ছাত্রজনতার আন্দোলনে শহীদ ও আহত ৯৭ শতাংশই সহায়তা পাননি

জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় সরকারের পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা করে সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য তৈরি করা হয় ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’। কিন্তু যাত্রার দুই মাস হলেও এখন পর্যন্ত খুব কমসংখ্যক আহত রোগী ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা পেয়েছেন। ফলে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অন্যান্য খরচের বোঝা টানতে চরম হিমশিম খেতে হচ্ছে অসংখ্য পরিবারকে। বিশেষ করে যারা পরিবারের দায়িত্ব রয়েছেনÑ এমন আহত ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন।

আহত ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের বড় অংশের অভিযোগ, সরকার থেকে ঠিকমতো চিকিৎসা দিতে পারছে না। তিন মাস ধরে হাসপাতালে থাকলেও সরকার তাদের খোঁজখবর নেয়নি। সেই সঙ্গে আর্থিক সহায়তা হিসেবে ১ লাখ টাকা করে পাওয়ার কথা থাকলেও সেটি তারা পাননি। ফলে চিকিৎসা বিনামূল্যে পাওয়া গেলেও হাসপাতালে থাকায় অন্যান্য খরচ টানতে গিয়ে চরম হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।

মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে এর বাস্তবতা পাওয়া গেছে। প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩০০ জনকে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে হয়েছে উল্টো চিত্র। ৯৭ শতাংশ আহত ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী এখনও সহায়তার বাইরে।

আহতদের বড় একটি অংশ চিকিৎসা নিচ্ছে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর)। এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের এক-চতুর্থাংশ এখনও সহায়তার অর্থ পাননি। হাসপাতালটির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ৮৩ জন আহত রোগী চিকিৎসাধীন প্রায় তিন মাস ধরে। তাদের মধ্যে ৬৩ জনকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। বাকিরা এখনও পাননি।

এ হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করে সংসার চালানো এমিলি (৩৯)। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে বড় তিনি। রাজধানীর শনির আখড়ার এই বাসিন্দা গত ৪ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক দফার আন্দোলনে অংশ নিয়ে যাত্রাবাড়ীতে

পুলিশের গুলিতে মারাত্মক আহত হন। শুরুতে বেসরকারি হাসপাতালে পরে নিটোরে ভর্তি করা হয়। দুই মাস ধরে বর্তমানে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি।

গতকাল বৃহস্পতিবার নিটোরে কথা হয় এমিলির সঙ্গে। সহায়তা পাওয়ার কথা জানতে চাইলে আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘আট সদস্যের পরিবার। বোন একটা নার্সিংয়ে পড়ে। আমার আলাদা পরিবারও রয়েছে। ফুটপাতে টং দোকানে কাপড় বিক্রি করে চলতাম। কিন্তু দুই মাস ধরে হাসপাতালে ভর্তি। সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যের নিয়ে চরম কষ্টে দিন কাটছে। হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছে; কিন্তু তা আসলে যথেষ্ট নয়। এখানে চিকিৎসাধীন অনেকেই ১ লাখ টাকা করে পেয়েছেন। আমি এখনও পাইনি। শুধু আর্থিক সহায়তা নয়, দরকার মাসিক ভাতা ও পুনর্বাসন।’

সহায়তা পাননি শিক্ষার্থী মসফিকুর রহমানও। গত ৪ আগস্ট বগুড়া সাত মাথায় পুলিশের গুলিতে আহত হন বগুড়া আজিজুল হক কলেজের সদ্য মাস্টার্স শেষ করা এই শিক্ষার্থী। তার শরীরের পেট, উরু এবং এমন কী অ-কোষ পর্যন্ত ছররা গুলি প্রবেশ করে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন মসফিকুর সুস্থভাবে বাঁচাতে হলে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হবে। এমনকি দেশের বাইরে নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

গতকাল মুঠোফোনে কথা হয় মসফিকুরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাইনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ও ব্যক্তি উদ্যোগে চিকিৎসা নিয়েছি। সহায়তা পেতে হলে আবেদন করতে হয়, এখনও করিনি।’

হতাহত ২০ হাজার, সহায়তা পেয়েছে ৬৪২ জন : জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গণ-অভ্যুত্থানে ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত ও ৭ শতাধিক মানুষ শহীদ হয়েছেন। ঘোষণা অনুযায়ী আহতরা ১ লাখ এবং শহীদ পরিবার ৫ লাখ টাকা করে পাওয়ার কথা। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত আহত ও শহীদের মধ্যে মাত্র ৬৪২ জনকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী সহায়তা পেয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ, ৯৭ শতাংশই সহায়তার বাইরে।

অথচ গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিল থেকে ১০০ কোটি টাকা গ্রহণের মাধ্যমে ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু হলে বলা হয়েছিল, প্রতি সপ্তাহে ৩০০ জনকে সহায়তা দেওয়া হবে। সে অনুযায়ী এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার মানুষ সহায়তা পাওয়ার কথা।

গত বুধবার নিটোর এবং জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম পরিদর্শনে গেলে সহায়তা না পাওয়া ও ঠিকমতো চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ করেন ভর্তি রোগীরা। চতুর্থ তলায় রোগী দেখে বের হলেও তৃতীয় তলায় না যাওয়ায় ক্ষুব্ধ হোন রোগীরা। একপর্যায়ে তার গাড়ি আটকে দেন তারা। এমনকি উপদেষ্টার গাড়ির ওপর ওঠে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। পরে দুপুর ১টা থেকে রাত আড়াইটা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৩ ঘণ্টা হাসপাতাল থেকে বিছানাপত্র এনে সড়কে অবস্থান নেন তারা।

পরে রাতে উপদেষ্টা মাহফুজ, আসিফ নজরুলসহ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা উপস্থিত হন। আহতদের দাবি অনুযায়ী দ্রুত সহায়তা প্রদানসহ অন্যান্য দাবি পূরণের আশ^াস দেন তারা।

গতকাল নিটোরে রোগীদের খোঁজখবর নিতে আসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মেডিক্যাল টিমের সদস্য নাদিয়া। তিনি বলেন, ‘দুঃখজনক ব্যাপার হলেও সত্য আহতদের চিকিৎসায় কিছুটা অবহেলা আমাদের চোখে পড়েছে। মূল সমন্বয়কদের আমরা বলেছি আহতদের সহায়তায় জনবল বাড়ানো দরকার। চিকিৎসায় বিনামূল্যে পাওয়া গেলেও এখানে ট্রলি পেতে, ড্রেসিং করাতে গিয়ে অনেক সময় টাকা দিতে হয়। এসব অনিয়মের কারণে রোগীদের খরচ বাড়ছে।’

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পরও কেউ যদি মনে করে তার চিকিৎসা এখনও সম্পন্ন হয়নি, তিনি হাসপাতাল থেকে কিংবা সরাসরি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আহত কেউ আর্থিক সমস্যায় ভুগছে কিনা খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। সবার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা চলছে।

তবে এককালীন এই সহায়তাই শেষ নয় বলে জানান তিনি। স্নিগ্ধ বলেন, ‘তাদের যেকোনো ধরনের সহায়তার প্রয়োজন হলে ফাউন্ডেশন পাশে থাকবে। একটি ফর্ম ছাড়া হয়েছে, ইমেইল কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সেটি জমা দিলেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে এমন কিছু কেস রয়েছে যাদের ১ লাখ টাকায় হয় না, তাদের ১২ লাখ টাকা সহায়তাও দেওয়া হয়েছে।’

ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী বলেন, ‘আপাতত আমাদের মূল লক্ষ্য আহত ও শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা। সে অনুযায়ী আহত ও শহীদদের পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য যদি ভাতা সিস্টেম চালু করার প্রয়োজন হয়, সেটা করা হবে। সমস্যা হলো আমরা এখনও জানি না আহতদের মধ্যে কতজন মারাত্মক অবস্থায় রয়েছেন। এগুলোর সঠিক তথ্য পেলেই তাদের পুনর্বাসনে ঠিক কী পরিমাণ আর্থিক সহায়তা দরকার, সেটি নির্ধারণ করা যাবে।’

আহতদের চিকিৎসায় স্বতন্ত্র পরিচয়পত্র : এদিকে গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় প্রত্যেককে ইউনিক আইডি বা স্বতন্ত্র পরিচয়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ওই আইডি দেখিয়ে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়া যাবে। এ ছাড়া যেসব বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে সরকারের চুক্তি থাকবে, সেখানেও বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবেন তারা।

গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের সঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সরকারের ছয়জন উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার একজন বিশেষ সহকারীর সঙ্গে বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়।

বৈঠক শেষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্বাহীর দায়িত্ব পাওয়া প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে লিখিত রূপরেখা দেওয়া হবে। আহতদের চিকিৎসায় সব সরকারি হাসপাতালে বেড ডেডিকেটেড থাকবে। ঢাকার সব হাসপাতালকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে।

amader shomoy

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here