করবে কে? তাদের এত ঋণ।’ তিনি আরও জানান, সম্প্রতি সাত-আটজনকে যে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, সে বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন না।

উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত জনকণ্ঠ একসময় ‘সেই রাজাকার’ শিরোনামে সিরিজ প্রতিবেদনের জন্য ব্যাপক আলোচিত হলেও পরবর্তীকালে এটি আওয়ামী লীগ-পন্থী পত্রিকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকার গণমাধ্যম জগতে মালিকানা ও কর্মী পর্যায়ে যে ব্যাপক পরিবর্তনের অভিযোগ উঠেছে, জনকণ্ঠের এই ঘটনা সেই চলমান অস্থিরতারই এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here