চাই নিজস্ব শিকড়ের উপর আস্থা ও দৃঢ় অবস্থান

 আমার দেশ
৯ মার্চ ২০২৩

আরিফুল হক 

আরিফুল হক 

আরিফুল হক

ছেলেটা এসেছিল ‘সংস্কৃতি কথা’ নামের এক পত্রিকা থেকে আমার সাক্ষাতকার নিতে। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলো ‘স্যার আপনার ছেলে মেয়ে কয়জন?
বললাম, দু’জন!

নাম জিজ্ঞাসা করায় বললাম, মেয়ের নাম গুলরূখ হাসিন, ছেলের নাম সনজর আরিফ।
ছেলেটা মুখটিপে হাসল।
বললাম, হাসলে কেন?

কোনরকম ভনিতা না করেই ছেলেটা বললো,আপনার মত শিক্ষিত, প্রগতিশীল, আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ ছেলেমেয়েদের ওরকম বিজাতীয় নাম রেখেছেন শুনে হাসি পেল। বাংলায় তো কত সুন্দর সুন্দর নাম আছে স্যার।

ছেলেটির উপর রাগ করলাম না। বললাম বাবা তুমি সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা থেকে এসেছ। তোমার সাথে দু’চারটে কথা বলি।
তোমার নামটা কি?
ছেলেটি বললো ‘সুমন’।
তোমার বাবার নাম কি ?
ছেলেটি বললো ‘আজমত আলি’।
হেসে বললাম, দেখলেতো-তোমার আব্বার পরিচয় না জানলে তো বুঝতেই পারতাম না তোমাকে নমস্কার জানাবো নাকি আসসালামু আলাইকুম বলে আহ্বান জানাবো।

ছেলেটি বললো, আমি বাঙালী, বাঙালীত্ব আমার মূল পরিচয়।

বললাম, খাঁটি বাংলা ভাষায় যখন কথা বলছো, তখন তুমি যে মাড়োয়ারি নও, সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবে ভাষাভিত্তিক পরিচয়টাই তোমার আসল পরিচয় নয়। ভাষাভিত্তিক পরিচয় ছাড়াও তোমার আর একটা পরিচয় আছে, তোমার সাংস্কৃতিক পরিচয়। আর সেটাই তোমার আসল পরিচয়।
ছেলেটি বললো, বুঝলামনা স্যার।

হেসে বললাম, বোঝনা বলেই তো ‘সংস্কৃতি পত্রিকায়’ কাজ পেয়েছ, বুঝলে হয়তো পেতেনা।
শোন বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত উপমহাদেশ সহ পৃথিবীর বহুদেশের মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলে। বাঙালী নামে পরিচয়ও দেয়। তাদের সবার আচার আচরন কি তোমার মত? তোমার পাকঘরে যা রান্না হয়,তুমি যা যা খাও, সব বাঙালীর হেঁসেলে কি সে সব রান্না হয়? সবাই কি তোমার মত খায়? বিশেষ বিশেষ পালাপার্বনে তুমি সহ তোমার পরিবারবর্গ যে ধরনের পোশাক পর, সব বাঙালীই কি সেরকম পোশাক পরে? তোমার বাড়ীর মুরুব্বীরা যে ধর্মাচরন পালন করে সব বাঙালী কি সেভাবে পালন করে। তুমি যদি বিভিন্ন বাঙালী কম্যুনিটির সাথে মেলামেশা করে থাক তাহলে নিশ্চয় দেখে থাকবে, তাদের খাওয়া পরা থেকে ধর্মাচরন প্রথা সবকিছু ভিন্ন। সবার একরকম নয়। এই একরকম নয় বলেই সব বাঙালী এক নয়। তাদের যেরকম ভিন্ন পরিচয় আছে, তোমার মধ্যেও তেমনি ভিন্নতা আছে। তুমি বাঙালী হলেও তোমার একটা ভিন্নপরিচয় আছে। এই ভিন্ন পরিচয়ই তোমার আসল পরিচয়।

সুতরাং তোমার ওই ‘সুমন’ নামটা বাংলা ডিকসনারিতে যতই ফুল্লকুসুমিত শোভাবর্দ্ধনকারি নামই হোকনা কেন, তোমার আসল পরিচয়টাকে আড়াল করে দেয়।
তোমার খাওয়ায়, পরায়, চলনে, বলনে, বিয়ে শাদীতে, আইনে কানুনে যে ভিন্নতাআছে, সেটাই তোমার সাংস্কৃতিক পরিচয়। এই সাংস্কৃতিক ভিন্নতা তোমাকে আলাদা ট্রাডিশন দিয়েছে, আলাদা ইতিহাস দিয়েছে, আলাদা দেশ দিয়েছে। তুমি স্বাধীন দেশের মানুষ, সেই স্বাধীন দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় তোমার নামে, পোষাকে, খ্যাদ্যাভাসে, চলনে বলনে ফুটে উঠবে তবেইতো তোমার স্বাধীনতা সার্থক হবে, গৌরবময় হবে, দৃশ্যমান হবে।

তোমার বয়স অল্প। তোমাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারন তোমরা জাননা যে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের হাজার হাজার শহীদানের জীবনদান কিছু পরমুখো বেইমান মীরজাফর বিদেশী শক্তির কাছে বন্দক রেখে নিজেদের সুখশান্তি খরিদ করেছে। আমাদের স্বাধীনতা আমাদের হয়ে উঠতে পারেনি। যার ফলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সমাজ কাঠামো, শিক্ষাব্যবস্থা, জাতিয় পরিচয়,ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্মচর্চা সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেছে। একটা নতুন দেশ হল! কেন হলো ? কাদের জন্য হলো? কি উদ্দেশ্য নিয়ে হল কেউ জানতে পারতে পারলনা ।

মানুষ বুঝল স্বাধীনতা মানে জীবনদান, রক্তপাত, শোক, কান্না হাহাকার এগুলোকেই চিরস্থায়ী ভাবে আপন করে নেয়া। স্বাধীনতা তাদের কাছে ভয়াবয় আর্তনাদ হয়েই থেকে গেল।

মানুষ বুঝতেও পারলনা তার দেশ, তার স্বাধীনতা “Coquer without War“ হয়ে গেছে। অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরে লালিত Cultural Aggression মাধ্যমে দেশ বিদেশি শক্তির দখলে চলে গেছে।

সৈন্য পাঠিয়ে দেশ জয় করার ঝক্কি এখন অনেকটা কমে গেছে। এখন শুরু হয়েছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ধারা। যার মাধ্যমে উপনিশেববাদিরা নানান উপায়ে দেশের মানুষদের এমনভাবে গড়ে তোলে যে, তাদের মধ্যে সংস্কারবদ্ধতা, শিকড়হীন অস্তিত্ব, কমপোটিলনইজম, শিল্পের অনুকরনবাদ, মেটাফিজিক্যাল অবসন্নতা,ধর্মহীনতা,স্বদেশের প্রতি অনাস্থা, প্রভৃতি রোগগুলো ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে স্বনির্ভর, স্বাধীন দেশের মানুষগুলো হীনমন্যতাবোধ সম্পন্ন দাস স্বভাবের হয়ে পড়ে। তাদের প্রতিরোধশক্তি থাকেনা, এমনকি আত্মরক্ষার পাঁচিল পর্যন্ত গুঁড়িয়ে যায়। সাংস্কৃতিকভাবে পরাভূত জাতি, ‘ওদের সব ভাল, আমাদের কিছু নেই’ এইধরনের হীনমন্য হয়ে পড়ায় স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলে। সেজন্যই, রাজনৈতিক বা সামরিক পরাজয় থেকে দেশউদ্ধার সম্ভব, কিন্তু সাংস্কৃতিক পরাজয় ঘটে গেলে দেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার শুধু কঠিন হয়না, অসম্ভব হয়ে পড়ে।

দীর্ঘদিন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করার ফলে আমার এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, সুস্থ সংস্কৃতিই,সুস্থ মানুষ গড়ার আর্ট। যা সুস্থ সমাজ ও ও সুন্দর দেশ গড়তে সহায়ক।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত জন্মলগ্ন থেকে সেক্যুলার রাষ্ট্র পরিচয় দিয়ে এলেও তারা তাদের রাষ্ট্রীয় মনোগ্রামে, ব্রম্ভা, বিষ্ণু , মহেশ্বর তিন হিন্দু দেবতার ‘ত্রিমূর্ত্তি’ কে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশ ৯০%একক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ। যাদের জীবনদর্শন ‘তওহীদ’ সঞ্জাত অর্থাৎ আল্লাহর একত্তবাদে বিশ্বাসী। আমাদের রাষ্ট্রীয় মনোগ্রাম থেকে শুরু করে সকল রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক প্রকাশভঙ্গীমায় একেশ্বরবাদী অর্থাৎ তওহীদবাদী বেস বা ছাপ থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের চলনে বলনে আচারে ব্যবহারে কোথাও কি দেখছ সেরকম? কোথাও তওহীদের অস্তিত্ব নেই। সর্বত্রই ধারকরা,নকল। দেশের জাতীয়সঙ্গীত থেকে মানুষের নাম, উপাধি,পোষাক, জাতীয় উৎসব পর্যন্ত সব ধারকরা সব নকল। যেন আমরা কিছুই পারিনা, কোন যোগ্যতাই আমাদের নেই। এটারই নাম Cultural Pollution বা কালচারাল বিষক্রিয়া। পুরা জাতি আজ কালচারাল বিষক্রিয়ায় অবশ অবসন্ন হয়ে পড়েছে। একটা স্বাধীন জাতির নতুন কোন উদ্ভাবন নেই, কোন সৃষ্টি নেই ।

ছেলেটিকে বললাম, শোন বাবা। তোমার পূর্বপুরুষরা সর্নোজ্জ্বল নয়, এক হীরকোজ্জল অতীত রেখে গেছেন, তোমাদের জন্য। সে অতীত কল্পনার পৌরানিক কাহিনী নয়, বাস্তব ভিত্তিক জীবন্ত ইতিহাস। তোমাদের তো কারও কাছে ধারকরা বা কারও নকল করার কথা নয়।

তোমাদের অর্জনের গর্ব হিমালয় সদৃশ দিগন্ত বিস্তৃর্ণ।
তোমার রাজধানী ঢাকা ১৯৭১ সালে সৃষ্টি হয়নি। বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন রাজধানী শহর ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, কলিকাতা, মধ্যেই ঢাকাই সুপ্রাচীন। ১৬০৮খৃঃ ঢাকা রাজধানীর গৌরবলাভ করেছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর সেই গৌরব ধারন করে ‘লালবাগদূর্গ’ আজও মাথা উঁচুকরে দাঁড়িয়ে আছে। তোমার দেশের ১লক্ষ৩২হাজার মসজিদের স্থাপত্যকলা, নকশা, সূক্ষ্ম-ছন্দোময় ক্যালিওগ্র্যাফী তোমার উন্নত স্থাপত্ত্য ঐতিহ্যের কথা স্মরন করিয়ে দেয়। তোমার বয়ন শিল্প মসলিন আজও বিশ্বের বিষ্ময় হয়ে আছে।
১৪ শতাব্দীর কবি শাহ মহম্মদ সগীর, ১৬ শতাব্দীর সৈয়দ সুলতান, আলাওল থেকে শুরু করে মীর মশাররফ হোসেন উনবিংশ শতাব্দীর রেঁনেসাঁর কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীবাংলার কবি জসিমুদ্দিন , সাতসাগরের মাঝি ফররূখ আহমদের কাব্য সূষমা তোমার কাব্য সাহিত্যের ঐতিহ্য।

তোমার সংগীত ঐতিহ্য ১৩শ শতকের মহামনীষী হজরত আমীর খসরু থেকে শুরু হয়ে সংগীত সম্রাট আলাউদ্দিন খান, বিশ্বনন্দিত সরোদীয়া আলিআকবর খান, আয়াত আলি খান বিশ্বময় বিকশিত। তোমার ফোকলোর মাঠে-ঘাটে, নদীতে ছড়িয়ে থাকা ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী দেহতত্ত্ব, মুর্শিদা, লালন হাসনের নান্দনিক সুরমূর্ছনা আজও বিশ্বের গবেষনার বিষয় ।

তোমার নৃত্য ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে অনন্য নৃত্যশিল্পী বুলবুল ইসলামের ‘আনার কলি’ নৃত্যনাট্যের নৃত্যমহিমাকে ঘিরে ।

তোমার নাট্য ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে আছে প্রায় দু’শ বছরের ইতিহাস কে ধারন করে। দীনবন্ধু মিত্রের সাড়াজাগানো নাটক ‘নীলদর্পন’ নাটকটি ১৮৬০ সালে,‘কস্যচিত পথিকস্য’ ছদ্মনামে ঢাকা থেকেই প্রথম প্রকাশিত হয়, এবং ১৮৬১ সালে ঢাকাতেই প্রথম অভিনয়ের গৌরব লাভ করে।

আজকে যেখানে জগন্নাথ কলেজ, ১৮৬২ সালে সেখানেই ইস্টবেঙ্গল ড্রামাটিক ক্লাব নামে একটি নাট্যশালা ছিল। সেখানে মানুষ টিকেটকেটে নাটক দেখত। টিকেটের হারও ছিল বেশ উচ্চ মূল্য যথা, ৪টাকা, ২টাকা ও ১টাকা। এছাড়াও মুসলমানরা নিজেদের আশা-আঙ্খার, প্রত্যাশার রঙ দিয়ে নিজেদের নাটক লিখেছেন। যেমন-আকবরউদ্দিন খানের নাটক, সুলতান মাহমুদ,আজান। শাহাদাত হোসেন সরফরাজ খাঁ প্রভৃতি আরও অনেক ঐতিহ্য সচেতন নাটক। বাংলার মুসলমানদের ঈদ উৎসবের মোহনীয় সাজসজ্জা ও খোলা মাঠে নামাজের দৃশ্য বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষন করে নিয়ে আসতো ।

তোমার পূর্বপুরুষরা তোমাদের শুধু স্বাধীনতাই দিয়ে যাননি, তারা তোমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির গৌরবও দিয়ে গেছেন, তোমাদের নিজস্ব Identity বা পরিচিতি দিয়ে গেছেন। তোমরা অনাথ নও,পরবশ্য নও। তোমাদের অনাথ করে রাখা হয়েছে। তোমাদের সমুজ্জ্বল অতীত ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার নামে তোমাদের অনাথআশ্রমে ভরা হয়েছে, অনাথআশ্রমের পাঠ পড়ানো হচ্ছে। তোমাদের অতীত কুয়াশাছন্ন করে দেয়া হয়েছে। তোমরা নিজের মধ্যেই খন্ডিত হয়ে আছ ।
আজ চাই আত্মদর্শন। আজ চাই স্বাধীন চিত্তের বিকাশ। চাই নিজস্ব শিকড়ের উপর আস্থা ও দৃঢ় অবস্থান! তোমার মূল শিকড়ই তোমার ধর্ম ও সংস্কৃতি। শিকড়ের উপর যার অবস্থান দৃঢ় হয়, শত ঝড়েও তাকে উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। ছেলেটা শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকলো।

লেখক: প্রবীন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, নাট্যকার, গবেষক ও বহু গ্রন্থের লেখক