- জসিম উদ্দিন
- ২৬ মে ২০২১
গত ১৭ মে সোমবার বেলা ৩টা থেকে বাংলাদেশ সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে নানাভাবে হেনস্তা করা হলো সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে। রাত সাড়ে ৮টার পর তাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে টানা তাকে ১১ ঘণ্টা আটক রাখা হয়েছিল। এরপর নেয়া হয় আদালতের হাজতখানায়। সেখানে তাকে তিন ঘণ্টা থাকতে হয়। মামলার শুনানি চলে ৪০ মিনিট। এর আধাঘণ্টা পর ৪০ কিলোমিটার দূরে গাজীপুরে মহিলা কারাগারে তাকে নেয়া হয়েছিল। এ সময় একটানা ২৩ ঘণ্টার অবর্ণনীয় ঝড় তাকে সইতে হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলো ১৯ মে পত্রিকার প্রধান শিরোনাম করে নিজেদের সাংবাদিকের এ কষ্ট দুঃখের কথা ছেপেছে।
রোজিনা সচিবালয় যাওয়ার আগে করোনার টিকা নিয়েছিলেন। তার শরীরে টিকা নেয়ার অস্বাভাবিকতা ছিল। তার ওপর আটকে রেখে জোর প্রয়োগের দরুন তিনি অস্বস্তি বোধ করেন। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। লুটিয়ে পড়েন মেঝেতে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়নি। একজন সাংবাদিকের ওপর এমন নির্যাতন অপ্রত্যাশিত। তার ওপর, তিনি একজন নারী। তার একটি শিশুসন্তান রয়েছে। এসব বিবেচনা করা হয়নি।
প্রথম আলোকে বাংলাদেশের ‘প্রধান ও সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকা’ বলা হয়। রোজিনাকে সচিবালয়ে আটক করার পর পত্রিকাটির সম্পাদক, শুভাকাক্সক্ষী ও সহযোগীরা তাকে ছাড়িয়ে আনার প্রচেষ্টা শুরু করেন। এতে সরকারের মন্ত্রী-আমলা ও সমাজের বিশিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যুক্ত হন। পত্রিকাটি তার জাতীয় আন্তর্জাতিক সব প্রভাব নিজের সাংবাদিককে অন্যায় হেনস্তার হাত থেকে বাঁচাতে ব্যবহার করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যে আমরা পরে সেটা বুঝতে পারি। পত্রিকাটির একজন সিনিয়র সাংবাদিককে এই সময় কাঁদতে দেখা গেল। সম্ভবত উপরের মহলের সাথে সব ধরনের যোগাযোগের পরও জামিন না পাওয়ায় ডুকরে এমন কাঁদা। আসলে ন্যায়বিচার পাওয়া ‘ছেলের হাতের মোয়া’ নয় যেমনটি শিশুরা কান্নাকাটি করে আদায় করে এবং আদরের গভীর সম্পর্কের কারণে বাবা সন্তানকে দেন।
ব্যক্তিগত ভালো সম্পর্কের কারণে সবসময় রাষ্ট্রের আনুকূল্য পাওয়া যাবে, এমনটা ভুল ধারণা। স্বেচ্ছাচারিতার কাছে কান্নাকাটির মূল্য নেই। স্বেচ্ছাচারমূলক রাষ্ট্রে সরকারের নতুন নতুন শত্রু-মিত্র জন্ম নেয়। সম্পর্ক যতই ভালো হোক, তখন সরকারের আপেক্ষিক স্বার্থ বিবেচনার ‘দরকার’ হয়। কারণ রাষ্ট্রের ভেতর জন্ম নেয়া বিভিন্ন শক্তির কূপ (ডিপ স্টেট) নিজেদের স্বার্থে বিভিন্নভাবে সক্রিয় হয়ে সরকারকে প্রভাবিত করে। সরকারকে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী বন্ধুদের পক্ষ নিতে হয়। এ দেশের সাংবাদিকরা বর্তমানে বিভক্ত ও দুর্বল। কান্না কোনো মোক্ষম অস্ত্র নয়। এ অবস্থায় রোজিনাকে লালদালানে যেতে হয়েছে। পাসপোর্ট সমর্পণ করে জামিন পেতে হয়েছে। মামলার খড়গটি ঝুলে রয়েছে। এখানে রোজিনার অপরাধ ধর্তব্যের বিষয় নয়। এমনটি ঘটুক; তা শক্তিশালী কেউ কেউ চেয়েছেন বলে তাই হয়েছে। রোজিনা মুক্তি পাওয়ার পর দায়িত্বশীল কিছু ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া লজ্জাজনক। অনেকে এতে আনন্দিত ও খুশি; বিজয় দেখছেন। কেউ রাষ্ট্রকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন। মূলত আমরা জানি, বড় বড় অপরাধীরা বিচারের আওতায় আসার কোনো লক্ষণ নেই। অন্য দিকে অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন করা একজন রোজিনা বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। মূলত তাকে একচোট হেনস্তা করা গেছে। এখানে বিজয় বা আনন্দের কিছু নেই।
সাংবাদিকসমাজ ও তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকে বলছেন, রোজিনা আক্রোশের শিকার হয়েছেন। তিনি যেসব প্রতিবেদন বিগত কয়েক বছরে করেছেন, তাতে কিছু ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট অপরাধের তথ্য প্রমাণ রয়েছে। তার করা ওই সব প্রতিবেদনকে ভিত্তি ধরে স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কারো বিরুদ্ধে উচিত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমন দেখা যাচ্ছে না। ওই সব প্রতিবেদনের অন্তত একটি বিবেচনা করলেই দেখতে পাবো, অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরকারের নীতি কোনপর্যায়ে রয়েছে।
রোজিনার করা স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতির একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘এখন এক কোটি নেন, পরে আরো দেবো’। এই প্রতিবেদনে ঘুষ সাধা ও ঘুষ গ্রহীতা চক্রের অনেকের নাম স্পষ্ট করে এসেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ওই প্রতিবেদনের বিপরীতে তথ্য প্রমাণ হাজির করে অভিযুক্তদের নিরপরাধ হিসেবে উপস্থাপন করেনি। রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী ঘুষ খাওয়া বেআইনি, কাউকে সেটা সাধাও অপরাধ। কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠলে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের চুপ করে থাকা কি বৈধ? নাগরিকদের মনে এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। রোজিনা যদি কারো বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এ প্রতিবেদন রচনা করে থাকেন আর প্রথম আলো যদি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সেটা ছাপিয়ে থাকে তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তি, স্বাস্থ্য বিভাগ এমনকি সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদন রচনার জন্যরোজিনা ও প্রথম আলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অথচ রোজিনাকে আটকানো হলো শত বছর পুরনো একটি ঔপনিবেশিক আইন দিয়ে।
স্বাস্থ্য বিভাগ নিয়ে রোজিনা আরো বেশ কিছু প্রতিবেদন করেছেন। প্রত্যেকটি ব্যাপারে উপরের কথাগুলো প্রযোজ্য। ওই সব প্রতিবেদনে আরো জানা যাচ্ছে, কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন যারা সৎ ও নীতিবান। দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের কোটি টাকা ঘুষ সাধার পরও সেটা তারা নিচ্ছেন না। তারা বরং রোজিনাদের ডেকে এনে এই দুর্দিনে দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচন করার সাহস দেখাচ্ছেন। জানা যায়, জোর জবরদস্তির একপর্যায়ে রোজিনা তার সোর্সের নাম বলেছেন। এখন এ ধরনের সৎ ও সাহসী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করে কোণঠাসা করা হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক সৎ কর্মকর্তা শাস্তি, পদাবনতি কিংবা হেনস্তার শিকার হওয়ার রেকর্ড রয়েছে।
সাংবাদিক নির্যাতন, হয়রানি এবং সংবাদমাধ্যমকে ভীতি প্রদর্শন ও বন্ধ করে দেয়া বিগত এক দশকে বাংলাদেশে সাধারণ একটি বিষয় হয়ে গেছে। এখন ‘প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমান নিজের পত্রিকার প্রথম পাতায় লিখেছেন ‘সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ নাগরিকসমাজ একাত্ম’। নিজের একজন সহকর্মীর সরকারি কাস্টডি থেকে ছাড়া পাওয়ার লক্ষ্যে সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্যের মালা গাঁথতে তিনি এমন লিখেছেন। ঐক্যের এ শক্তিকে তিনি ব্যবহার করতে চান। এমনটা আরো অনেক আগে থেকে হতে পারত। তাহলে রোজিনা ইসলামের মতো দামি সাংবাদিকদের এমন হেনস্তার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম হতো। আমরা দেখেছি খ্যাতিমান সাংবাদিক শহীদুল আলমের কারাবাস। ফটো সাংবাদিক শফিকুল আলম কাজলের গুম হয়ে যাওয়া এবং বারবার তার জামিন প্রত্যাখ্যান।
প্রবীণ সাংবাদিক ও সম্পাদক আবুল আসাদের ওপর পত্রিকার অফিসে ঢুকে আক্রমণ চালানো হয়েছে। তাকে একদল সন্ত্রাসী নিজের কার্যালয়ে ঢুকে লাঞ্ছিত করেছে। শেষে মামলা দিয়েছে। নানা জটিল রোগে আক্রান্ত বৃদ্ধ এই সম্পাদক দীর্ঘ এক বছর কারাগারে ছিলেন। তার আগে বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ও আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে নির্যাতন করা হয়েছে। তাকে দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে মারধর করে হত্যা করতে চেয়েছিল। মাহমুদুর রহমানের রক্তাক্ত সেই ছবি সবাই দেখেছেন। তাকে ৩৯ দিন রিমান্ড দেয়া হয়েছে। তিনি কয়েক বছর জেল খেটেছেন। তার সাথে পত্রিকাটির অন্য সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান জেল খেটেছেন। শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে তারা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এমন ঘটনা সাম্প্রতিক বছরে আরো অনেক সাংবাদিকের ক্ষেত্রে ঘটেছে। আজো সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজী, সংগ্রামের বার্তাসম্পাদক সা’দাত হোসেন জেলে।
এর আগে পরে বিভিন্ন সময় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে টিভি চ্যানেল দিগন্ত, ইসলামিক টিভি ও চ্যানেল ওয়ান। সরকারের নির্বাহী আদেশে বন্ধ হয়ে গেছে দৈনিক আমার দেশ। হেনস্তার শিকার হয়েছে একুশে টিভি। রোজিনা আটক হওয়ার পর প্রথম আলো ছয় দিন ধরে খবরটি নিজের পত্রিকার প্রধান সংবাদ করেছে। প্রথম কয়েক দিন পত্রিকাটির বড় একটি অংশ সাজিয়েছে এ বিষয়ক খবর, প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া দিয়ে।
একটি সুপ্রতিষ্ঠিত জাতীয় দৈনিকের এই বিপুল কভারেজ শুধু একজন সাংবাদিকের জামিন পাওয়ার জন্য করতে হয়েছে। অথচ এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না যদি আগের সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যম বন্ধ করার সময় প্রত্যেক সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম নিজের অবস্থান থেকে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতেন। ওই সব ঘটনার বেশির ভাগই বাংলাদেশের প্রধান ধারার সংবাদমাধ্যম এড়িয়ে গিয়েছে। সঙ্গত প্রতিক্রিয়া প্রতিবাদ দূরে থাক, অনেক ক্ষেত্রে এক কলাম সংবাদ ছাপানোর প্রয়োজনও বোধ করেনি তারা। মনে রাখতে হবে, সাংবাদিকরা নিজেরা ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের হতে পারেন। তাদের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য থাকতে পারে। একটি লিবারেল সমাজের স্থিতাবস্থার জন্য এসব সত্ত্বেও তাদের একাত্ম থাকতে হয়। প্রান্তিক সংবাদমাধ্যমকে ও প্রান্তিক সাংবাদিকদের টিকিয়ে রাখতে হয় নিজেদের স্বার্থেই। জনপদবাসী বেড়িবাঁধ দেয় ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচার জন্য। বাংলাদেশের অনেক সংবাদমাধ্যম বন্ধ হয়ে যাওয়া, সম্পাদকের হেনস্তা হওয়া- এগুলো আসলে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার মতোই। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে এখন প্রধান সংবাদমাধ্যম আপনা থেকেই ঝড়ের মুখে পড়ছে। নিরাপত্তার ফ্রন্টলাইন যখন ভাঙা হচ্ছিল তারা তখন নিজেদের মতাদর্শিক শত্রু ভেবে তা নিশ্চিহ্ন হতে দিয়েছেন। এই সুযোগে সরকার তার রাজনৈতিক শত্রুদের খতম করার কাজটিও সহজে করতে পেরেছে। প্রধান ধারার সংবামাধ্যমের সময় মতো দায়িত্ব পালন না করতে পারার ফল হয়েছে- আজ আর কেউ নিরাপদ নেই। এমনকি সরকারও নয়। এ দিকে একজন সাংবাদিকের শুধু জামিন পাওয়ার জন্য বিপুল শক্তি ক্ষয় করতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে।
সমমনা ডেইলি স্টারও রোজিনার আটকের বিষয় বিপুল সংবাদ কাভারেজ দিয়েছে। হাতেগোনা আর মাত্র কয়েকটি সংবাদমাধ্যম আক্রোশের শিকার রোজিনার ব্যাপারে সক্রিয়তা দেখিয়েছে। বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমে এ সংবাদটির কাভারেজ বর্তমান সময়কার ট্রেডিশন অনুযায়ী দিয়েছে। অর্থাৎ, সরকার নাখোশ হবে এই ফর্মেটের মধ্যে ছিল। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেকটি সংবাদমাধ্যম যদি রোজিনার বিরুদ্ধে সংঘটিত অন্যায়ের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কাভারেজ দিত তাহলে মতিউর রহমান সবার একতাবদ্ধ হওয়ার যে কথাটি নিজের পত্রিকায় লিখেছেন, সেটা সত্য প্রমাণিত হতো।
ইচ্ছেমতো সাংবাদিকতার বিষয় নির্বাচনের নেতিবাচক দিকটি কিছুদিন আগে রাজধানীতে এক তরুণীর অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে আমরা দেখলাম। দেশের অন্যতম একটি শিল্প গ্রুপের মালিকের নামটি তখন ব্যাপক আলোচনায় আসে। প্রধান ধারার সংবাদমাধ্যম বর্তমান ট্রেডিশন অনুযায়ী এড়িয়ে যেতে চাইল বিষয়টি। সামাজিক মাধ্যম তাদের এমন ‘নীতি’ ভণ্ডুল করে দেয়। সংবাদটি গা বাঁচিয়ে প্রধান ধারার সংবাদমাধ্যমকে ছাপাতে হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় ছিল, ওই শিল্প মালিকের ছয়টি সংবাদ মাধ্যমের একটিও এ খবর দিতে পারেনি। এই খবর প্রচার হলে তাদের মালিকের বিরুদ্ধে কিন্তু অপরাধ প্রমাণ হয়ে যেত না। পরিস্থিতি এমন যে, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা বন্দী হয়ে গেছেন। দুঃখজনক হচ্ছে, তাদের এ উপলব্ধিটুকু পর্যন্ত নেই। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, তাদের হাতে সম্পাদক পরিষদ, প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন সাংবাদিক প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বের ভার অর্পণ করা হচ্ছে। তাদের অনেকে এক দিকে সরকারের গুডবুকে থাকতে চান, অন্য দিকে তারা মালিকের স্বার্থ রক্ষার অগ্রসৈনিক। এই ধরনের নৈতিক দেউলিয়াপনা দিয়ে সাংবাদিকতার স্বার্থ রক্ষা করা যায় না।
ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম পরপর দুই দিন নিজের পত্রিকায় মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাফাই গাওয়া বিজ্ঞাপনও ছাপিয়েছেন। ওই বিজ্ঞাপনে যথানিয়মে সচিবের নামের আগে সম্মানপূর্বক ‘মহোদয়’ ব্যবহার করা হয়েছে। রোজিনাকে শুরুতে সম্বোধন করা হয়েছে ‘জনৈক মহিলা’ বলে। বিজ্ঞাপনটি কেন ছাপিয়েছেন, পরের দিন তার কৈফিয়তও তিনি দিয়েছেন। ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপন এবং মিডিয়ার স্বাধীনতা’ শিরোনামে তার মন্তব্য প্রতিবেদনটি বর্তমান সম্পাদকদের স্বাধীনতার একটি ‘পারদ’ হিসেবে ভবিষ্যতের জন্য উদাহরণ হয়ে থেকে যাবে। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এক দিনে এই পর্যায়ে নেমে আসেনি। স্বাধীনতার যখন এমন অবনমন ঘটছিল, তখন এ দেশের সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতাদের কী ভূমিকা ছিল, সেটাও আগামী প্রজন্ম জানতে চাইবে।
সরকারি হেফাজতে সম্প্রতি মুশতাকের মৃত্যুর পর সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিলুপ্তি কিংবা কমপক্ষে সংস্কারের জন্য আন্দোলন করেছে। দেশের সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও একই দাবি জানিয়েছে। তাদের প্রচার অনুযায়ী মানবাধিকার গ্রুপ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আইনটির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। সম্মিলিত এমন প্রতিক্রিয়ায় মনে হয়েছে এ আইনটি বাতিল হলে দেশে সাংবাদিকদের জন্য আবার ‘স্বর্গ নেমে আসবে’। প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিকতায় ভীতি প্রদর্শন, হেনস্তা ও নির্যাতন আইনটি প্রণয়ন করার আগেও ছিল। রোজিনাকে আটক করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দরকার হয়নি। সাংবাদিক নেতৃত্ব মূল সমস্যার পেছনে না গিয়ে যদি টোটকার দিকে দৌড়ান, তাহলে এ দেশে সাংবাদিকতাকে তারা স্বস্তি দিতে পারবেন না।