ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ থাকবে না : আসিফ নজরুল

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ থাকবে না

গণঅভ্যুত্থানের পর এ এক নতুন বাংলাদেশ। ছাত্র-জনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে অপশাসনে ভেঙে পড়া সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। কী উপায়ে সংস্কার, কবেই বা নির্বাচন, এর রূপরেখাই বা কী– এসব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সঙ্গে কথা বলেছেন সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক ফারুক ওয়াসিফ

সমকাল: দুনিয়া কাঁপানো একটা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আপনি গেছেন। মানুষের মধ্যে বিপুল আশার জাগরণ ঘটেছে। রাজপথ থেকে আপনি এখন সরকারে। আপনার ভেতরে এসব কী প্রভাব ফেলছে?

আসিফ নজরুল: কোনো বুনো স্বপ্নেও ভাবিনি, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এত অল্প সময়ে এ রকম একটা ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন ঘটবে। পরিবর্তনের আশা ছিল। কিন্তু তা ফিকে হতে শুরু করে গত নির্বাচনের পরে। আমাদের তরুণরা আবার আশাবাদের জন্ম দিয়েছে। দেশটাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি এটা চিন্তা করি যে, তারা কীভাবে পারল! একটা পর্যায়ে তারা মৃত্যুভয়কে জয় করেছিল। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা না কিন্তু। অভিভাবক, সাধারণ মানুষ, কিশোর-কিশোরী, কলেজের ছাত্র– সবার মধ্যে দৃঢ় একটা প্রত্যয়ের জন্ম হয়েছিল যে, করেই ছাড়ব।

এই মরণপণ সংকল্পটা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের সঙ্গে তুলনীয়। যখন দেখলাম যে, ওরা মৃত্যুকে জয় করতে শিখেছে, তখন আমিও শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, যদি মৃত্যুও হয়, আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব। এত বড় একটা প্রত্যাশা; এত বড় একটা স্বপ্ন; এটাকে রূপায়িত করার কাজে আমি অংশ নিতে পেরেছি। এখানে ক্লান্তি মানায় না। পাশাপাশি ভাবি, আমি যেন কোনো বদনামের ভাগীদার না হই। যে স্বপ্ন, যে প্রত্যাশা ছিল, সেটা যেন কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারি। এখানে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নাই। কারণ, ছাত্র-জনতার বিপ্লব বা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ থাকবে না। হয়তো আমরা কাশ্মীরের কাছাকাছি কোনো স্ট্যাটাসে নেমে যাব।

সমকাল: সবাই তাকিয়ে আছে উপদেষ্টামণ্ডলীর দিকে। জনপ্রত্যাশার অসম্ভব চাপও আছে। আপনার মন্ত্রণালয়ে কাজের ক্ষেত্রে কি কোনো বাধা পাচ্ছেন? ভেতরে বা বাইরে সমন্বয়ের কোনো অভাব হচ্ছে?

আসিফ নজরুল: আমাদের অনেকের আসলে সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই। জাতীয় জীবনে এত বিপুল প্রত্যাশাও কোনো সরকারকে নিয়ে সৃষ্টি হয়নি। এগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটু সময় তো লাগবে। নতুন সরকার যে আইন করছে, যে পলিসি করছে, আমরা তার ভেটিংটা করে দিচ্ছি। আমাদের সরকার ক্ষমতায় আসার পর উচ্চ আদালতে যে পরিবর্তনটা হলো– সবাই থ্যাংকস জানিয়েছে যে, আমরা খুব ভালো প্রধান বিচারপতি পেয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য আমরা একজন অসাধারণ গভর্নর খুঁজে পেয়েছি। ভারসাম্য আনার জন্য অভিজ্ঞ মানুষদেরও নেওয়া হচ্ছে। সব কিশোর ও ছাত্রদের কারাগার থেকে বের করা গেছে। শুধু হত্যা মামলা ছাড়া বাকি প্রায় ৭০০ মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে।

সমকাল: জনপ্রশাসনে বড় রদবদল প্রত্যাশিত ছিল। আপনি কী মনে করেন?

আসিফ নজরুল: জনপ্রশাসনে আওয়ামী লীগ তিন-চার স্তর পর্যন্ত নিজেদের লোক বসিয়ে গেছে। এখন আপনি এমন লোক আনবেন, যিনি দলান্ধ না; যিনি কাজ ডেলিভার করতে পারেন। এ রকম লোক তো পাওয়াই মুশকিল। যারা ছিলেন তারা তো অবসরে চলে গেছেন। তারপর আছে জনপ্রত্যাশার চাপ। অন্তত ১৫ বছর মানুষ মুখ খুলে কথা বলতে পারনি। হঠাৎ তাদের সামনে সিংহদুয়ার খুলে গেছে। সবাই কথা বলা শুরু করেছে; সবাই দাবি করা শুরু করছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, ওরা খুব অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে। এসব জিনিস আমাদের কাজকে চ্যালেঞ্জিং করে তুলছে।

সমকাল: যারা সিন্ডিকেট করে অর্থনীতিকে জিম্মি করে রেখেছিল, তাদের বিষয়ে কি পদক্ষেপ নেওয়া হবে?

আসিফ নজরুল: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছেন। ঋণখেলাপিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ব্যাংকের দায় মেটানোর পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে। এসব হয়তো যথেষ্ট নয়। অর্থনৈতিক অপরাধের বিষয়ে মূলত মামলা করে দুদক। এখন কি দুদক বলে কিছু আছে? দুদক তো আগের সরকারের। দুদক পুনর্গঠন করতে হবে। পুনর্গঠিত দুদককে দিয়ে তদন্ত করাতে হবে। কেননা, এ ধরনের অপরাধ যারা করেন, তারা অনেক চালাক-চতুর। এখানে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, এনবিআর, দুদক এবং পুলিশের তদন্তের মধ্যে সমন্বয় লাগে। তাই বুঝেশুনে গভীর প্রস্তুতি নিয়ে মামলা করা হবে। ফলে এই ধরনের মামলাগুলো দুদক পুনর্গঠনের আগে করা যাচ্ছে না। আগে কি আদালত ব্যবস্থার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করব, নাকি দুদকেরটা করব? দুদক তো দ্বিতীয় অগ্রাধিকারের বিষয়।

সমকাল: অর্থনৈতিক অপরাধের বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে অপরাধীরা সমাজে টাকা-পয়সা ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে পারে। কিছু জিনিস তো অধ্যাদেশ জারি করে করা যেতে পারে।

আসিফ নজরুল: অধ্যাদেশ জারি করলেও তদন্তের কাজটা করবে কে? এখন যদি আমরা অধ্যাদেশ জারি করি যে, যারা অর্থনৈতিক অপরাধ করেছে, তাদের সম্পত্তি জব্দ করা হবে, অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হবে, দেখামাত্র গ্রেপ্তার করা হবে, এক মাসের মধ্যে বিচার করা হবে। তাহলে ইকোনমিক ব্যাকল্যাশ হবে। আবার অনেকে বলা শুরু করবে যে, দুর্নীতিবিরোধী আইনের চেয়েও এটা কড়া হয়ে গেছে। রাজনৈতিক সরকারের পেছনে রাজনৈতিক সমর্থন থাকে, সুশীল সমাজ থাকে, গণমাধ্যম থাকে। কিন্তু ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা ছাড়া আমাদের পেছনে তো আর কিছু নেই। সুতরাং, আমাদের একটু সময় লাগবে।

সমকাল: এমনিতেও বিএনপি বলেছে যে, সংস্কারের জন্য তারা সময় দিতে রাজি। আবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন যে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে না। সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপের বিষয়ে রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ আছে কিনা?

আসিফ নজরুল: যোগাযোগ হচ্ছে। তবে আমি মির্জা ফখরুলের সঙ্গে একমত যে, তা যথেষ্ট না। যথেষ্ট পরিমাণে সংলাপ করা প্রয়োজন। কিন্তু যথেষ্টটা করবে কখন? রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা মনে করি, আগামীতে দেশ পরিচালনায় যে সরকার আসবে, তার রূপরেখা এবং সংস্কারের স্থায়িত্ব রক্ষার জন্য অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ দরকার। তবে তার জন্য সময় শেষ হয়ে যায়নি।

সমকাল: রাজনৈতিক মামলার বিষয়ে প্রচলিত আইনের অনেক কিছুই ধরা যাবে না। এ বিষয়ে কি কোনো বিশেষ ট্রাইব্যুনালের চিন্তা আছে?

আসিফ নজরুল: আমরা এখন মূলত জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারে গুরুত্ব দিচ্ছি। ইতোমধ্যে সিআরপিসির অধীনে সাধারণ হত্যা মামলা হয়েছে। আবার ১৯৭৩ সালের আইনে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এসে জানতে চেয়েছেন, আমরা কী চিন্তা করছি। যদিও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে ঠিকমতো প্রসিকিউটর কিংবা বিচারক নেই। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনজন বিচারকের মধ্যে আছেন মাত্র একজন। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অনেকের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। অনেকের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রথমে আমাদের ভালো বিচারক নিয়োগ বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে বিচার করার চিন্তা অবশ্যই আমাদের আছে। কেননা, সাধারণ আদালতে কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি প্রমাণ করার সুযোগ নেই। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি প্রমাণ করা সম্ভব। তা করার আগে আইনটিকে মানবাধিকারবান্ধব করব। এদিকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলে বিদেশিরা অংশগ্রহণ করতে পারে না। আমি আমাদের আন্তর্জাতিক সহযোগী ও দাতাদের সঙ্গে আলাপ করেছি। তারা পর্যবেক্ষক হিসেবে যেন এখানে থাকতে পারেন, সে রকম ব্যবস্থা আমরা করব। অভিযুক্তরা যেন চাইলে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন, সেটাও দেখা হবে। আমরা ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন করা যায় কিনা, এটা  চিন্তা করব। আমাদের কাছের দেশ নেপাল ও শ্রীলঙ্কাতেও হয়েছে। শুধু তো বিচারের ব্যাপার না। সত্য উন্মোচনেরও একটা ব্যাপার আছে।

সমকাল: এ সরকারের কাছে নির্বাচন পর্যন্ত সংস্কারের একটা রোডম্যাপ প্রত্যাশিত?

আসিফ নজরুল: এ দেশের মানুষ নিশ্চয়ই ২০১৪, ২০১৮ কিংবা ২০২৪ সালের মতো নির্বাচন প্রত্যাশা করে না। নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয়করণ ও অনিয়ম করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে। নইলে লাভ কী? নির্বাচনের সঙ্গে শুধু নির্বাচন কমিশনই জড়িত থাকে না। এর সঙ্গে সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম এবং পর্যবেক্ষকরা জড়িত। ভোটার তালিকা নিয়ে নয়ছয় হয়েছে। আবার কারচুপি করে অন্য একটা দল নির্বাচিত হোক– তেমন পরিস্থিতি আমরা চাই না। ফলে নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি করতে সময় লাগবে। আমরা যারা সরকারে আছি, তারা সবাই নিজ নিজ পেশায় প্রতিষ্ঠিত। যত তাড়াতাড়ি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করে নিজেদের পেশায় ফিরে যেতে পারব, ততই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করব।

সমকাল: আওয়ামী লীগকে নিয়ে অনেকের বক্তব্য হচ্ছে, দলটিকে আগামীতে তিনটি নির্বাচন পর্যন্ত বিরত রাখা। কেউ কেউ নিষিদ্ধ করার কথা বলছেন। আবার আওয়ামী লীগের জনসমর্থন কিছুটা হলেও তো এ দেশে আছে। এই বিষয়টি কীভাবে মীমাংসা হবে?

আসিফ নজরুল: এটা আমাদের উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আমরা উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। দল নিষিদ্ধের তো প্রশ্নই আসে না। আইনগত দিক পরীক্ষা না করে নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ করাও আমার তো মনে হয় না সরকারের কেউ এটা পছন্দ করবে। একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দেখি না– দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে কতটা পছন্দ বা অপছন্দ করছে? আমার বিশ্বাস, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা হলে, প্রকৃত জনরায় তখন প্রতিষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগের বোধোদয় ঘটবে। তা একটা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দল হিসেবে তাদের যাত্রাকে অনুপ্রাণিত করবে। যে দলটা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল, সেই দল কেন গণহত্যা করেছে, কেন জনবিপ্লবে পতিত হয়েছে, সেটা আওয়ামী লীগকে তো বুঝতে হবে।

সমকাল: আপনি তো নদী আইন নিয়ে গবেষণা করেছেন। এবার আগাম সতর্কতা ছাড়াই ভারত বাঁধ খুলে দিয়েছে বলে বন্যা এত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সামনে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না– এরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ বিষয়ে আমাদের আইনগত ও রাজনৈতিক কোনো করণীয় আছে কিনা?

আসিফ নজরুল: আগাম না জানিয়ে জলাধার খুলে দেওয়া অবশ্যই অন্যায়। ভারতের উচিত ছিল অন্তত ৪৮ ঘণ্টা আগে জানানো। এর চেয়ে বড় অন্যায় হচ্ছে, ভারত এসব বাঁধ নির্মাণ করছে কেন? প্রায় প্রতিটি অভিন্ন নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে কৃত্রিম বাধা সৃষ্টি করছে ভারত। নদীর স্বাভাবিক গতিপথকে বন্ধ করে দিলে ভাটি অঞ্চলে নদীপথ সরু এবং অগভীর হয়ে যায়। সেই সরু পথের স্বাভাবিক পানি নেওয়ারই শক্তি নেই। যদি আমাদের জানিয়েও বাঁধ খুলত, এর পরও ভারত এই বন্যার জন্য আংশিকভাবে দায়ী থাকত। কারণ ভারত বাংলাদেশকে না জানিয়ে এ ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করবে কেন? অনেক আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে, কোনো দেশ তার প্রতিবেশী দেশের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। পরিবেশ আইনের বিভিন্ন চুক্তিতে এ ধরনের কাজের বাধা আছে। গঙ্গা চুক্তিও বলবৎ। সেখানেও এই কথা বলা আছে। এ দেশে যেমন উগ্র ভারত-বিরোধিতা আছে, আবার উগ্র ভারত-তোষণও আছে। নদী নিয়ে কথা বলা কিছু কিছু বিশেষজ্ঞের মাঝেও এই প্রবণতা দেখা যায়।

সমকাল: তড়িঘড়ি করে মামলা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে যে, আবারও সাজানো মামলা ফিরে আসছে? আদালত প্রাঙ্গণে অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়েও কথা উঠেছে; একজন সম্পাদক লিখেছেনও।

আসিফ নজরুল: আমি এসব মামলা নিয়ে সন্তুষ্ট না। কিন্তু একটা মানুষ; যার সন্তান মারা গেছে, তার যদি মনে হয় এলাকার এমপি এর জন্য দায়ী বা এই সাংবাদিকরা দায়ী; যারা দিনের পর দিন সরকারের পক্ষে কথা বলেছে। এই মনে হওয়া থেকেই তিনি মামলা করে দিলেন। সরকারের কোনো ক্ষমতা আছে তাঁকে থামানোর? আপনি কি বলতে পারবেন– তুমি মামলা করো না, করতে পারবে না। আমাদের কাজ নিশ্চিত করা যেন এটার নিয়মসংগতভাবে তদন্ত হয়, প্রক্রিয়া মেনে হয়। অহেতুক কেউ যাতে ভোগান্তিতে না পড়েন, তার জন্য যেন তদন্তপূর্বক মামলা গ্রহণ করা হয়। এই কাজটা আমরা করার চেষ্টা করছি।

আবার ধরেন, আমার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব না হলেও সমন্বয়ের জন্য পুলিশদের সঙ্গে মিটিং করেছি। আমরা বলেছি, এই যে লোকজন আসামিদের গায়ে হাত তুলছে, আপনারা কি শক্তভাবে বাধা দিতে পারেন না? তখন উনারা আমাকে ইনফরমালি বলেছেন, স্যার, পুলিশ তো এখন কাউকে মারবে না। পুলিশের নৈতিকতা এমনই ভেঙে গেছে যে, পুলিশ এখন কাউকে মারবে না। সারাজীবন আমরা মেরে লোক সরিয়েছি। এখন আমি আসামিদের গার্ড দিয়ে আটকাব কীভাবে? আমার ঘাড়ের ওপর উঠে মারে।

এখন আপনি বলেন, এটার কী সমাধান আছে? আমরা কিছু কিছু উপায় বের করার চেষ্টা করছি। যেমন ধরেন, শুনানিটা গভীর রাতে করা যায় নাকি বা বিকল্প স্থানে করা যায় নাকি। আমাদের পুলিশ এখন ব্রিটিশ পুলিশের চেয়েও নিরীহ ভূমিকা পালন করছে। তার পক্ষে এই উন্মত্ত জনতাকে ঠেকানো সম্ভব কিনা, তা অনেকে বুঝতে পারে না। যার সন্তান হারিয়েছে, চাকরি হারিয়েছে, জমি হারিয়েছে; যারা মিথ্যা মামলায় দিনের পর দিন জেলে থেকেছে, যার পরিবার গুম হয়েছে, সে খুব যৌক্তিক আচরণ করবে না। কিন্তু আমরা এই ঘটনাগুলো পছন্দ করছি না। সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। এটা একটা অদ্ভুত সময়। এমন সময় জাতির ইতিহাসে আর আসে নাই।

সমকাল: আপনি বলেছিলেন, নিম্ন আদালতের বিচারকদের সম্পদের হিসাব ১০ দিনের মধ্যে দেওয়ার কথা। সেটা তো এখনও আসেনি।

আসিফ নজরুল: নিম্ন আদালতের বিচারকদের সম্পদের হিসাব চাওয়ার ১০ দিনের মধ্যে সাত দিন পার হয়েছে। ইতোমধ্যে ৬০ ভাগের সম্পদের হিসাব পেয়েছি। আমরা অচিরেই সাব-রেজিস্ট্রারদের সম্পদের হিসাব চাইতে যাচ্ছি।

সমকাল: বিগত সরকারের সময়ে করা কালো আইন, যেমন ডিএসএ/সিএসএ কি বাতিল হবে? নিবর্তনমূলক আইন ও যেসব সংস্থার আইনি ভিত্তি নেই, সেগুলো বাতিল করার বিষয়টা কি ব্যাখ্যা করবেন?

আসিফ নজরুল: কালো আইন যেগুলো আছে, সেগুলোর আপত্তিকর সেকশনগুলো আমরা চিহ্নিত করছি। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সবচেয়ে নিন্দিত একটা আইন। আর্টিক্যাল নাইনটিনের পক্ষ থেকে আমি একটি গবেষণা করেছিলাম। এতে আমি বলেছিলাম, দুই ধরনের অফেন্স আছে। একটা হলো কম্পিউটার অফেন্স, আরেকটা হলো স্পিচ অফেন্স। স্পিচ অফেন্সটা বাদ দেওয়া কিংবা বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রাথমিক একটা চিন্তা আমাদের রয়েছে। তবে কম্পিউটারের মাধ্যমেও তো অপরাধ হয়। দেখা গেল, একটা মেয়েকে অনলাইনে নানা ধরনের হয়রানি করা হয়। তাহলে কি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? এখন যদি এই আইনকে বাদ না দিয়ে সংশোধনের উদ্যোগ নিই, তাহলে এক দল বলবে, আগের সরকারের মতো কথা বলছি আমি। কিন্তু আমি সরকারে আসার আগেও এই কথা বলেছি। আমার সব লেখায় এই আইন পরিবর্তনের কথা বলা আছে। কম্পিউটার অফেন্স একেবারে বাদ দেওয়া যাবে না। তাহলে সাইবার অপরাধগুলোকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। দুর্নীতি দমন আইনে কী কী পরিবর্তন করা দরকার, তা জানাতে আমি ইতোমধ্যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছি। বদিউল আলম মজুমদারকে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার অনুরোধ করেছি। এভাবে আরও কয়েকজনের সঙ্গে বসব। তাদের পরামর্শগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসব। ডিসেম্বরের মধ্যেই কালো আইনগুলোর বড় ধরনের সংস্কার করা হবে। আমরা এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ-পরামর্শেও বসব।

samakal