Defence Research Forum- DefRes
ইকোনমিক জোন সারা বিশ্বেই বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মডেল হিসাবে বিবেচিত। এই ইকোনমিক জোনে একটি দেশের বর্তমান আইন কানুন চলে না। বরং ইকোনমিক জোনের জন্য আলাদা আইন থাকে।
পৃথিবীর প্রথম আধুনিক ইকোনমিক জোন আয়ারল্যান্ডের ক্লেয়ারে পঞ্চাশের দশকে করা। এরপর ইউরোপ, আমেরিকার অর্থনৈতিক উত্থানের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল ইকোনমিক জোন গুলির৷ কিন্তু পরবর্তী অর্থনীতির চাকা ঘুরে এখন এশিয়া এবং আফ্রিকার দিকে ঝুকে পড়েছে।
এশিয়ায় অর্থনৈতিক উত্থানের শুরু প্রায় দুই দশকের বেশি আগে চীনের দক্ষিণ পূর্ব উপকূলে গড়ে উঠা ইকোনমিক জোনের উপর ভর করেই। চীনের এই উত্থানে উদ্বুদ্ধ হয়ে এশিয়ার অন্যান্য দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, রপ্তানি বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অবকাঠামো উন্নয়নসহ অনেক সুবিধার জন্য ইকোনমিক জোনের ধারনা ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু সব দেশ ইকোনমিক জোন করে সুবিধা পায়নি। ব্যার্থ হতে হয়েছে অনেক ইকোনমিক জোন কে৷ সঠিক পরিকল্পনার অভাব এখানে মূখ্য ভূমিকা রেখেছিল।
যাহোক, ১৯৯৫ সালেও সারা বিশ্বে ইকোনমিক জোনের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫০০ এর মত। আর এখন? সারা বিশ্বে ইকোনমিক জোনের সংখ্যা ৪৩০০ এর বেশি যেখানে প্রায় ৬.৮ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে প্রত্যক্ষ ভাবে।
এশিয়ার দেশগুলির ভেতর চীনের সর্বোচ্চ ১৫০০ ইকোনমিক জোন রয়েছে। যার জোরে চীন বিশ্বের সব থেকে বড় অর্থনীতির দেশ হবার পথে। এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইকোনমিক জোন রয়েছে ফিলিপাইনের যা প্রায় ৩১২ টি। আমাদের প্রতিবেশি দেশের ভেতর ভারতের রয়েছে ২২১ টি, শ্রীলঙ্কার রয়েছে ১২ টি। বাংলাদেশের রয়েছে ৮ টি যেগুলা ইপিযেড নামে পরিচিত।
তবে বাংলাদেশ তার কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভেতর সংযোগ স্থাপনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ২০৩০ সাল নাগাদ ১০০ ইকোনমিক জোন করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য উত্তম উদাহরণ হতে পারে চীনের গুয়াংডং প্রদেশ। এই প্রদেশটি চীনের অর্থনীতিতে সব থেকে বেশি অবদান রাখে। কেন? সেটা একটু পরে বলছি।
৮০ এর দশকে চীনের অর্থনীতি দুর্বার গতি লাভ করে৷ ওই সময় চীন তাদের প্রথম চারটি ইকোনমিক জোন তৈরি করে৷ শেনজেন এ একটা, গুয়াংডং প্রদেশে জুহাই, এবং শান্তও মিলে দুইটা, এবং ফুজিয়ান প্রদেশে জিয়ামেন ইকোনমিক জোন সহ মোট চারটি৷ এগুলা চালু হবার এক দশকের কম সময়ের মধ্যে এই চারটি শহর চীনের সব থেকে উন্নত শহরে পরিনত হয়। এভাবে চলতে চলতে চীনের ইকোনমিক জোনের আকার সব মিলিয়ে এখন ৫৫০০০০ বর্গ কিলোমিটার হয়ে গেছে।
চীনের অর্থনীতি তে সব থেকে বেশি অবদান রাখা গুয়াংডং প্রদেশের সাথে বাংলাদেশের মিল আছে৷ এই প্রদেশটি দক্ষিণ চীন সাগরের তীরে যেটা হংকং, ম্যাকাউ, এবং দক্ষিণ পূর্ব অর্থনীতির সাথে যুক্ত রয়েছে।
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার বর্ধিত অর্থনীতি এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতির সাথে সংযোগ সহজ করে দিয়েছে৷ সঠিক পরিকল্পনা নিলে বাংলাদেশ হতে পারে এই অঞ্চলের গুয়াংডং।
বাংলাদেশ এমডিজি এর লক্ষমাত্রা সফল ভাবে অর্জন করলেও এসডিজি অর্জনের ১৭ টি শর্ত পুরনে মূল শক্তি যোগাবে এই ইকোনমিক জোন গুলি। এই জোন গুলিতে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে সফল হতে পারলে ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশের কাতারে যাওয়া অসম্ভব হবে না। যদিও উন্নত দেশ হতে গেলে আমাদেরকে প্রতি বছর ১০% এর বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে যেতে হবে ২০৪১ সাল পর্যন্ত।
বাংলাদেশ আগে ছিল কৃষি প্রধান। কিন্তু কৃষি প্রধান দেশে এত মানুষের কর্মসংস্থান করা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছিল এক প্রকার অসম্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই শিল্প নির্ভর হয়ে পড়তেছে। কিন্তু শিল্প স্থাপনে চাই জমি যার সঙ্কট দেশে প্রকট। ফলে অপরিকল্পিত ভাবে কৃষি জমিতে গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা যেটা আমাদের জন্য আত্মঘাতী।
এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে পতিত জমিতে ইকোনমিক জোন করা। ইতিমধ্যে এরকম কম ব্যাবহৃত ৪০,০০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ইকোনমিক জোন করবার জন্য যেখানে বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের সংযোগ নিশ্চিত করে বিনিয়োগ বান্ধব করে তোলা হয়েছে। সেই জন্যই মূলত বিদেশি বিনিয়োগের জন্য সম্ভাব্য প্রতিষ্ঠানের ভীড় লেগে গেছে। বর্তমান ইকোনমিক জোন গুলিতে বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের আকার $১৬ বিলিয়ন ছাড়য়েছে।
ইকোনমিক জোনবগুলির জন্য ২০১০ সালে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ধারনা করা হয় আমাদের ইকোনমিক জোন থেকে মোট রপ্তানির পরিমান দাঁড়াবে প্রায় $৪০ বিলিয়ন ডলার এবং এখানে ১ কোটি লোকের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব হবে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ৮২ টি ইকোনমিক জোন করার অনুমতি দিয়েছে৷ এর ভেতর সরকারি ৫৪ টি, বেসরকারি ২৩ টি, বিভিন্ন দেশের জন্য নির্দিষ্ট ৪ টি এবং বেপজার অধিনে ১ টি৷
এর ভেতর দক্ষিণ এশিয়ার সব থেকে বড় ইকোনমিক জোন হচ্ছে মিরসরাই এ ৩০,০০০ একর জমির উপর। এটাকে বলা হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি যেটা চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে শুরু হয়ে ফেনির সোনাগাজি পর্যন্ত বিস্তৃত। মহেশখালী দ্বীপে দ্বিতীয় বৃহৎ জোন হচ্ছে প্রায় ২৪০০০ একর জমির উপর। পায়রায় হচ্ছে ১০০০০ একর জমির উপর। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় একটি, মঙলা, টেকনাফ, কুষ্টিয়া, নারায়ণগঞ্জ সহ সারা দেশেই করা হচ্ছে জোনবগুলি। এর ভেতর মৌলোভিবাজার এর শ্রী হট্ট ইকোনমিক জোনের শতভাগ জমি বরাদ্ধ দেয়া হয়ে গেছে। ৬-৭ টি ইকোনমিক জোনের কাজ দ্রুত চলছে৷ অন্য গুলির জমি অধিগ্রহণ চলছে।
চীন এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ২৮৭৮ একর জমি বুঝে নিয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারত। তারা প্রায় ১৪০০ একর জমি নিয়েছে। জাপানকে দেয়া হয়েছে ১০০০ একর, সিঙ্গাপুর কে ১০০ একর এবং অস্ট্রেলিয়া কে ২০ একর।
বাংলাদেশের জন্য এখন যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলার ভেতর দ্রুত ইউটিলিটি সংযোগ দেয়া, ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু অন্যতম। defres
এদিকে চীন যেভাবে ইকোনমিক জোন করে সফলতার মুখ দেখেছে তেমনটি হয়নি ভারত, শ্রীলঙ্কা অথবা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে। তাই তাদের সফলতা এবং ব্যর্থতা বিশ্লেষণ করে আমাদেরকে ভবিষ্যত কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে। সেই সাথে ডুয়িং বিজনেস র্যাংকিং এ একধাপ উন্নতি করে গর্ব না করে বরং আমাদের র্যাংকিং ১০০ এর নীচে নামিয়ে আনতে হবে। এক্ষেত্রে ভারতের সফলতাকে অনুসরণ করা যায়। মাত্র কয়েক বছরেই তারা বিশাল লাফ দিয়ে ১০০ এর নীচে চলে যেতে সক্ষম হয়েছে। আমাদেরকেও এরকম কিছু করা লাগবে। সেই সাথে সড়ক, রেল, এবং সমুদ্র বন্দরের সুবিধাকে আরো সহজলভ্য করতে হবে৷