পার্থিব জগতে মানুষের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু মুদ্রা বা ‘টাকা’। এই টাকা মুদ্রণ বা ছাপা হয় গাজীপুরের টাঁকশালে। দেশের মানুষের কাছে এটি ‘টাঁকশাল’ নামে বেশি পরিচিত হলেও টাকা ছাপানোর এই প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত নাম ‘দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড।’
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দেশে কিছু দিন পাকিস্তানি টাকার প্রচলন ছিল। তখন ওই টাকার নোটে ‘বাংলাদেশ’ লেখা স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হতো। পাকিস্তানি মুদ্রার পরিবর্তে বাংলাদেশের মুদ্রা হিসেবে টাকার প্রচলন শুরু হয় ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ। বাংলাদেশে কাগজে তৈরি মুদ্রার নাম টাকা। দেশের অর্থনীতির ব্যাপ্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি বাজারে বাড়ছে মুদ্রা প্রবাহ। এই প্রবাহিত মুদ্রার বেশিরভাগই রয়েছে মানুষের হাতে হাতে।
কেন নতুন নোট ছাপতে হয়
বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি বিভাগ নতুন নোটের চাহিদা পূরণ করতে উদ্যোগ নেয়। আর সেভাবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা লিখিতভাবে মতামত দেন। মূলত, নষ্ট হয়ে যাওয়া টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষণ করার পর তা পুড়িয়ে ফেলা হয়। ব্যবহার অযোগ্য নোট (যা পুড়িয়ে ফেলা হয়) ও বাজার সার্কুলেশন বা অর্থের প্রবাহের বিষয়টি দেখেই পরে নতুন নোট আনা হয়। অর্থাৎ, নতুন নোট ছাপানো হয়। এক্ষেত্রেও মার্কেট টুলস ব্যবহার করে পর্যালোচনা করে দেখা হয়—কী পরিমাণ নতুন টাকার দরকার পড়ে। সেভাবেই ছাপিয়ে বাজারের চাহিদার ভিত্তিতে ছাড়া হয়। এছাড়া প্রবাসীদের রেমিট্যান্স এলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ রেখে তার সমপরিমাণ টাকা ছাপায়। এর বাইরে সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ জোগান দিতেও নতুন নোট ছাপানো হয়।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘নতুন নোট আনার ক্ষেত্রে প্রধানত দুটি বিষয় বিবেচনা করা হয়। এগুলো হলো—পুড়িয়ে ফেলা ব্যবহার অযোগ্য নোট এবং অপরটি হলো বাজার সার্কুলেশন।’ তিনি বলেন, ‘বাজারের চাহিদা অনুযায়ী, নতুন নোট সরবরাহ করতে হয়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হয়, সেটি যেন বেশি হয়ে মূল্যস্ফীতির কারণ না হয়।’
মুদ্রানীতি ঘোষণার দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার উল্লেখ করেন, টাকা ছাপানো একটা চলমান প্রক্রিয়া। যত বড় অর্থনীতি, তত বেশি টাকা প্রয়োজন হয়। বিশ্বের সবখানে কিন্তু টাকা ছাপানো হয়। এটা খারাপ কিছু না। তবে দেখতে হবে সেই টাকা কোথায় যাচ্ছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে বাজারে তারল্য সংকট আছে এ জন্য।
টাঁকশালের ভল্টে কিছু দিন
টাকা ছাপানো শেষ হলে নোটগুলো টাঁকশালের ভল্টে রাখা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের প্রয়োজন মতো নতুন টাকার (পণ্যের) চাহিদা বা কার্যাদেশ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী—নোটের উৎপাদন ও সরবরাহ করে টাঁকশাল। একটি নোট ছাপাতে প্রায় ৩০টি পর্যায় পার করতে হয়। নোট উৎপাদন শেষ হলে টাঁকশালের ভল্টে রেখে এর পরিমাণ নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়।
টাঁকশাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে
নতুন টাকা তৈরির পর বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বিভিন্ন অফিসের প্রয়োজন মতো বিভিন্ন মূল্যমানের নোটের চাহিদা জানালে টাঁকশালের ভল্ট থেকে তা সরবরাহ করা হয়। এরপর এই নতুন নোট রাখা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট থেকে পরবর্তীকালে বিভিন্ন ব্যাংকের ভল্টে চলে যায় এবং ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের হাতে নগদ টাকা পৌঁছে যায়।
কীভাবে বাজারে আসে নতুন টাকা
সাধারণত, দেশের প্রত্যেকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের একটি নির্দিষ্ট শাখা (মেইন ব্র্যাঞ্চ) বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা নিতে পারে। অবশ্য ডাচ বাংলা ব্যাংকের তিনটি শাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা নিতে পারে। আর এভাবেই ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে মানুষের হাতে নতুন টাকা আসে। বাণিজ্যিক ব্যাংক ছাড়াও কখনও কখনও (দুই ঈদে) কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি সাধারণ মানুষের হাতে নতুন টাকা তুলে দেয়।
নতুন নোট কোন ব্যাংক কত পায়
নতুন নোট পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন ব্যাংক কত পাবে বা কত নিতে পারবে, এ ব্যাপারে কোনও নিয়ম নেই। কোনও নীতিমালাও নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, যেকোনও বাণিজ্যিক ব্যাংকের গ্রাহকের টাকার দরকার পড়লে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে তিনি টাকা তোলার জন্য চেক জমা দেন। তার অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা থাকা সাপেক্ষে সেই ব্যাংক চেকে উল্লিখিত টাকা তাকে দিয়ে দেয়। ঠিক একইভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার দরকার পড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে চেক জমা দেয়। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে টাকা থাকা সাপেক্ষে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে টাকা থাকা সাপেক্ষে ব্যাংকগুলোকে নগদ টাকা দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেকোনও ব্যাংক নগদ টাকার জন্য চেক দিলে এবং ভল্টে নতুন টাকা বেশি থাকলে, তারা নতুন টাকা বেশি পায়, আর ভল্টে নতুন টাকা কম থাকলে পুরোনো টাকা দেওয়া হয়। কখনও নতুন-পুরোনো মিক্সড দেওয়া হয়।’ তিনি উল্লেখ করেন, কোনও ব্যাংককে কত টাকার নতুন নোট দিতে হবে, এ ব্যাপারে কোনও নিয়ম বা নীতিমালা নেই। প্রতিদিনই ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডিপোজিট করে এবং প্রতিদিনই সকালে তাদের নগদ টাকার দরকার পড়ে। ফলে তারা পরিমাণ উল্লেখ করে চেক দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে থাকা টাকা তাদের সরবরাহ করা হয়। দেখা যায়, ভল্টে নতুন ও পুরোনো দুই ধরনের নোটই থাকে। তখন দুই ধরনের নোট দেওয়া হয়। ভল্টে নতুন বেশি থাকলে তারা বেশি পায়, নতুন নোট কম থাকলে কম পায়। দেখা যায়, কখনও কখনও ভল্টে পুরোনো নোট (রি-ইস্যু) থাকেই না। তখন পুরোটাই নতুন নোট দেওয়া হয়। তিনি জানান, সাধারণত সোনালী ব্যাংকসহ বড় ব্যাংকগুলো বেশি টাকার জন্য চেক দেয়। এ কারণে বড় ব্যাংকগুলো ছোটদের তুলনায় বেশি নতুন টাকা পায়। পরবর্তীকালে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তার অন্যান্য শাখায় নগদ টাকার প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহ করে।
বাড়ছে নতুন টাকা ছাপার পরিমাণ
জানা গেছে, ২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন করে টাকা ছাপানোর পরিমাণ ১৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়েছে, যা ২০২২ সালে ছিল ২৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এ বছর ৫১ হাজার কোটি টাকা বেশি ছাপানো হয়েছে।
জানা গেছে, সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় তিনভাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেওয়া মানেই টাকা ছাপানো বা রিজার্ভ মানি বৃদ্ধি। টাকা ধারের তিনটি উপায়ের একটি হচ্ছে—ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স। অন্য দুটির আনুষ্ঠানিক নাম হচ্ছে ওভার ড্রাফট ও ডিভলভমেন্ট। এরমধ্যে ডিভলভমেন্ট অংশের ঋণের পরিমাণটাই সরকারকে টাকা ছাপিয়ে দিতে হয়।
চলতি মাসের প্রথম ১৮ দিনে ‘ডিভলভমেন্ট’ ব্যবস্থার আওতায় সরকারকে ১ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স বাবদ সর্বোচ্চ সীমা ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া আছে সরকারের। আর ওভারড্রাফট বাবদ ঋণেরও সর্বোচ্চ সীমা ৮ হাজার কোটি টাকা। ১৮ জুলাই পর্যন্ত এ ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২১৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশের মুদ্রাবাজারে ছাপানো টাকার পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের মে মাসে এই মুদ্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৩ বছরে দেশের মুদ্রাবাজার বড় হয়েছে ৫ গুণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশের প্রচলিত মুদ্রার মধ্যে সরকারি নোট ও কয়েন ছিল ৫১৮ কোটি টাকার। চলতি বছরের মে মাসে সরকারি নোট ও কয়েন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৩ বছরের ব্যবধানে নোট ও কয়েন বেড়েছে ২৪৪ দশমিক ৪১ শতাংশ।
২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকে নোট ছিল ৪৯ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা। চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৩ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়িয়েছে ৪৫৭ শতাংশ। এছাড়া ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাজারে প্রচলিত মোট টাকা ছিল ৫০ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৩ বছরে মুদ্রা বাজারে টাকা যুক্ত হয়েছে ২ লাখ ২৯ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা বা ৪৫৫ শতাংশ।