- গোলাম মাওলা রনি
- ০৯ জুলাই ২০২০
চলতি বছরের ৫ মে থেকে চীন ও ভারতের মধ্যে যখন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল, তখন বাংলাদেশের অন্যসব মানুষের মতো আমি নিজেও প্রমাদ গুনতে থাকলাম। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর প্রবল আতঙ্ক, ব্যবসাবাণিজ্য-জীবনযাত্রার সীমাহীন অনিশ্চয়তা, দুর্ভিক্ষের হাতছানির সাথে পাল্লা দিয়ে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প, পঙ্গপাল প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যখন পৃথিবীর নানাপ্রান্তে একের পর এক হানা দিচ্ছে, তখন আস্তিক-নাস্তিক সবাই একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে যে, মানুষের কুকর্মে প্রকৃতি অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে। ফলে বেশির ভাগ মানুষ কেবল দু’মুঠো অন্ন এবং আলো-বাতাস-পানির আকুতি জানিয়ে আসমানের সর্বশক্তিমান মালিকের কাছে মিনতি পেশ করতে গিয়ে চোখের পানিতে যেমন বুক ভাসাচ্ছে, তেমনি এমন একশ্রেণীর মানুষও রয়েছে যারা চলমান মহাদুর্যোগের মধ্যেও ‘মাস্তি’ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে চলেছে।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে যারা ভারতকে দায়ী করতে চান তাদের বক্তব্য হলোÑ ভারত একতরফাভাবে গালওয়ান নদীর উপত্যকা যাকে অনেক গালওয়ান ভ্যালি বলে থাকেন সেখানে রাস্তা নির্মাণ শুরু করে, যা চীনাদের ক্ষেপিয়ে তোলে। কারণ, গালওয়ান নদীর প্রবাহ নিয়ে চীন ও ভারতের বিরোধ সুদীর্ঘকালের। নদীটি চীনের আকসাই এলাকা থেকে উৎপন্ন হয়ে যেভাবে ভারতের দাবিকৃত লাদাখ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে তাতে আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক নদীর অববাহিকার একাংশের ওপর চীনের দাবি আইনসঙ্গত। সুতরাং সেই অববাহিকতায় একতরফাভাবে রাস্তা নির্মাণ করে মূলত ভারতই পৃথিবীর বর্তমান দুর্যোগ মুহূর্তে একটি ভয়াবহ যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছে বলেও অভিযোগ।
চীন ও ভারতের এ যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ায় টানটান উত্তেজনা চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্স তাদের যাবতীয় স্পর্শকাতর মূল্যবান সামরিক অস্ত্রের ভাণ্ডার ভারতের জন্য খুলে দিয়েছে। ভারত তাদের রাজাকোষ উজাড় করে দিয়ে অকাতরে বাহারি মারণাস্ত্র কিনে বিশ্ববাসীকে চমকে দেয়ার চেষ্টা করছে। অন্য দিকে চীন তাদের উদ্ভাবিত ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রগুলো যা কিনা আকাশ-সমুদ্র এবং স্থলযুদ্ধে ব্যবহৃত হয় সেগুলোর মহড়া দিয়ে পুরো পরিস্থিতিকে ভয়ঙ্কর করে তুলছে। ফলে চলমান করোনা সঙ্কট ও ব্যবসা বাণিজ্যের অচলাবস্থাসহ মানুষের অস্তিত্ব সঙ্কট নিয়ে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলছে তা ধামাচাপা দিয়ে মানুষ চীন-ভারতের যুদ্ধ নিয়ে নিদারুণ মাতামাতি শুরু করে দিয়েছে।
চীন ও ভারতের সম্ভাব্য যুদ্ধ নিয়ে আমাদের দেশেও নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়েছে। গত একযুগ ধরে চলমান ভারতমুখী পররাষ্ট্রনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ভারতের আনুকূল্যে রাজনীতি করে রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকা অথবা রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার যে মিথ এ দেশে চালু ছিল, তা প্রথমবারের মতো মারাত্মকভাবে ঝাঁকুনি খেয়েছে। এই সমস্যা শুরু হওয়ার আগে অর্থাৎ গত ৫ মের আগে আমাদের দেশের দুই-চারজন অর্বাচীন, গোটা কয়েক আধা পাগল এবং গুটিকতক দেশপ্রেমিক লোকজন ছাড়া প্রকাশ্যে কেউ ভারতের বিরুদ্ধে ঠোঁট ও জিহ্বা নাড়াচাড়া করতেন না। কেউ তার স্বরযন্ত্র ব্যবহার করে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অন্যায় আচরণ সম্পর্কে আওয়াজ তুলতেন না বা দু’কলম লিখে কবি ফরহাদ মজহারের পরিণতি বরণ করতে চাইতেন না। ফলে বিগত দিনগুলোতে আমাদের জনগণের ভারতভীতি ছিল পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর ইংরেজ সৈন্য তথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যসামন্ত সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভয়ভীতি এবং পরিবেশ পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটের মতো।
ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের রহস্যময় ভয়ভীতি, অতিরিক্ত দরদ কিংবা অযাচিত ভক্তিশ্রদ্ধা ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নিদারুণভাবে উপভোগ করে আসছিল। তারা বাংলাদেশকে কিভাবে গুরুত্ব দিত তা বুঝা যাবে যদি আপনারা কেউ গত ১২ বছরে আমাদের সীমান্তে যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে সেগুলো পর্যালোচনা করেন এবং সেসব হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর কর্তাদের ভাবলেশহীন কথাবার্তা শোনেন এবং রাজনৈতিক নেতাদের তাচ্ছিল্যময় কথাবার্তা ও আচরণ লক্ষ করে থাকেন। ভারতীয় আমলা কামলা মন্ত্রীরা বাংলাদেশে এসে যেভাবে পায়ের ওপর পা তুলে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলতেন তা দেখলে যেকোনো আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষের শরীর-মন ক্ষোভে ভরে উঠত। অধিকন্তু তারা করোনা সঙ্কট শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে যেভাবে নাগরিকত্ব বিল পাসের মাধ্যমে আসাম রাজ্য থেকে প্রায় ৪০ লাখ ভারতীয় মুসলমানকে বাংলাদেশে জোর করে ঢোকানোর মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছিলেন, তাতে সারা বাংলাদেশ ভারতের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল।
আমাদের গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার প্রতি কুঠারাঘাত, অসম ব্যবসাবাণিজ্য, জোর জবরদস্তি কিংবা একতরফা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে হুটহাট করে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, যা ভারত থেকে আমদানি হতো সেগুলোর ওপর রফতানি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলা এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানিযাগ্য পণ্যের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে আমাদের নানাভাবে নাজেহাল করার নিত্যনতুন অপকৌশল যেভাবে তারা প্রয়োগ করতেন, তাতে আমাদের দেশের মানুষের মন ক্রমাগতভাবে বিষিয়ে উঠছিল। ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশী জনগণের যে মনোভাব, একই মনোভাব ধারণ করে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ এবং পাকিস্তানের জনগণ ক্ষোভের আগুনে ফুঁসছিল বহু দিন আগে থেকে। ওসব দেশের সাথে আমাদের দেশের কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। আর সেটি হলো বাংলাদেশে কিছু ভারতীয় স্বার্থ সংরক্ষণকারী রয়েছে, যারা ক্ষমতা, টাকা এবং পদপদবিতে এমন একটা অবস্থায় রয়েছে যার কারণে ভারত বা তাদের এজেন্টদের বিরুদ্ধে মুখ খোলাকে বেশির ভাগ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করে আসছিল।
এ প্রেক্ষাপটে লাদাখ সীমান্তে যখন চীন-ভারতের সেনারা হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করল এবং সেই যুদ্ধে ভারতীয়দের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলো তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীর মন-মানসিকতায় যেন স্বস্তির হাওয়া বইতে শুরু করল। তারা চীন-ভারতের সর্বাত্মক যুদ্ধে ফলাফল নিয়ে নানামুখী বিচার-বিশ্লেষণ শুরু করে এবং যুদ্ধ শুরু হলে ভারত পারবে না, এমনটি বলে-কয়ে নিজেদের সান্ত্বনা দিতে থাকে। মানুষের মনোজগতের অদ্ভুত রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে তারা যুদ্ধের দামামার আশায় নিজেদের জীবনের নিত্যকার অভাব অভিযোগ, দুঃখ দুর্দশা কিংবা আতঙ্ক যেন ভুলে গেল।
বাংলাদেশেও চীন-ভারত যুদ্ধের ফোক ফ্যান্টাসি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেল। আমরা এমনিতেই গুজবপ্রিয় জাতি। গল্প-গুজব, আড্ডাবাজি এবং আকাশকুসুম কল্পনা আমাদের অভ্যাসের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু করা আবার রিকশার টায়ার ফাটা শব্দে জ্ঞান হারানো বা উল্টোপথে ভোঁ দৌড়ে পালানোর বদনামও আমাদের কম নেই। আমরা যেমন খুব সহজে কাউকে সমর্থন দেই, তেমনি অবলীলায় সমর্থন প্রত্যাহার করে কারো বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগতে আমাদের অনেকেরই খুব বেশি সময় লাগে না। আমাদের এতসব বৈশিষ্ট্যের কারণে আমরা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় একটু বেশি মাত্রায় চীন-ভারতের যুদ্ধ নিয়ে বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। আমাদের বেশির ভাগ জনগণ চীনকে এমনভাবে সমর্থন জানাচ্ছে যা দেখলে কট্টরপন্থী চীনা নাগরিকরাও হতভম্ব হয়ে পড়বে। অন্য দিকে কিছু লোক ভারতের জন্য এমন আহাজারি শুরু করছে তা যদি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা তার রাজনৈতিক সহচর অমিত শাহ দেখতেন তবে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে বলতেন- ‘ওহে সেলুকাস! দুই হাজার সোয়া ৩০০ বছর আগে তুমি কী বিচিত্র ভারতবর্ষ দেখেছ? এখন আসো! আবার আসো! দেখে যাও গাঙ্গেয় বদ্বীপে কী বিচিত্র পুতুলনাচের মেলা বসেছে।’
চীন-ভারত যুদ্ধের দামামা নিয়ে আমাদের আবেগ অনুভূতি সম্ভবত রাম ধরা খেতে যাচ্ছে। কারণ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে গালওয়ান উপত্যকায় যা কিছু ঘটছে বলে খবর বের হয়েছে, তার পুরোটাই ‘নাটক’। ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের চিত্রনাট্যে, মার্কিন প্রযোজনায় ভারত যে নাটক শুরু করেছে তাতে চীন অভিনয় করতে বাধ্য হচ্ছে এ কারণে যে, তাদেরও লাভের পরিমাণ কোনো অংশে কম নয়। করোনাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলোতে যে সামাজিক ও মানবিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে তার কারণে কোনো কোনো দেশে সরকার পরিবর্তন, গণ অভ্যুত্থান, সেনা বিদ্রোহ, রাজনৈতিক ক্ষমতা পটপরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে জনগণের মনের মধ্যে যুদ্ধের বাজনা ঢুকিয়ে দিয়ে বৃহত্তম জাতি রাষ্ট্রগুলো এক ধরনের সমঝোতার মাধ্যমে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ খেলা শুরু করেছে মূলত নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য।
আমরা যদি মার্কিন মুলুকে ট্রাম্পের কথা বিবেচনা করি তবে দেখতে পাবো, তার জনপ্রিয়তা কেবল তলানিতে নামেনি বরং অজনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার এতটা উঁচুতে উঠেছে, যা মার্কিন ইতিহাসে দ্বিতীয় কোনো প্রেসিডেন্টের কপালে জোটেনি। ট্রাম্প তার বহুমুখী ব্যর্থতা ধামাচাপা দেয়ার জন্য চীনের বিরুদ্ধে নানাভাবে বিষোদগার করে চলছিলেন। তিনি এবং তার মিত্ররা একই সুরে প্রপাগান্ডা চালাচ্ছিলেন যে, চীন তাদের গবেষণাগারে করোনাভাইরাস উৎপন্ন করেছে এবং বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য বিশ্বব্যাপী সেই ভাইরাস সুকৌশলে ছড়িয়ে দিয়েছে। এই প্রচারণা জনগণ বিশ্বাস না করলেও চীন কিন্তু নিদারুণ বেকায়দায় পড়ে যায়। পশ্চিমা দেশগুলোসহ মার্কিনিদের মিত্র বলে পরিচিত দেশগুলোতে বিশেষত ভারতে চীনা পণ্য বর্জনের হিড়িক পড়ে যায়। অধিকন্তু চীনা নাগরিকদের প্রতি ঘৃণা জানানো এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ওপর হামলা চালিয়ে দুনিয়ার একাংশকে চীনের জন্য সর্বদিক থেকে বিপজ্জনক করে তোলা হয়।
উল্লিখিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইসরাইল বেশ ভালোভাবেই চীনকে কোণঠাসা করতে পেরেছিল। কিন্তু এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে এসে পুরো পরিস্থিতি তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে যায়। ভারতের অর্থনৈতিক বিপর্যয়, করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি এবং মোদির জনপ্রিয়তা হ্রাসÑ সব মিলিয়ে যে জটিল অবস্থা সৃষ্টি হলো, ঠিক একই অবস্থা সৃষ্টি হয় ইসরাইল, আমেরিকা ও ফ্রান্সে। এমনকি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনও মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যান। ফলে ওই সব দেশের জনগণের মধ্যে সরকারবিরোধী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অনেকে রাস্তায় নেমে ব্যাপক সহিংসতা শুরু করে দেয়, যার ধাক্কা জার্মানি ও ইংল্যান্ডে এসে পড়ে। এতসব বিশৃঙ্খলা ও আতঙ্কের মধ্যে যখন হঠাৎ করে চীন-ভারত যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে তখন পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিমে সর্বত্র সবকিছু থেমে গিয়ে কেবল এ যুদ্ধের খবর প্রাধান্য পেতে থাকে। পৃথিবীবাসী করোনাসংশ্লিষ্ট মহাদুর্যোগগুলোর সাথে নতুন করে চীন-ভারতের যুদ্ধের পরিণতির শঙ্কায় আতঙ্কিত হতে থাকে। অন্য দিকে পর্দার অন্তরালের কুশীলবরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মুচকি মুচকি হাসতে আরম্ভ করে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য