চীনের যে ভূমিকায় দক্ষিণ চীন সাগরে পরিবেশ বিপর্যয়

অতিরিক্ত মাছ আহরণ এখন বিশ্বের ক্রমবর্ধমান একটা সমস্যা। এতে চীনের ভূমিকা অনেক বেশি। তাদের মাছ ধরার ২ হাজার ৫০০ বড় নৌযান রয়েছে। অনিবন্ধিত ও অবৈধ যানগুলো ধরা হলে এ সংখ্যা হবে ১৭ হাজার।

দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার ৬০ কোটি মানুষের জন্য দক্ষিণ চীন সাগরের সীমানাসংক্রান্ত যে সংকট, তা এখন আর ভবিষ্যতের উদ্বেগ নয়। চীনের কর্মকাণ্ডে এরই মধ্যে ওই অঞ্চলের সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান ও জীবনযাত্রায় ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। জনস হপকিনস ফরেন পলিসি ইনস্টিটিউট থেকে জেমস বর্টনের ডেসপ্যাচেস ফরম দ্য সাউথ চায়না সি: নেভিগেশন টু কমন গ্রাউন্ড নামে সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ে সে তথ্যই উঠে এসেছে। বইটিতে ভূরাজনৈতিক বিবেচনা সরিয়ে রেখে তিনি একটা বাস্তব সত্য তুলে এনেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আধিপত্যমূলক আচরণ পুরো অঞ্চলের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে ফেলছে। পরিবেশ, প্রতিবেশগত ও অর্থনৈতিক ক্ষতি ডেকে আনছে।

বর্টনের মূল বিবেচ্য বিষয় মৎস্য শিকার। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মানুষ যে পরিমাণ প্রাণিজ আমিষ গ্রহণ করে, তার ১৫ থেকে ৫৬ শতাংশ (দেশভেদে) আসে সমুদ্র থেকে। বিশ্ববাজারে এর বড় প্রভাব রয়েছে। পৃথিবীর সমুদ্র অঞ্চলের মাত্র আড়াই ভাগ দক্ষিণ চীন সাগর। কিন্তু বিশ্বের মোট মৎস্যসম্পদের ১২ শতাংশ আসে এখান থেকেই। বর্টনের মতে, বিশ্বের নিবন্ধনকৃত ৩২ লাখ মৎস্য আহরণকারী নৌযানের মধ্যে অর্ধেকই এ অঞ্চলের।

অতিরিক্ত মাছ আহরণ এখন বিশ্বের ক্রমবর্ধমান একটা সমস্যা। এতে চীনের ভূমিকা অনেক বেশি। তাদের মাছ ধরার ২ হাজার ৫০০ বড় নৌযান রয়েছে। অনিবন্ধিত ও অবৈধ যানগুলো ধরা হলে এ সংখ্যা হবে ১৭ হাজার। বর্টন জেলে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও গবেষকদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে দেখিয়েছেন দক্ষিণ চীন সাগরের মূল্যবান সম্পদ কী করে ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। দক্ষিণ চীন সাগরে একসময় প্রায় ২ হাজার ৫০০ প্রজাতির মাছ ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে জেলেদের জালে এর ৭০ শতাংশ প্রজাতির মাছ আর উঠছে না। বড় মাছ শিকারের হারও কমে গেছে ৯০ শতাংশ। কয়েক বছর হলো চীন একতরফাভাবে সমুদ্রে মৎস্যসম্পদ আহরণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ২০২১ সালে প্রতিবেশী দেশের আইনভঙ্গকারী নৌযানগুলোর বিরুদ্ধে তাদের কোস্টগার্ডকে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা দিয়ে নতুন আইন পাস করেছে চীন। কিন্তু চীনের কোস্টগার্ড যখন অন্য দেশের মাছ ধরার নৌযানগুলো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন চীন একাই বিশ্বের ২০ শতাংশ মাছ শিকার করছে।

বিশ্বের মোট প্রবালদ্বীপের এক-তৃতীয়াংশ দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত। কিন্তু বর্টনের তথ্যমতে, এগুলোর অর্ধেকই এখন নিশ্চিহ্ন হয়েছে। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রবাল দ্বীপগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দক্ষিণ চীন সাগরে সেটা ঘটছে চীনের কৃত্রিম দ্বীপ সৃষ্টি করার ফলে। এ কাজে চীন ১০০ বর্গমাইল প্রবালপ্রাচীর নষ্ট করেছে।

বর্টন দেখিয়েছেন, দক্ষিণ চীন সাগরের সংকট সমাধানের ব্যর্থতাই সেখানকার বাস্তুসংস্থানগত বিপর্যয়ের মূল কারণ। বিজ্ঞানী, গবেষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সুপারিশ তুলে এনে দক্ষিণ চীন সাগরের মূল সংকট এবং তা উত্তরণে সম্ভাব্য সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছেন বর্টন। তিনি লিখেছেন, ‘চলমান মহামারিতে যেমনটা সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, দক্ষিণ চীন সাগরেও সে রকম সমন্বিত বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রয়োজন তথ্যের অবাধ প্রবাহ।’ তিনি আরও লিখেছেন, দক্ষিণ চীন সাগরে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে একটা বিরতি প্রয়োজন।

দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, বৈশ্বিক মহামারি করোনা মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে চীন। কৃত্রিম দ্বীপ সৃষ্টির কারণে দক্ষিণ চীন সাগরে বাস্তুসংস্থানগত কী প্রভাব পড়ছে, তা নিয়ে মৌলিক তথ্য দিতেও রাজি নয় তারা। এর বদলে সামরিক যে কৌশল তারা নিয়েছে, তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এ ধরনের তথ্য ভাগাভাগির ইচ্ছা তাদের খুব একটা নেই। আঞ্চলিক বাস্তুসংস্থান রক্ষায় চীন খুব কম ক্ষেত্রেই গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে চায়।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

কেন্ট হ্যারিংটন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাবেক বিশ্লেষক