আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬ আসনে ছাড় পেলেও ভরাডুবি হয়েছে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির। ছাড়ের আসনে নৌকার প্রার্থী না থাকলেও ১৫টিতে স্বতন্ত্রদের বিরুদ্ধে হেরেছে লাঙ্গল। জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরসহ অন্তত চারজনের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে সমঝোতার আসনে। ছাড়ের আসনের ১১টি বাদে আর কোথাও জিততে পারেনি লাঙ্গল। নৌকার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ২৩৩ আসনের অধিকাংশে জামানত হারিয়েছেন লাঙ্গলের প্রার্থীরা। জি এম কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে কোরবানি দেওয়া হয়েছে।’
সমঝোতার ১৫টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে পরাজিত হয়েছে লাঙ্গল। ফলে আগামী সংসদে আর দ্বিতীয় বৃহত্তম দল থাকছে না জাপা। লাঙ্গলের চেয়ে স্বতন্ত্রের এমপি বেশি হবে দ্বাদশ সংসদে। ফলে জাপা ফের বিরোধী দল হতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অবশ্য নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু প্রতিদিনই দাবি করতেন, আওয়ামী লীগকে হারিয়ে সরকার গঠন করবে তাঁর দল।
বিএনপিবিহীন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ৩৪ আসন পেয়ে প্রথমবারের মতো প্রধান বিরোধী দল হয়েছিল জাপা। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে বিএনপির প্রায় চার গুণ ২২ আসন পেয়ে ফের বিরোধী দল হয় দলটি। এবারও বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে জাপা।
প্রতিষ্ঠার বছরে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ১৫৩ আসন পায় ক্ষমতাসীন জাপা। ১৯৮৮ সালে বিরোধী দলের বর্জনের নির্বাচনে ২৫৩ আসন পায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের লাঙ্গল। তিনি গণআন্দোলনে ক্ষমতা ছাড়ার পর ১৯৯১ সালে ৩৫ আসন পায় জাপা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে ২০০৮ সালের নির্বাচনে পায় ২৭ আসন।
এবারের নির্বাচনে জাপা তার ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে। এবার আওয়ামী লীগের কাছে ৫০ আসনে ছাড় চেয়েছিলেন জি এম কাদের। শর্ত দিয়েছিলেন, তাঁকে বিরোধীদলীয় নেতা এবং জাতীয় পার্টিকে সম্মানজনক সংখ্যক আসন দিয়ে ফের প্রধান বিরোধী দল বানাতে হবে।
বিএনপি বর্জন করায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে আওয়ামী লীগ দলের মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহ দেয়। জয়ের নিশ্চয়তায় জাপা চেয়েছিল তাদের ছেড়ে দেওয়া আসনে নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করতে হবে, ভোটে থাকতে পারবেন না আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র নেতারাও। নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করলেও স্বতন্ত্র সরাতে রাজি হয়নি আওয়ামী লীগ।
গত ডিসেম্বরে চার দফা গোপনীয়তার সঙ্গে বৈঠকের পর জাপাকে ২৬ আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। তবে এর ২১টিতে ছিলেন আওয়ামী লীগ ও জাপার মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাই আগেই ধারণা ছিল, এতে জাপার ভরাডুবি হতে পারে। গতকাল বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধারণা সত্য হতে থাকে।
আওয়ামী লীগ ঢাকায় শরিকদের জন্য আসন ছাড়তে রাজি ছিল না। স্ত্রীর জন্য আসন না ছাড়লে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন জি এম কাদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন জাপা নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে। শেরিফা কাদেরের জন্য আওয়ামী লীগ ঢাকা-১৮ আসন ছেড়ে দিলে ১৭ ডিসেম্বর শেষ সময়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের চূড়ান্ত ঘোষণা দেয় জাপা। সাংগঠনিক শক্তি না থাকায় ভোটের প্রচারে পিছিয়ে ছিল লাঙ্গল। গতকাল ভোটের দিনেও তা দেখা গেছে। মাত্র ৬ হাজার ৫৫৫ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়ে জামানত হারিয়েছেন শেরিফা কাদের। নৌকাবঞ্চিত কেটলি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ৬৯ হাজার ৮৩১ এবং ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম তোফাজ্জল পেয়েছেন ৩৭ হাজার ৭৫৯ ভোট।
এ ছাড়া নীলফামারী-৪, পিরোজরপুর-৩ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে লাঙ্গলের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ঠাকুরগাঁও-৩-এ হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, রংপুর-৩ আসনে জি এম কাদের, কুড়িগ্রাম-১ আসনে এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান, বগুড়া-২-এ শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, সাতক্ষীরা-২ আসনে আশরাফুজ্জামান আশু, পটুয়াখালী-১ আসনে এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, বরিশাল-৩ আসনে গোলাম কিবরিয়া টিপু, কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে মুজিবুল হক চুন্নু, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে এ কে এম সেলিম ওসমান, ফেনী-৩ আসনে লেফট্যানেন্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম-৫ আসনে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জয়ী হয়েছেন।
নীলফামারী-৪ আসনে নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থী জেলা জাপার সহসভাপতি সিদ্দিকুল আলম সিদ্দিকের বিরুদ্ধে হেরে গেছেন জি এম কাদেরের ভাগনে আহসান আদেদুল রহমান। তিনি তৃতীয় হয়েছেন। নীলফামারী-৩, কুড়িগ্রাম-২, গাইবান্ধা-১, গাইবান্ধা-২, বগুড়া-৩, পিরোজপুর-৩, ময়মনসিংহ-৫, ময়মনসিংহ-৮, মানিকগঞ্জ-১, ঢাকা-১৮, হবিগঞ্জ-১, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ এবং চট্টগ্রাম-৮ আসনে নৌকা প্রার্থী না থাকলেও বিশাল ব্যবধানে হেরেছেন জাপার প্রার্থীরা। তারা আদৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই আসতে পারেননি।
সমকাল