স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে
১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, সোমবার
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্যাম্পাস সংলগ্ন জোবরা গ্রামের স্থানীয়দের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, দুই সহকারী প্রক্টরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। শনিবার রাত ১২টার দিকে ক্যাম্পাসের দুই নম্বর গেট এলাকায় বাসায় প্রবেশের সময় ওই ভবনের দারোয়ান এক ছাত্রীকে মারধর করে। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে গেলে ছাত্রীদের ওপর সংঘবদ্ধ হয়ে হামলা চালায় এলাকাবাসী। এ ঘটনার পর থেকে ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। স্থানীয়রা পুলিশের গাড়িতে হামলা চালায়। তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর, নিরাপত্তা দপ্তরসহ বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য গাড়ি ভাঙচুর করে। শনিবার রাত থেকে শুরু হওয়া এ সংঘর্ষ রোববার বিকাল পর্যন্ত চলতে থাকে। স্থানীয়রা বিভিন্ন আবাসিক ভবনের ছাদে শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে ফেলে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে। যাদের সবাইকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছে। এ ঘটনায় নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ জড়িত বলে অভিযোগ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। স্থানীয় বাসিন্দা বিএনপি’র এক কেন্দ্রীয় নেতাও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের মদত দিয়েছে। যাকে এরইমধ্যে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় বিএনপি। সংঘর্ষের কারণে রোববার সকল ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ প্রতিবেদন প্রস্তুত করার সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করেছে।
এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন। সোমবার দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকবে। রোববার বেলা তিনটার দিকে হাটহাজারী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. মো. টিপু সুলতান বলেন, শনিবার রাত থেকে আনুমানিক শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। ৩-৪ ধাপে চমেকে ৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া অনেক শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমরা সব হিসাব করতে পারিনি। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর গায়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। এদের মধ্যে গুরুতর আহত অনেকে আইসিইউসহ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে: বিশ্ববিদ্যালয়ের ২নং এলাকায় অনেক ভবনে শিক্ষার্থীরা ভাড়ায় থাকেন। শনিবার রাত ১১টার দিকে বাসায় প্রবেশের জন্য আসেন সুফিয়া খাতুন নামে এক শিক্ষার্থী। দেরিতে আসার অজুহাত দেখিয়ে ওই ছাত্রীকে রাত ১২টা পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রাখেন ওই ভবনের দারোয়ান স্থানীয় বাসিন্দা। ওই ছাত্রী প্রতিবাদ জানালে একপর্যায়ে গেট খুলে ওই ছাত্রীকে মারধর করে দারোয়ান। পরে ওই ছাত্রী তার কয়েকজন সহপাঠীকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানায়। তারা এসে দারোয়ানের ওপর চড়াও হন। তারা দারোয়ানকে আটকানোর চেষ্টা করলে সে দ্রুত ওই বাসা থেকে বের হয়ে যান। ছাত্রীকে মারধরের খবর ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের ভবনে থাকা আরও শিক্ষার্থী সেখানে জড়ো হন। এ সময় ওই দারোয়ানের পক্ষে থাকা লোকজন শিক্ষার্থীদের দিকে তেড়ে যায় এবং ইট-পাটকেল মারা শুরু করেন। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী সাফিয়া খাতুন বলেন, আমাদের বাসার গেট রাত সাড়ে ১১টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। কাজে বাইরে গিয়েছিলাম, ১১টার দিকে ফিরে এসে দেখি গেট বন্ধ। আমি অনেকবার ধাক্কা দিয়েছি, কিন্তু দারোয়ান গেট খুলছেন না। আমার রুমমেটরাও দারোয়ানকে গেট খুলে দিতে অনুরোধ করেছে, কিন্তু দারোয়ান খোলেনি। পরে গেট খুলে আমাকে উদ্দেশ্য করে খারাপ ব্যবহার করে। ভেতরে ঢুকতে না দিয়ে দু’বার আমাকে ধাক্কা দেয়। জোর করে ঢুকতে চাইলে তিনি আমাকে লাথি ও থাপ্পড় মারে।
মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে জড়ো করা হয় স্থানীয়দের: ঘটনাস্থলে উপস্থিত একাধিক শিক্ষার্থী জানান, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা শুরুর পরপরই ওই এলাকায় বিভিন্ন মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয়া হয় এলাকাবাসী যেন দা, কিরিচ নিয়ে বের হয়ে আসে। এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসীরা নাকি হামলার জন্য এসেছে। এমন ঘোষণার পরপরই জোবরা গ্রামের হাজারো মানুষ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বাসা থেকে বের করে কোপানো শুরু করে। হামলার সময় দুই নম্বর গেট এলাকার পূর্বপাশে বাচামিয়ার দোকানের সামনে আহত সহপাঠীদের উদ্ধার করতে যায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাদের চোখে টর্চ লাইটের আলো ফেলে হামলা করা হয়।
হামলায় জড়িতদের হাতে ধারালো অস্ত্র: জোবরা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে রামদা, কিরিচ ও ছোরা দিয়ে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ক্যাজুয়েলিটি বিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের পিঠে, পেটে, হাত ও মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত। কর্তব্যরত চিকিৎসক জানিয়েছেন, প্রায় ৪০ জনের বেশি শিক্ষার্থীর শরীরে বিভিন্ন অঙ্গে সেলাই প্রয়োজন হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে এ হামলায় তারা ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছে। শত শত লোকের হাতে ধারালো অস্ত্র তাৎক্ষণিক আসার কথা নয়। এ হামলার জন্য পরিকল্পনা ছিল বিধায় তাদের প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় আলাওল হলের পূর্বদিকের ধানী জমিতে ফেলে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে উপর্যুপরি কোপানো হয়। এসব ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আবুল কাশেম নামে জোবরা গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম স্থানীয় নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগকে গ্রেপ্তার ও তাদের বিচার করতে। হানিফ বাহিনী, শামিম বাহিনী, আ জ ম নাছির বাহিনী ও মহিউদ্দিন বাহিনীর ক্যাডাররা এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। তারা নিরীহ ছাত্রদেরকে মেস থেকে বের করে পিটিয়েছে।’
কুপিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের: দেশীয় ধারলো অস্ত্র হাতে শিক্ষার্থীদের কুপিয়ে আহত করে অনেক ভবনের ছাদে তুলে শিক্ষার্থীদের ফেলে দেয়া হয়েছে। এমন নির্মম ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে আর ঘটেনি বলে জানিয়েছে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ছাদ থেকে ফেলে দেয়ার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, এক শিক্ষার্থীকে ছাদে তুলে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। কয়েকজন মিলে তাকে ছাদের কিনারায় নিয়ে যায়। এরপর একজন তাকে পেছন থেকে লাথি মেরে ছাদ থেকে ফেলে দেয়। এ ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
সংঘর্ষ থামাতে গেলে আহত হন প্রক্টর, দুই উপ-উপাচার্য: রোববার সকালেও জোবরা গ্রামের স্থানীয়রা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের ওপর হামলা শুরু করে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় উপ উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিন, উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. শামীম উদ্দিন খান, প্রক্টর প্রফেসর ড. তানভীর হায়দার আরিফ, নিরাপত্ত প্রধান, ১০-১২ জন নিরাপত্তা প্রহরী আহত হন। এ সময় স্থানীয়রা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর তানভির হায়দার আরিফের গাড়ি ভাঙচুর করে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিন, উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. শামীম উদ্দিন খান স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাদের ওপরও হামলা চালানো।
হামলার নেতৃত্ব দেয় ছাত্রলীগ, উস্কানি দেয় বিএনপি নেতা: শনিবার রাত থেকে শিক্ষার্থীদের শিবির ট্যাগ দিয়ে বিএনপি স্থানীয় কিছু নেতা হামলায় উস্কানি দিয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকায় বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য উদয় কুসুম বড়ুয়াকে প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। রোববার বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা করেছে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। তারা হেলমেট পরে আমাদের ছাত্রদের ধরে ধরে কুপিয়েছে। আমরা রাত থেকে প্রশাসনের সঙ্গে অনেক যোগাযোগ করেও তেমন কোনো সহযোগিতা পাইনি। আমাদের শত শত শিক্ষার্থী মেডিকেলে কাতরাচ্ছে। এদিকে জোবরা এলাকায় স্থানীয়রা জানায়, যুবলীগ নেতা হানিফের অনুসারী সন্ত্রাসীরা সরাসরি ধারালো অস্ত্র হাতে এ হামলায় অংশ নেয়। গত বছরের ৫ই আগস্টের পরও হানিফের নেতৃত্বে ছাত্রদের ওপর হামলা হয়।
শিক্ষার্থীদের ওপর সবসময় আগ্রাসী জোবরার লোকজন: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রাম। এ গ্রামের লোকজন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সিএনজি অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের কারও কারও দোকানপাটও আছে বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায়। বড় একটি অংশ চাকরিও করে বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবার স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ, যুুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক টেন্ডারবাজিতে জড়িত। মূলত এই অংশটিই নিজেদের প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার ধরে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায় নানাভাবে। বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের সংঘর্ষের অংশ নেয় জোবরার এই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাও চালিয়েছে তারা। এমনকি তাদের হাতে খুনও হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র। ২০১০ সালের ১৫ই এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমসের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আসাদুজ্জামানকে খুন করে জোবরা গ্রামের যুবলীগের সন্ত্রাসীরা। সবশেষ গত বছরের ২১শে অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) শিক্ষার্থীদের ওপর যুবলীগের হানিফ বাহিনী হামলা চালায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশন এলাকায় তারা শিক্ষার্থীদের ওপর কয়েক রাউন্ড গুলি করে, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে রেলগেট এলাকায় যায়। এ সময় এলাকাবাসীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়।