- গোলাম মাওলা রনি
- ১৫ অক্টোবর ২০২০
বাংলাদেশকে ঘিরে ভারতের আদিখেত্যার বাড়াবাড়িতে দেশের বেশির ভাগ জনগণ কমবেশি বিরক্ত, অপমানিত। ক্ষেত্রবিশেষে বিক্ষুব্ধও বটে। গত এক যুগ ধরে ভারতীয়দের কর্তৃত্ব এ দেশের ব্যবসা বাণিজ্য-রাজনীতি, সমাজ-সংসার এবং সীমান্তে এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যা কিনা যেকোনো মেরুদণ্ডসম্পন্ন প্রাণীর জন্যই রীতিমতো অবমাননাকর। ফলে অপমানিত জনমত এবং বিক্ষুব্ধ মানসিকতা ভারতের বিকল্প কোনো রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য বহু দিন থেকেই সুযোগ খুঁজছিল। বাংলাদেশী জনগণের মন-মানসিকতা ভারত অনুধাবন না করলেও তাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী চীন কিন্তু ঠিকই সুযোগ বুঝে এমন কূটনৈতিক চাল চেলেছে যে, বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত জনপদে এখন তাদের ভালোবাসার বাগানে ফুল ফুটতে আরম্ভ করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে চীন অর্থনৈতিক-সামরিক এবং প্রযুক্তিতে এতটা উন্নতি করেছে যে, তাদের চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো রাষ্ট্রশক্তি দুনিয়াতে নেই। তারা বর্তমানের যুক্তরাষ্ট্র অথবা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো দুনিয়া জোড়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং সমহারে শত্রু তৈরির কারখানা স্থাপন করতে চায় না। তারা যেকোনো মূল্যে তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো এবং নিকটতম প্রতিবেশীদের সাথে হয় পূর্ণমাত্রায় বন্ধুত্ব নতুবা শত্রুতা করার নীতি অবলম্বন করে গত ছয় দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে তৎপরতা চালিয়ে আসছে। ফলে একমাত্র ভারত ছাড়া এশিয়ার অন্য কোনো দেশের সাথে তাদের এযাবৎকালে তেমন কোনো দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত হয়নি। অধিকন্তু পাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইরান, কাজাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মিয়ানমার প্রভৃতি জাতিরাষ্ট্রের সাথে চীনের যে কৌশলগত বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছে তা অন্য কোনো পরাশক্তি আজ অবধি করে দেখাতে পারেনি।
উল্লিখিত দেশগুলোর বাইরে চীন, তুরস্ক, রাশিয়া, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আজারবাইজান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি জাতিরাষ্ট্রের সাথেও সুসম্পর্ক স্থাপন করেছে এবং আগামী দিনে সামরিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। চীন পশ্চিমা দেশগুলোর মতো কেবল সামরিক শক্তির ভয় দেখিয়ে সবাইকে তাঁবেদার বানানোর কৌশল পরিহার করে প্রাথমিকভাবে ব্যবসা- তারপর অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং চূড়ান্তভাবে সামরিক বিষয়ে কৌশলগত অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ধীরেসুস্থে এগোতে থাকে। তারা একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সাধারণত নাক গলায় না এবং ভারতের মতো কর্তৃত্বপরায়ণতা নিয়ে কোনো বিশেষ দলকে বা গোষ্ঠীকে মদদ দিয়ে দেশকালের ওপর জগদ্দলের অভিশপ্ত পাথররূপে বসিয়ে দিয়ে জনগণের ঘৃণা-ক্রোধ ও ক্ষোভের উপলক্ষে পরিণত হয় না।
চীন তাদের বন্ধুরাষ্ট্রের সাথে সব ধরনের যোগাযোগের জন্য জল, স্থল এবং আকাশপথের যানবাহনগুলোর জন্য বিশেষ রুট, বন্দরব্যবস্থা, নেভিগেশন ও রাডার সিস্টেম, টেলি কমিউনিকেশন এবং সর্বোপরি দক্ষ জনশক্তি তৈরিসহ হাজারো অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে চলেছে। তারা ঐতিহাসিক সিল্ক রুট নামে পরিচিত বাণিজ্য রুট, যা কিনা চীন হয়ে ইরান, তারপর ইরান থেকে ইরাক-কুয়েত জেরুসালেম, নজদ-হাইল-ইয়েমেনের হাদ্রামৌত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অন্য দিকে, ইরান থেকে আজারবাইজান-আর্মেনিয়া, উজবেকিস্তান-আফগানিস্তান পর্যন্ত এসে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছিল। অন্য দিকে, চীন থেকে সিল্ক রুটের আরেকটি শাখা খাইবার পাস হয়ে সরাসরি পাকিস্তান এসেছিল, যা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে কলকাতায় এসে বাংলাদেশের গ্রান্ড ট্রাঙ্ক সড়কের সাথে মিশে গিয়েছিল।
কয়েক হাজার বছরের পুরনো উল্লিখিত সিল্ক রুটটি চীন আবার নতুন করে নির্মাণ শুরু করেছে এবং ইতোমধ্যে কয়েক লাখ কিলোমিটার আধুনিক সিল্ক রুট নির্মাণ করা হয়ে গেছে। এই রুটটির সাথে নতুন করে তারা নেপাল ও বাংলাদেশকে সংযুক্ত করেছে এবং সেই লক্ষ্যে যাবতীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার ও নেপালের সাথে সরাসরি সিল্ক রুটের যোগাযোগ নির্বিঘ্ন করার জন্য মহাপরিকল্পনা নিয়ে এই অঞ্চলে তারা সর্বোচ্চ বিনিয়োগ শুরু করেছে এবং সেই বিনিয়োগ নির্বিঘ্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক ও সামরিক বিষয়ে কৌশলগত অংশীদারিত্ব শুরু করতে চাচ্ছে।
বাংলাদেশকে নিয়ে বছর দশেক আগেও চীনের ভাবনা সাধারণ পর্যায়ে ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত অর্থনৈতিক অবস্থা, ভারত-চীন যুদ্ধ, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলে ভারতের খবরদারি, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধাবস্থা, কাশ্মির সঙ্কট ইত্যাদি কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন যেকোনো মূল্যে তাদের সামরিক আধিপত্য বিস্তার করতে চাচ্ছে। এসব অঞ্চলে চীনা বিনিয়োগ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সে কারণে চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্র ও স্থলভূমির যেসব এলাকাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কক্সবাজার, সিলেটের তামাবিল, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছোট সোনামসজিদ এলাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া অন্যতম।
চীন তাদের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যে মাস্টার প্লান তৈরি করেছিল তা অনেকটা কাটছাঁট করে ২০১৫ সালে এসে। তারা বাংলাদেশের কিছু রাজনীতিবিদ, দল এবং ক্ষমতাশালী লোকজনের মনোজগতের ওপর ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, ক্ষমতার লোভ, ক্ষমতায় যাওয়ার দুই নম্বরি ধান্ধা এবং দুর্নীতির কারণে কিছু লোক ভারতমুখী হয়ে রয়েছে। সুতরাং তাদের যদি চীনমুখী করতে হয় তাহলে ভারত যে ভোগ দিচ্ছে তার চেয়েও বেশি মাত্রার ভোগ না দেয়া পর্যন্ত কার্য সিদ্ধি হবে না। এই লক্ষ্যে চীনা গোয়েন্দারা একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এমন সব কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স অপারেশন শুরু করে যা কিনা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র, তাদের মাস্টারমাইন্ড ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং এই দুই সংস্থার গডফাদার সিআইএ কল্পনাও করতে পারেনি।
আমরা কমবেশি সবাই জানি যে, ২০১৮-১৯ সালের পুরোটা সময় ভারত বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন ব্যবস্থা, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি এমনভাবে প্রভাবিত করে রেখেছিল ঠিক যেমনটি এখন আওয়ামী লীগ করছে জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, তরিকত ফেডারেশনসহ বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যদের সাথে। সরকারের সুবিধাভোগী রাজভোগ ও চমচম খাওয়া মজনুরা যেভাবে ক্ষমতার কোলে মাথা রেখে সুখনিদ্রা যায় ঠিক সেভাবেই ২০১৮-১৯ সালের পুরোটা সময় এ দেশের ক্ষমতালোভীরা ভারতীয় গোয়েন্দাদের দেয়া আশ্বাস এবং নির্বাচনে সংসদীয় আসন ভাগাভাগির হারের ওপর নিশ্চিত বিশ্বাস স্থাপন করে একাদশ সংসদ নির্বাচনের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
উল্লিখিত পরিস্থিতির অন্তরালে চীনা গোয়েন্দারা যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল তা বাস্তবায়িত হওয়ার পর কেবল দিল্লি নয় খোদ ওয়াশিংটন পর্যন্ত বেকুব বনে গিয়েছিল। বাংলাদেশের একাদশ সংসদ নির্বাচন যেভাবে হয়েছে তা পুরো দায় প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামী লীগের ওপর পড়েছে এবং পরোক্ষভাবে ভারতের ওপর পড়েছে। এই নির্বাচনের সময় নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, নেতা-কর্মী, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের মধ্যে যে রসায়ন ঘটেছে যার গলিত রসের দুর্গন্ধ কিয়ামত পর্যন্ত আমাদের সমাজ সংসার, দেশ-কালে এবং রাজনীতিতে বিষবাষ্প ছড়াতে থাকবে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে যা হয়েছে তা ভারত খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছে না। দেশের মধ্যে যেসব ভারতীয় দালাল রয়েছে তারাও বুঝতে পেরেছে যে, চীন তাদের নাক এমনভাবে ভোঁতা করে দিয়েছে যে, জিন্দেগিতে আর ভারতের নাম মুখে নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অথবা ভারতবর্ষের অন্য কোথাও দালালি করে টুপাইস কামানো অথবা পাপিয়া-সম্রাটদের রঙ্গমহলে গিয়ে অবৈধ উপার্জনের কিল্লাফতে করা সম্ভব হবে না। ফলে চলমান সময় রাজনীতি এবং অর্থনীতি এমনভাবে চীনমুখী হয়ে পড়েছে যার জন্য চীনকে ভারতের মতো কোনো বদনামির শিকার হতে হচ্ছে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধ্বংস, নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়া, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কুক্ষিগত করা ইত্যাদি হাজারো দায় নিয়ে হররোজ গালি খাচ্ছে ভারত আর মজা লুটছে চীন। এ যেন বাংলার চিরায়ত প্রবাদের মতো- ‘খায়দায় চিকন আলী! মোটা হয় রমজান।’
উল্লিখিত অবস্থার ধারাবাহিকতায় এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজপথগুলোতে কী হচ্ছে তা আমরা কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু দিল্লির প্রাসাদে এবং ঢাকার বিশেষ ভবনের অভ্যন্তরে যে কী হচ্ছে তা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। দিল্লি যে তাদের দীর্ঘ দিনের তথাকথিত বিশ্বস্তদের আর বিশ্বাস করতে পারছে না; তা তাদের হাবভাব দেখলেই বোঝা যায়। তারা তাদের দোসরদের চীনমুখী হওয়ার জন্য অভিসম্পাতও করছে এবং ফিরিয়ে আনার জন্য বালখিল্যময় ভয়ভীতি দেখানোর নিমিত্তে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে, যা নিয়ে একধরনের অস্থিরতা শুরু হয়েছে সর্বক্ষেত্রে। এ অবস্থায় চীন কিছুই করছে না; কেবল ২০১৯ সালের মতো ঝোপ বুঝে কোপ মারার কূটনীতি বাস্তবায়নের জন্য অঙ্ক কষে ধীরলয়ে এগিয়ে চলেছে তাদের স্বপ্নের সিল্ক রুটের মহাসড়ক ধরে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য