- গোলাম মাওলা রনি
- ০১ এপ্রিল ২০২১
২০২১ সালের ২৮ মার্চ নানা কারণে বাংলাদেশের একটি অনন্য দিবস হিসেবে ইতিহাসে লিখিত থাকবে। কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক অরাজনৈতিক সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলাম’ গত কয়েক মাস ধরে যেভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে তা বর্তমানকালের কোনো বৃহত্তম রাজনৈতিক দল কল্পনাও করতে পারে না। তারা এর আগে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরুদ্ধে যেভাবে মাঠ গরম করে ফেলেছিল, তেমনভাবে গত কয়েক বছরে রাজনীতির জনপ্রিয় কোনো ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম করার এ নজির নেই এ দেশে। একইভাবে ফ্রান্সের জনৈক কার্টুনিস্ট কর্তৃক আল্লাহর রাসূল সা:-এর একটি ব্যঙ্গচিত্রকে কেন্দ্র করে মুসলিম দুনিয়া উত্তাল হয়ে পড়লে হেফাজতও ঢাকার রাজপথে সমাবেশ করে। তাদের এই সমাবেশে এত বেশি মানুষের সমাগত ঘটে যে, দেশের সব মহল আশ্চর্য হয়ে যায়। অনেকে বলার চেষ্টা করেন, হেফাজতের ঐতিহাসিক শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশের চেয়েও বেশি লোকের সমাগম হয়েছিল মহানবী সা:-এর অবমাননার বিরুদ্ধে আহূত এ সমাবেশে।
আওয়ামী লীগের বর্তমান সময়টি তাদের জন্য একটি তন্দ্রাময় মহাকাল। এটিকে কোনোমতেই তেলঝোলের সুখনিদ্রা অথবা বিপদসঙ্কুল দুঃস্বপ্নের রজনী বলা যাবে না। এটিকে তন্দ্রাময় সময় বলা হয় এ কারণে যে, তন্দ্রা এবং তন্দ্রাজাত যেসব রসায়ন রয়েছে তার সবই এখন আওয়ামী লীগের জন্য প্রযোজ্য। তন্দ্রার সময় মানুষ একবার ডান দিকে হেলে যায় তো আবার বাম দিকে। তন্দ্রাগ্রস্ত মানুষ কখনো নাক মুখ বন্ধ করে সামনের দিকে ঝুঁকে; আবার পরক্ষণে নাক মুখে ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনের দিকে ঢলে পড়ে। তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে এবং তাদের আশপাশের লোকজনের সামনে মুহূর্তের জন্য তন্দ্রামুক্ত ভয়ে এমন একটা ভাব দেখায় যে, তাদের কোনো তন্দ্রা আসেনি, এমনিতেই ভাব দেখানোর জন্য তারা তন্দ্রাবস্থায় ছিল। তারপর একটু মুচকি হাসি দিয়ে পুনরায় তারা কিভাবে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তা আমরা কমবেশি সবাই জানি।
হেফাজত নেতারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি টুঁ শব্দও করেননি। এমনকি করোনাকালে সমগ্র বাংলাদেশে যখন ভয়াবহ অর্থসঙ্কট চলছে, কর্মসংস্থান মারাত্মকভাবে কমে গেছে এবং করোনার প্রকোপে মানুষের জীবনে ত্রাহি ত্রাহি ভাব সৃষ্টি হয়েছে, সেই সময়ে শত শত কোটি টাকা খরচ করে আতশবাজি, নৃত্যগীত ইত্যাদির আয়োজনের বিরুদ্ধেও কোনো কথা তারা বলেনি। তারা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সাথে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের সম্মিলন ও জাঁকজমক নিয়েও টুঁ শব্দটি করেনি। তারা বরং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী যেন আরো সুন্দর এবং আনন্দঘন পরিবেশে হয় সে জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী আগমনের বিরোধিতা করেছে। তাদের বক্তব্য হলো, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তো কোনো বিতর্ক নেই। তার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানেরও কেউ বিরোধিতা করছে না। সরকার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান যাকে ইচ্ছে তাকে দাওয়াত দিয়ে আনতে পারত। কিন্তু একজন বিতর্কিত ব্যক্তি যিনি স্মরণকালের জঘন্যতম হিন্দু জঙ্গি হিসেবে দুনিয়া কর্তৃক নিন্দিত এবং এ ধারণাই করা হয়, তার রাজনৈতিক জীবনে তিনি যত মুসলমানকে হত্যা করেছেন, যত মসজিদ ভেঙেছেন এবং নিরীহ মুসলমানদের নির্যাতন করেছেন তা গত এক শ’ বছরে দুনিয়ার কোথাও অন্য কেউ করেনি।
নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে হেফাজত নেতাদের আরো অভিযোগ ছিল, তিনিই বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যার মূল হোতা। এ ছাড়া তিনি আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৪০ লাখ মুসলমানকে জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের মতো করে বাংলাদেশে ঢুকানোর জন্য একটি আইন ভারতীয় পার্লামেন্টে পাস করিয়ে নিয়েছেন, যা এনআরসি অ্যাক্ট নামে এরই মধ্যে সর্বমহলে নিন্দিত হয়েছে। তিনি দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ এবং কাশ্মিরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যা করেছেন তা আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। তার আমলে সীমান্তে মানুষ হত্যা জঘন্যতম পর্যায়ে পৌঁছেছে। তিনি বাংলাদেশ সরকারকে চাপে ফেলে ট্রানজিট, ব্যবসাবাণিজ্য ইত্যাদি আদায় করে নিয়েছেন। বিনিময়ে বাংলাদেশের একটি ন্যায্য পাওনাও দেননি। অধিকন্তু তিনি তার নিজ দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেসব কথা বলেন, তা রীতিমতো অবমাননাকর। সুতরাং মোদির বাংলাদেশ সফর হেফাজতে ইসলাম সমর্থন করে না।
২৬ মার্চ ২০২১ সালের আগের দিনগুলোতে হেফাজত নেতারা যে ভাষায় কথা বলছিলেন, তা সরকারের জন্য বিপত্তিকর ছিল না। সরকারের পক্ষ থেকে যদি দায়িত্ববান কেউ তাদের সাথে গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী কোনো আলোচনা করতেন তবে ২৬ মার্চ কিংবা তৎপরবর্তী দিনগুলোতে কোনো অনাহূত ঘটনা ঘটত না। কিন্তু সরকারের একগুঁয়েমি, দাম্ভিকতা এবং কাউকে পাত্তা না দেয়ার প্রবণতার ফলে মোদির আগমনের দিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ, শুক্রবার হেফাজত নেতারা বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে বাদ জুমা একটি পথসভার আয়োজন করেন এবং মোদির কুশপুত্তলিকায় জুতা নিক্ষেপ, থুথু ছিটানোসহ মোদি বিরুদ্ধের বক্তব্য দিতে থাকেন।
অবস্থায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশ বাহিনী এবং তাদের সাহায্যকারী ‘হেলমেট বাহিনী’র মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। ফলে তারা লাঠি, বাঁশি, টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেটের সাহায্য নিয়ে মোদির কুশপুত্তলিকায় জুতার আক্রমণ ঠেকাতে বীরদর্পে এগিয়ে যায়। অন্য দিকে হেফাজতের কর্মীরাও ইটপাটকেল দ্বারা জবাব দিতে গিয়ে পুরো এলাকাকে রণক্ষেত্রে পরিণত করে ফেলে। এ ঘটনার প্রতিবাদে ২৭ মার্চ হেফাজত সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয় এবং পুলিশের গুলিতে চট্টগ্রামের হাটহাজারী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে মোট পাঁচজন নিহত হন। এই দুঃখজনক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ২৮ মার্চ সারা দেশে সর্বাত্মক হরতাল আহ্বান করা হয়। ২৮ মার্চের হরতালে কী হয়েছে এবং কতজন হতাহত হয়েছে, তা দেশবাসী কমবেশি জানেন। কিন্তু এই হরতালের কারণে সরকারের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তা হয়তো অনেকেই খেয়াল করেননি। প্রথমত সরকার ভীষণ ভয় পেয়েছে। তারা ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে ফেসবুক ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন এবং কালবিলম্ব না করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিজিবি নামিয়ে দেন। তারা সন্দেহ করতে থাকেন যে, হেফাজতের হরতালের সাথে বিএনপি-জামায়াতের গোপন যোগসাজশ রয়েছে। ফলে হরতাল প্রলম্বিত হতে পারে এবং তা শেষ অবধি মোদি বিরোধিতায় সীমাবদ্ধ না থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিতে পারে- এই আতঙ্কে সরকার দোল খেতে আরম্ভ করে। আওয়ামী লীগ যেহেতু একটি পোড় খাওয়া রাজনৈতিক দল এবং তাদের রাজনৈতিক জীবনে তিন তিনটি গণ-অভ্যুত্থান এবং একটি সামরিক অভ্যুত্থানের সুবিধাভোগী সেহেতু তারা খুব ভালো করে জানেন, গণ-অভ্যুত্থান কখন, কিভাবে এবং কেনো সংঘটিত হয়। তারা এ কথাও খুব ভালো করে জানেন যে, গণ-অভ্যুত্থানের ক্ষয়ক্ষতি কত ভয়াবহ হয়ে থাকে। সুতরাং নিজেদের অতীত কর্ম, বর্তমান অবস্থান, জনগণের মানসিকতা, রাজনীতির ভারসাম্যহীনতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বীহীন রাজপথ যে কী পরিণতি বয়ে আনে তা তারা মুখস্থ বলে দিতে পারেন আইয়ুব খান, খন্দকার মোশতাক, এরশাদ এবং মইনউদ্দিনের সামরিক শাসন জারি এবং সেই শাসনের অধীন দমন পীড়নের ফলে সৃষ্ট ঘায়ের ক্ষতচিহ্নগুলোকে স্মরণ করার মাধ্যমে। ফলে ২৮ মার্চ বাংলাদেশের রাজপথ যেভাবে উত্তাল ছিল এবং যেভাবে রক্তাক্ত হয়েছে তা যে খুব সহজে মিটে যাবে না এটা আওয়ামী লীগ খুব ভালো করেই জানে।
এবার ২৮ মার্চের হরতাল প্রসঙ্গে আসি। হরতাল আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, মানুষের মনে কী পরিমাণ বেদনা জমা হয়েছে। ফলে হেফাজতের মতো একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের ডাকা হরতালে সারা দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয়ত, সরকারের পুলিশ, হেলমেট বাহিনী, দলীয় নেতাকর্মী এবং সমর্থকরা সারা দেশের কোথাও হরতালকারীদেরকে প্রতিরোধ করার ঝুঁকি নেয়নি কিংবা তাদের প্রতিরোধ করার নৈতিক সাহস হারিয়ে ফেলেছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য রবিউল মুক্তাদির চৌধুরী যিনি একসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন, তিনি প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। তার মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সব কিছু ঘটেছে।
জনাব মুক্তাদির আরো বলেন, হরতালের সুযোগ নিয়ে যারা ভূমি অফিসে আগুন দিয়েছে তারা স্থানীয় ভূমিদস্যু বা ভূমিসংক্রান্ত জাল জালিয়াতির হোতা : যারা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে, তারা এই কাজ কোনো দিন করতে সাহস পেত না যদি পুলিশ সক্রিয় থাকত। এই বক্তব্যের সাথে তাল মিলিয়ে আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী নেতা এবং সাহসী বলে স্বীকৃত কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতা আত্মসমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধার কারণে দলীয় নেতাকর্মীদের দলপ্রীতি বা দলের জন্য মায়া মমতা কমে গেছে। তারা দলের চেয়ে নিজেদের ধন সম্পদকেই বেশি ভালোবাসে। ফলে হেফাজতের হরতালের বিরুদ্ধে কেউ রাস্তায় নামেনি।
তারা আরো বলেন যে, সর্বক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর নির্ভরতার কারণে দলীয় নেতাকর্মীদের শক্তিমত্তা, সাহস, সাংগঠনিক ক্ষমতা ইত্যাদি মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে পুলিশের ছত্রছায়া ব্যতিরেকে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করার কথা এখন কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী কল্পনাও করতে পারেন না।
২৮ মার্চের হরতালে বেশ কয়েকটি স্থানে প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ভাঙচুর হয়েছে। কোথাও বা সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তা করার আগে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগকারীরা উল্লাস করতে করতে প্রতিকৃতিগুলোর যে অবমাননা করেছে তা দেখে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে অনেকে মন্তব্য করেছেন, আলজাজিরায় প্রধানমন্ত্রীর মেন শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সারা দেশে আই অ্যাম বা উই আর প্রাইম মিনিস্টারস মেন ইত্যাদি গেঞ্জি, টুপিতে লিখে যারা রাস্তায় নেমে এসেছিল তারা হরতালের সময় কই গিয়েছিল? তারা যদি হরতালকারীদের বাধা দিত এবং সেটি সম্ভব না হলে অন্তত যদি অনুনয় বিনয় করে বঙ্গবন্ধুর মর্যাদার বিষয়টি হরতালকারীদের কাছে পেশ করত, তাহলে হয়তো যে অস্বস্তিকর দৃশ্যগুলো দেখতে হচ্ছে তা কিছুটা হলেও কম হতো।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য