চাই সুষ্ঠু সড়ক ব্যবস্থাপনা

নয়া দিগন্ত

– ছবি : সংগৃহীত

গত ২২ অক্টোবর সারা দেশে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয় জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। বাংলাদেশ অটোরিকশা হালকাযান পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনও দিবসটি পালন করে। যখন জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করছি তখন দেশে করোনা মহামারী ও ডেঙ্গুর প্রভাব চলছে। মহামারীতে প্রতিদিন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। করোনা মহামারীর কারণে অনেক মানুষের জীবন জীবিকা মানবেতর অবস্থায় পড়েছে। বিশেষ করে পরিবহন শ্রমিকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। করোনার ফলে পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করেছেন তারা।

লকডাউন চলাকালীন সময়ে সরকার পরিবহন শ্রমিকদের জন্য আলাদাভাবে অর্থ ও খাদ্য বরাদ্দ করেছে বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়। প্রথমে ত্রাণ মন্ত্রণালয় ২৩ কোটি ছয় লাখ ৭৫ হাজার টাকা, পরে প্রধানমন্ত্রী পাঁচটি প্যাকেজের মাধ্যমে পরিবহন শ্রমিকের জন্য তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন। কিন্তু ওই টাকা কোথায় গেল? এবং কিভাবে বিতরণ করা হলো? হালকা যান চালকদের কেন পরিবহন শ্রমিকদের আওতাভুক্ত করা হলো না? এই খাত থেকে সরকার বার্ষিক গড়ে প্রায় ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে। অথচ এই করোনা মহামারী দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকার শ্রমিকদের জন্য তেমন অর্থ ও খাদ্য বরাদ্দ করেনি। দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে সময়োপযোগী উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা। যে দেশে যোগাযোগব্যবস্থায় যত আধুনিক সে দেশ তত উন্নত। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সড়কের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে গন্তব্য পৌঁছে যাওয়া যায়, দেশে প্রায় ছয় লাখ অটোরিকশা, সিএনজি, পেট্রল, ডিজেল চালিত থ্রি-হুইলার চলাচল করে। ১৯৫৬ সাল থেকে এ ছোট যান চলাচল শুরু হয় এবং তা এখনও দেশের গ্রাম ও শহরে দিন-রাত যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করে আসছে। ১৯৬৯ সালে মরহুম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তি আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিল এসব হালকা যানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবহন শ্রমিকরা। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেক চালক অংশগ্রহণ করেন। তারা ১৯৯০-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভাষাসৈনিক অলি আহাদের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই শ্রমিকরা দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু এদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। কোনো কল্যাণমূলক কর্মসূচি নেই। দেশে পরিবহন শ্রমিকদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। তারা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে অবহেলিত।
দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিবহন শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। শ্রমিকরা নিজ উদ্যোগে প্রশিক্ষণ নিয়ে এ পেশায় সেবা দিয়ে আসছেন। গত ২২ অক্টোবর ছিলো জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। বেশ কিছু প্রাণের বিনিময়ে দিবসটি জাতীয়ভাবে পালনের স্বীকৃতি লাভ করেছে। যাদের প্রাণের বিনিময়ে এ দিবসটি স্বীকৃতি লাভ করেছে আমরা তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

সারা দেশের অটোরিকশা হালকা যানের সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ, চালকের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। অপরিকল্পিত মহাসড়ক ঘোষণার সময় অনেক মালিক-শ্রমিক অনেক প্রতিবাদ আন্দোলন করেছিলেন। তখন সরকারের বিভিন্ন মহল বলেছিল, যেখানে মহাসড়ক হবে সেখানে অটোরিকশা হালকা যান চলাচলের জন্য বাইলেন ও ডিভাইডার নির্মাণ করা হবে। সরকার অনুমোদিত থ্রি-হুইলার অটোরিকশা চলাচল বন্ধ হওয়ার ফলে এই শিল্পের সাথে জড়িত লাখ লাখ চালকের কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। যার ফলে চালকদের পরিবার শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং খাদ্যের কারণে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। গাড়ির কাগজপত্র নবায়ন, রেজিস্ট্রেশন, নামজারি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং নবায়ন করতে হলে বিআরটিএ অফিসে যেতে হয়। বিআরটিএ অফিস যেতে হলে মহাসড়ক ব্যতীত যাওয়া যায় না। নিরাপদ সড়কের জন্য দেশের সব মানুষের দাবি, আমরাও নিরাপদ সড়ক চাই। নিরাপদ সড়ক হলে দুর্ঘটনা কমবে এবং জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমে আসবে। এ বিষয়ে ফেডারেশনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছি। সড়ক দুর্ঘটনা নানা কারণে হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সড়ক ব্যবস্থাপনাই মূলত দায়ী। তাই দেশে নিরাপদ সড়ক করতে হলে সুষ্ঠু সড়ক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। এর কারণগুলো চিহ্নিত করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে। মহাসড়কের পাশে তিন চাকার ছোট গাড়ির জন্য বাইলেনসহ ডিভাইডার তৈরি করার কথা সরকারের উচ্চমহল থেকে বিভিন্ন সময় বহুবার বলা হয়েছে। ২০১৫ সালে তৎকালীন বিমানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া তিন চাকার গাড়ি মহাসড়ক থেকে উচ্ছেদ করা সঠিক হয়নি। এ ছাড়াও অনেক সংসদ সদস্য ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা শ্রমিকদের দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। কিন্তু নিছক আশার বাণী ছাড়া আমরা আর কিছুই পাইনি। ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে ফেডারেশনের ১০ দফা দাবিসংবলিত স্মারকলিপি ৩২টি জেলা থেকে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর দাখিল করা হয়েছে। এ ছাড়াও একাধিকবার মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, আলোচনা সভা, গোলটেবিল বৈঠক, সংবাদ সম্মেলন, টকশোর মাধ্যমে এ দাবি তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। শ্রমিকরা এখনো অনেক আশায় বুক বেঁধে আছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধ হওয়ায় গাড়ি দুর্ঘটনা কি কমেছে? বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ছোট গাড়ি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ১৫-২০ শতাংশ দায়ী। উল্লেখ্য, বিআরটি অফিস জেলা শহরে গাড়ির ফিটনেস, রোড পারমিট, নামজারি করতে হলে মহাসড়ক ব্যবহার ছাড়া বিআরটি অফিসে যেতে পারে না। কিন্তু মহাসড়কে গাড়ি গেলেই পুলিশ গাড়ি আটক করে। পাঁচ-সাত হাজার টাকা বিনা রসিদে জরিমানা করে। এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে লাখ লাখ গরিব অসহায় অটোরিকশাচালকদের পক্ষ থেকে আবারও চালককে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য মহাসড়কের পাশে বাইলেন ও ডিভাইডার নির্মাণ করে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো ও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জোর দাবি জানাচ্ছি। এক্ষেত্রে অটোরিকশা হালকাযান শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার কথা বিবেচনা করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা কাম্য। এ পরিবহন একটি সেবামূলক শিল্প, স্বাভাবিকভাবে এ শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা প্রত্যেকেই একজন সেবক। এ শ্রমিকরা প্রতিদিন নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এ শিল্পের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সরকারের কাছে ১০ দফা দাবি পেশ করা হয়েছে। শ্রমিকদের প্রত্যাশা, সব দিক বিবেচনা করে সরকার ১০ দফা দাবি অবিলম্বে মেনে নেবে।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অটোরিকশা হালকাযান পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন।
E-mail: batwfbd@gmail.com