চুরমার ফিলিস্তিন, ম্যাকডোনাল্ডসের যুদ্ধসেবা ও খাদ্য রাজনীতি

পাভেল পার্থ : ইউক্রেন-রাশিয়ার পাতানো যুদ্ধ দেখে ক্লান্ত, বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ বিশ্বের সামনে এখন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন আবারও আলোচনার বিষয়। গাজা উপত্যকার চুরমার স্তূপের দিকে দম বন্ধ করে তাকিয়ে আছে বিশ্ব– যদি কোনো জানের আওয়াজ পাওয়াজ যায়! এমন এক দগ্ধবিধ্বস্ত সময়ে খবরে প্রকাশ, ইসরায়েলের সেনাদের বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করে তোপের মুখে পড়েছে মার্কিন ফুডচেইন ম্যাকডোনাল্ডস। অবরুদ্ধ অভুক্ত ফিলিস্তিনের এই রক্তাক্ত সময়ে ইসরায়েলের ‘যুদ্ধবাজ’ সেনাদের বিনামূল্যে খাবার দিয়ে ম্যাকডোনাল্ডস মূলত কী বার্তা দিতে চায়?

মার্কিন-ইসরায়েল সন্ধি কিংবা ফিলিস্তিনের ওপর যুদ্ধ-বাহাদুরির বৈধতা হিসেবে শুধু একে পাঠ করা যায় না। এই বার্তা মহামারি-উত্তর এই দুনিয়ায় আরও ভয়াবহ ভবিষ্যৎ জিজ্ঞাসা সামনে আনে। কার কবজায় মূলত বন্দি হতে চলেছে আমাদের খাদ্যব্যবস্থার ভবিষ্যৎ? যুদ্ধ, দাঙ্গা, সহিংসতা, অস্থিরতা বা পাতানো সন্ধি; সবই নিয়ন্ত্রিত হতে পারে ‘খাদ্যব্যবস্থা’ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। হঠাৎ কোনো একটি ঘটনায় কিছু সময় কিছু মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ করে। বিশ্বব্যাপী এই প্রতিরোধ জোরালো নয়। তাই খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বণ্টন, বিপণন, সরবরাহ, পরিবেশন কোনো কিছুই আজ মানুষের নাগালে নেই; কোম্পানির কাছে বন্দি। সিদ্ধান্ত, পুঁজি, মুনাফা– সব কোম্পানির। কৃষক, জেলে, সংগ্রহকারী বা প্রক্রিয়াজাতকারী সবাই নয়া-উদারতাবাদী ব্যবস্থার ‘খাদ্য-মজুর’। নয়া-উদারতাবাদী খাদ্যব্যবস্থাকে রাজনৈতিকভাবে প্রশ্ন করছে না রাষ্ট্র কিংবা রাজনৈতিক মঞ্চগুলো। খাদ্য কিংবা খাদ্যরুচি আজ নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে ম্যাকডোনাল্ডস, কোক-পেপসি, নেসলে, মুভেনপিক, কেএফসি, পিৎজাহাট কিংবা ডানোন কোম্পানির বাহাদুরিতে।

ইসরায়েলে ম্যাকডোনাল্ডসের সাম্প্রতিক ‘বর্ণবাদী’ প্রবণতা কিন্তু এই প্রথম নয়। এ ঘটনাকে আলাপের ময়দানে রেখে আমাদের খাদ্যচিন্তার রাজনৈতিক ভিত তাহলে কী হতে পারে? আমরা কি আদতেই ফিলিস্তিনের ওপর জারি থাকা নির্মম অন্যায়ের বিরুদ্ধে? ম্যাকডোনাল্ডসের সাম্প্রতিক এই বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে আমাদের অবস্থান তাহলে কী হবে? আমরা কি ম্যাকডোনাল্ডসকে বয়কট করব, খারিজ করব? এতেই কি খাদ্যব্যবস্থার মুক্তি ঘটবে? খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হবে? আমরা কি ম্যাকডোনাল্ডসগিরি থেকে আমাদের খাদ্যচিন্তাকে মুক্ত করতে পেরেছি? আমরা কি কোকা-কোলায়নের গরাদ থেকে আমাদের খাদ্যরুচিকে মুক্ত করতে পেরেছি? পারিনি। এসব কোম্পানি কেবল আমাদের রুচির রূপান্তরই ঘটায় না; সামগ্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়া ও সামাজিক শ্রেণিকেও প্রভাবিত করে। তাই কিছু সময়ের জন্য খারিজ বা বাতিল করায় জনগণের খাদ্য সার্বভৌমত্বের সুরাহা হয় না। আমাদের খাদ্যচিন্তার রাজনৈতিক দর্শন ও তৎপরতাকে স্পষ্ট করতে হবে।

কোক-পেপসির প্লাস্টিক দূষণ বিষয়ে আমরা জানি। এমনকি জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি হিসেবে প্রমাণিত হলেও দুনিয়া কোকা-কোলাময়। প্লাস্টিকবিরোধী আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠন ‘ব্রেক ফ্রি ফ্রম প্লাস্টিক’ করপোরেট প্লাস্টিক দূষণবিষয়ক সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২০২০ সালে। সমীক্ষাটি তৃতীয়বারের মতো প্রমাণ করে, কোক-পেপসি এবং নেসলের মতো বহুজাতিক কোম্পানির কারণেই প্লাস্টিক দূষণ ঘটছে। প্রতিবেদনে চিহ্নিত শীর্ষদশের অন্যান্য প্লাস্টিক দূষণকারী কোম্পানি হলো– ইউনিলিভার, মনডেলেজ ইন্টারন্যাশনাল, মারস, প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, ফিলিপ মরিস, কোলগেট-পালমোলিভ ও পারফেট্টি। সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট সায়েন্স (সিইসি) ২০০৩ এবং ২০০৬ সালে ১১টি কোকা-কোলা ও পেপসি ব্র্যান্ড নিয়ে একটি গবেষণা করে দেখায়, সেসব পানীয়তে কীটনাশকের পরিমাণ অনেক বেশি। কোক-পেপসির প্রমাণিত পরিবেশদূষণ কিংবা স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে খুব বেশি জনরব আমরা দেখি না। কিন্তু ‘পে এভরি পেনি টু সেভ ইসরায়েল’– পেপসির এমনতর (হয়তো বানানো, হয়তো সত্য) মানে আবার খুব প্রচারিত। কিংবা ‘ইসলাম ধর্মানুভূতি’তে আঘাতের বিরুদ্ধে বহু পোস্টার ও পোস্ট দেখা যায়, যেখানে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পরিচয়কে ‘ধর্মীয়’ হিসেবে বিবেচনা করে সেসব কোম্পানির পণ্য বাতিল ও বর্জনের ডাক দেওয়া হয়। আড়াল করে ফেলা হয় বহুজাতিক কোম্পানির জারি রাখা অন্যায় এবং অবিচারকে। কোনো খাদ্য কি কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে খারিজ হতে পারে? একজন কৃষকের ধান কিংবা কোনো জেলের ধরা ইলিশ মাছ কি তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে নিষিদ্ধ হতে পারে? খাদ্যচিন্তার ক্ষেত্রে পরিবেশগত বিষয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ন্যায্যতা নিয়ে তাহলে প্রশ্ন করার জায়গা কোথায়?

আপনাদের কি মনে আছে, ২০১৫ সালে নেসলের ম্যাগি নুডলসে সিসা পাওয়ার পর কী ঘটেছিল? ভারতের উত্তরপ্রদেশের ফুড সেফটি অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএসডিএ) ২০১৫ সালের মার্চে নেসলের ম্যাগি নুডলসে উচ্চমাত্রার মনো-সোডিয়াম গ্লুটামেট (এমএসজি) পায়। একই সালে ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) এবং ‘খাদ্যবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট’-এর পরীক্ষাগারে ম্যাগি নুডলসে সিসা পাওয়া গিয়েছিল। এ নিয়ে কিছু তর্ক ওঠায় কিছুদিন বাজারে ম্যাগি নুডলস বন্ধ ছিল। এর পর ম্যাগি নুডলস বাজারে বিক্রি করছে ‘ধর্মীয় অনুভূতি’কে ব্যবহার করে। তারা মোড়কের বিজ্ঞাপনে ঘোষণা দেয়, ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক পরীক্ষিত হালাল নুডলস। ম্যাগি নুডলসে পাওয়া গিয়েছিল জীবন হরণকারী সিসা বিষ। এটি ভারী ধাতু এবং শরীরে গেলে ক্যান্সারসহ নানা মারাত্মক অসুখ তৈরি করে। সিসা-তর্ক ঢাকতে নেসলে কোম্পানি খুব কায়দা করে তখন ‘হালাল খাবার’-এর বিজ্ঞাপন ব্যবহার করেছিল। মা-বাবা হিসেবে প্রশ্নহীনভাবে এমনতর বহুজাতিক বিষাক্ত খাবার আমাদের সন্তানদের মুখে তুলে দিচ্ছি। প্রতিনিয়ত বাড়ছে শরীর ও মনের অসুখ। বাড়ছে খরচ। কিন্তু বহুজাতিক খাদ্য কোম্পানিকে প্রশ্ন করার সাহস কেউ করছে না।

একদিকে ফিলিস্তিন চুরমার হবে, অন্যদিকে ইসরায়েলের সেনাদের জন্য খাবারের দোকান খোলা হবে। একদিকে ধনীর দুলালদের নষ্ট করা খাবারে উপচে পড়বে ভাগাড়, অন্যদিকে কোটি কোটি ক্ষুধার্ত শিশু আরেকটি ক্ষুধার্ত ভোরের অপেক্ষা করবে।

সমকাল