প্রধানমন্ত্রীর সফর চলাকালে বাংলাদেশকে এ ১০০ কোটি রেনমিনবি অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেন চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াং। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ গতকাল বেইজিংয়ে সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান। যদিও দেশটি থেকে শুধু বাণিজ্য সহায়তাই প্রত্যাশা করা হচ্ছিল ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ। এর সঙ্গে বাজেট সহায়তা ও মেট্রোরেল, ভাঙ্গা-বরিশাল রেললাইনসহ কয়েকটি বড় প্রকল্পে অর্থায়ন যুক্ত করে সব মিলিয়ে মোট ২০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থায়নের প্রত্যাশা করছিল বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক ভূ-অর্থনীতির পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রলম্বিত অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে দুই বন্ধু দেশের কাছ থেকে অর্থ সহায়তার বড় প্রত্যাশা তৈরি হলেও প্রাপ্তির পালে হাওয়া লাগেনি। তারা মনে করছেন, দেশ দুটি থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী দৃশ্যত তেমন কোনো অর্জন হয়নি। বিষয়গুলো নিয়ে যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান করে এর ভিত্তিতে দেশের ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অর্থ সহায়তা দেয়ার পেছনে দাতা দেশগুলোরও এক ধরনের প্রত্যাশা থাকে। দুই দেশের এসব প্রত্যাশার জায়গায় সামঞ্জস্য এলেই অর্থের আদান-প্রদান ঘটে। তিস্তাসহ কৌশলগত কিছু কারণে এমনটা ঘটতে পারে। দুই পক্ষ হয়তো একমত হতে পারেনি। তাই প্রত্যাশা অনুযায়ী দৃশ্যত তেমন কোনো অর্জন হয়নি।’
এদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে চীন ও ভারত থেকে নতুন অর্থায়নের কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। অর্থবছরের শেষ মাস জুনেও দেশ দুটি থেকে নতুন কোনো অর্থায়নের খবর পাওয়া যায়নি। সে অনুযায়ী, গত এক বছরে চীন ও ভারত থেকে নতুন কোনো অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি আসেনি।
দেশের প্রলম্বিত অর্থনৈতিক চাপ থেকে পুনরুদ্ধারে বন্ধু দেশগুলোর কাছ থেকে বড় অর্থায়ন পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে অভিমত দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীরের। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দেশ দুটির সঙ্গে সংবেদনশীল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সৃষ্টিকারী কৌশলগত ও নিরাপত্তাবিষয়ক সমাধান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক কিংবা প্রকল্প ও ঋণ সহায়তার আশা পূরণ হয়নি। কেন এমনটা হয়েছে এটা গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। সেভাবেই দেশের ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণ করা উচিত।’
বাংলাদেশের তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে অনেক আগে থেকেই আগ্রহ দেখিয়ে আসছে চীন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে নয়াদিল্লির পক্ষ থেকেও তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। ওই সময় ভারত প্রকল্পটির দায়িত্ব পেতে পারে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে এমন ইঙ্গিত আসে। চীন হয়তো এ কারণেই বাংলাদেশকে বড় ধরনের অর্থ সহায়তা দেয়া থেকে পিছিয়ে এসেছে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চীন যা দেবে তা ১৫০ মিলিয়ন (১৫ কোটি) ডলারেরও সমান হবে না, যা হতাশ হওয়ার মতো চিত্র। তিস্তা প্রকল্পে চীন আর নেই এটা বেইজিং সফরের আগেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। চীন হয়তো এ কারণেই অর্থায়ন থেকে পিছিয়ে গেছে। চীন যদি মনে করে বাংলাদেশকে চাপে রাখলে লাভ হবে, তাহলে তারা তা-ই করবে।’
দেশের চীনপন্থী রাজনীতিবিদদের দাবি, তিস্তা প্রকল্পে ভারতকে জড়িত করার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তিস্তা প্রকল্পে চীন অর্থায়ন করলে টাকার অভাব হতো না। ভারত এত টাকা দিতে পারবে? ভারতকে খুশি করতে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিলাম আমরা। তিস্তা নিয়ে জাতীয় স্বার্থে শক্ত অবস্থান নেয়া সময়ের জরুরি দাবি ছিল।’
চীন ও ভারতের পক্ষ থেকে অতীতে করা ঋণ সহায়তার সব প্রতিশ্রুতির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। দেশ দুটির সঙ্গে বেশকিছু চুক্তি সই ও প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও সেগুলো বাস্তবায়ন ও অর্থছাড়ে ধীরগতির অভিযোগ রয়েছে ঢাকার।
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে স্বাক্ষরিত হয় ‘স্ট্রেংদেনিং অ্যান্ড প্রডাকশন ক্যাপাসিটি কো-অপারেশন’ শীর্ষক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ)। ওই চুক্তির আওতাভুক্তসহ নানা খাতে সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দেন শি জিনপিং। ওই এমওইউর আওতায় বাংলাদেশে চীনা ঋণে মোট ২৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু পরে ১০টি প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও অধিকাংশই আলোর মুখ দেখেনি।
ভারত তিনটি লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) অধীনে বাংলাদেশকে ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০১০ সালে দুই দেশের মধ্যে প্রথম এলওসি চুক্তি হয়। পরে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে আরো দুটি এলওসি চুক্তি হয়। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত এসব চুক্তির বিপরীতে অর্থায়ন মিলেছে দেড় বিলিয়ন ডলারের কম। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় চুক্তির বিপরীতে অর্থছাড় ধীরে হচ্ছে। চুক্তির শর্ত নিয়েও রয়েছে জটিলতা। এসব চুক্তির শর্ত নিয়ে বেশ কয়েকবার দরকষাকষিও করতে হয়েছে ঢাকাকে। এবারের সফরেও চুক্তির শর্ত শিথিল করা নিয়ে আলোচনা হলেও চূড়ান্ত কোনো পরিবর্তনের ঘোষণা সামনে আসেনি।
প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত ও চীন সফরের অর্থনৈতিক গুরুত্বের চেয়ে রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি বলে মনে করছেন সরকারের সাবেক নীতিনির্ধারকরা। এ বিষয়ে সরকারের সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভারসাম্য বজায় রাখা ও দরকষাকষির সক্ষমতা বাড়াতে এবারের দুটি সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রিজার্ভ সংকটের এ সময়ে ১ বিলিয়ন রেনমিনবির সহায়তাও কম না। পাশাপাশি চলমান প্রকল্পগুলো রয়েছে। আর ভারতের কাছ থেকে বেশি প্রত্যাশা করেও লাভ নেই। কারণ তাদের পক্ষে বিশাল আকারে অর্থায়ন করা সম্ভব না।’
দুই বছর ধরেই দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। টাকার মান ধরে রাখতে গিয়ে দেশের রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ নেমে এসেছে ১৬ বিলিয়ন ডলারে। মূল্যস্ফীতির হার দুই বছর ধরেই ৯ শতাংশের ওপরে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে গিয়ে সুদের হার উঠে গেছে ১৪ শতাংশের ওপরে। এমন অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে আওয়ামী লীগ নতুন করে সরকার গঠনের পর বাজেট সম্প্রসারণের পথ থেকে কিছুটা সরে এসেছে বাংলাদেশ। এ অর্থবছরের সংকুচিত বাজেটেও ঘাটতি ব্যয় মেটাতে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণের পরিকল্পনা করেছে সরকার।
বনিক বার্তা