চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জে বেকারত্ব বাড়াতে পারে

  • মাজহারুল ইসলাম শামীম
  •  ০৬ আগস্ট ২০২২, ২০:৪৬, আপডেট: ০৬ আগস্ট ২০২২, ২০:৪৬
চতুর্থ শিল্প শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জে বেকারত্ব বাড়াতে পারে – ছবি : সংগৃহীত

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (বা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০) হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্বয়ংক্রিয়করণ , উন্নত যোগাযোগ এবং স্ব-পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমস্যার বিশ্লেষণ এবং নিরুপণ করতে সক্ষম স্মার্ট মেশিন তৈরী করার জন্য বড় আকারে মেশিন-টু-মেশিন যোগাযোগ (এমটুএম) এবং ইন্টারনেট অব থিংসকে (আইওটি) একসাথে করা হয়েছে।

আমরা জানতাম, দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের পর তৃতীয় পেরিয়ে আমরা পা ফেলেছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দরজায়। কিন্তু অধ্যাপক ক্লাউস শোয়াব বলছেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিপ্লবের সুফল এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সব মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। তার হিসাবে দ্বিতীয় বিপ্লব এখনো বিশ্বের ১৭ শতাংশ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। কারণ, পৃথিবীর ১৩০ কোটি মানুষ এখনো বিদ্যুৎ পায়নি।

তার মতে, তৃতীয় বিপ্লবও এখন পর্যন্ত বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের কাছেই অধরা, কারণ ৪০০ কোটি মানুষ এখনো ইন্টারনেট-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অবশ্য এ কারণে সভ্যতার বিকাশে শিল্পবিপ্লবের অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই।প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনের মাধ্যমে। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব ঘটে বিদ্যুৎশক্তি ও প্রযুক্তির উত্কর্ষ কাজে লাগিয়ে বর্ধিত উৎপাদন নিশ্চিত করে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের চালিকাশক্তি ছিল পারমাণবিক শক্তি, টেলিযোগাযোগ, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবস্থা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছে প্রযুক্তির সঙ্গে জৈব অস্তিত্বের সংমিশ্রণে এক নতুন সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে। ইতিমধ্যে রোবটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট, ন্যানো প্রযুক্তি যে অভাবনীয় পরিবর্তনের সূচনা করেছে, তাতে এই বিপ্লবের ব্যাপ্তি ও প্রভাব সম্পর্কে ধারণা করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ২০১৬ সালের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে বর্তমান ডিজিটাল দুনিয়ার কিছু চমকপ্রদ তথ্য দেওয়া হয়েছে। যেমন ইউটিউব দেখা হয় দৈনিক ৮৮০ কোটি বার, ই-মেইল পাঠানো হয় ২০ হাজার ৭০০ কোটি, আর গুগল সার্চের সংখ্যা ৪২০ কোটি। এটি বদলে যাওয়া পৃথিবীর জীবনযাপনের চলমান চিত্রমাত্র।

কিন্তু এত বেশি বেশি প্রযুক্তির অগ্রগতি মাঝেও কিছু কিছু উন্নয়নশীল দেশগুলো চতুর্থ শিল্প বিল্পবের জন্য প্রস্তুত কি না তার সন্দেহ থেকে যায়। যেমনটা, বাংলাদেশে এখন জনসংখ্যার একটা বড় অংশ তরুণ ও কর্মক্ষম অর্থাৎ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পর্যায়ে। এর সুবাদে বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই চতুর্থ বিপ্লবের রূপান্তর প্রক্তিয়াগুলোর মধ্যে দিয়ে কিংবা এর প্রভাববলয়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হবে। এ জন্য দরকার বহুমুখী কৌশলগত, কারিগরি ও অবকাঠামোগত প্রস্তুতি। এ নতুন শিল্পবিপ্লব থেকে বাংলাদেশকে উৎপাদনশীলতার সুফল নিতে হবে, বৈদেশিক রপ্তানি আয় বাড়ানোর সুযোগ নিতে হবে, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হবে।

এসব দিকে পিছিয়ে পড়া মানে সুফলগুলোর বুমেরাং হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ সুযোগটা নিয়ে যাবে অন্য কোনো দেশ আর আমরাও হারাব আমাদের গতানুগতিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো। সুতরাং সুফল ঘরে নিতে চাইলে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে কৌশলগতভাবে এগিয়ে নিতে হবে। অর্থাৎ বিদ্যমান স্বল্প দক্ষ শ্রমবাজারকে নতুন দক্ষতার শ্রমবাজার ও কর্মসংস্থানের উপযোগী করে গড়ে নিতে হবে। এই চ্যালেঞ্জে উতরাতে না পারলে নতুন শিল্পবিপ্লব আমাদের ফেলেই এগিয়ে যাবে।

পরিসংখ্যান বলে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগাতে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। মোট জনসংখ্যার ৫৮.৫% অর্থনীতিতে ক্রিয়াশীল এবং তাদের মধ্যে মাত্র ৫.৩% বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষিত। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের মাত্র ০.৩% কর্মসংস্থান হয়েছে। নতুন করে আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বিপুলসংখ্যক দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ও জোগানের বিষয়টি আলোচিত হয়। এ দেশে মেধাবী, দক্ষ ও সম্ভাবনাময় তরুণ রয়েছে। কিন্তু এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন অনুযায়ী গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। ব্যক্তি নিজে চাইলেই দক্ষতা বাড়াতে পারে না।

বরং দক্ষতা বাড়াতে প্রয়োজন হয় গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের। এ প্রশিক্ষণের প্রথম ধাপ প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু হতে হয়। তারপর মাধ্যমিক ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শক্তিশালী এবং উচ্চশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে পরিণত হয়। এ ক্ষেত্রে কর্মক্ষম জনশক্তির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য গুণগত প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। প্রয়োজন সরকারি বিনিয়োগ ও ব্যক্তি খাতের পৃষ্ঠপোষকতা।

আজকে আমাদের দেশের অধিকাংশ দেশী এবং প্রবাসীরা অদক্ষ এবং অশিক্ষিত। এখানে শিক্ষিত বলতে নিজের নাম লিখতে পারা বা শুধু একাডেমি সার্টিফিকেট অর্জন করাকে বুঝাচ্ছি না। শিক্ষিত বলতে মানসম্মত গুণগত শিক্ষা কে বুঝাচ্ছি। আজকে আমাদের দেশের গ্রামে অধিকাংশ পরিবার মনে করে ছেলেদের কে টাকা আয়ের চাকা। তারা একটু বড় হলেই তাদের প্রবাসে বা দেশে বিভিন্ন শ্রমিক পর্যায়ে কাজে লাগিয়ে দেয়।যেটা অন্তত্য দুঃখজনক। কেনো এমনটা করতে হবে।এদের কে দিয়ে যদি আমরা উচ্চ শিক্ষিত করতে পারি।এদের মাথার মস্তিষ্কের শক্তি দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বৈধ উপায়ে আয় করার তো সুযোগ আছে।তাহলে তাকে আমরা কেনো শারীরিক পরিশ্রমের দিকে ঠেলে দিতেছি।

এবার আসি গ্রামীণ মেয়েদের কথায়।গ্রামে অধিকাংশ পরিবারের ধারণা, মেয়েরা বড় হলেই একটু তাদেরকে বিয়ে দিয়ে পরিবারের চাপটা কমাতে হবে।এই কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ততই ভালো।কবে আমরা এই ভুল ধারণা থেকে বাহির হবো? নেপোলিয়ন বলিছেন, ‘তুমি আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও,আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি উপহার দিবো।’ তাহলে আজকে সে শিক্ষিত মা কোথায় থেকে তৈরি হবে! তাদেরকে শিক্ষিত হওয়ার আগে বিয়ের জন্য প্রস্তুতি করা হয়।এরপর তাদের থেকে পুরো একটা জাতি কে অন্ধকারে থাকতে হয়।কারণ, আমরা আমাদের জীবনের প্রথম ভাষা শিখি মায়ের কাছ থেকে, আমরা আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা পেয়ে থাকি মায়ের কাছ থেকে। আজকে যদি সে মা ই অশিক্ষিত হয়,তাহলে এই জাতির ভবিষ্যত কি!

আমরা কখনও এটা চিন্তা করি না যে,আমরা অন্যের অধীনে চাকরি না করে,অন্য জনকে চাকরি দিবো।
আমরা এটা কখনও চিন্তা করি না যে, আমরা কখনও নিজের হাত, পা দিয়ে অন্যের মাথার মস্তিষ্ক শক্তির অধীনে চাকর হয়ে থাকবো না।

আমরা বুঝি শিক্ষার মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার পথটা জটিল এবং দীর্ঘ প্রতীক্ষার।সেজন্য আমরা তাড়াতাড়ি বড় লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে এসব শর্টকাট পথ বেঁচে নি।আসলে এই শর্টকাট পথ কতটা আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আছে তা কি ভেবে দেখেছেন? কবে হুঁশ হবে আমাদের এই জাতির? কবে এরা বুঝবে এদের মস্তিষ্কের শক্তি দিয়ে দেশ এবং জাতির উন্নয়ন করা সম্ভব।

যখন পৃথিবীতে ঘটতে থাকবে অভাবিত সব অটোমেশন, দূর নিয়ন্ত্রিত কিংবা স্মার্ট ফোন ও স্মার্ট ডিভাইস-কেন্দ্রিক সহজিয়া ব্যবস্থাপনা। এত সব উৎপাদন সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনাগত উন্নতির বিপরীতে আমাদের কৃষি, শিল্প, বিপণন ও পরিবহন ব্যবস্থা, শ্রমবাজার পিছিয়েই আছে।তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিভাবে হবে। আর সেই জায়গায় যদি আমাদের শ্রমশক্তির অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত এবং অদক্ষ হয়ে থাকে এই শ্রমশক্তি দিয়ে কি হবে।এরা তো যখন বিশ্বব্যাপী চতুর্থ শিল্প বিল্পবের মতো ঘটনা ঘটবে তখন এরা সবাই বেকার হবে। এদের কে দিয়ে শুধু শারীরিক পরিশ্রম ছাড়া আর কিছু পাবে না। অথচ,যেখানে চতুর্থ শিল্প বিল্পব বলতেছে তখন প্রয়োজন হবে মস্তিষ্কের শক্তি। যার যত মস্তিষ্কের শক্তি থাকবে সে ততই এগিয়ে থাকবে। আমরা কি মস্তিষ্কের শক্তি নিয়ে প্রস্তুত আছি চতুর্থ শিল্প বিল্পবের মোকাবেলা করতে?? এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

তাই আমাদের কে এখনই স্পষ্ট করতে হবে যে কোথায় কোথায় আমাদের সম্ভাবনা বাড়বে এবং কোথায় কোথায় বর্তমানের অর্জনগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। আমাদের অবকাঠামোগত ও কৌশলগত পরিকল্পনা এবং শিক্ষা, শিল্প উৎপাদন ও বাজার বিকাশের দিক থেকে আমাদের প্রস্তুতিগুলোই বা কেমন হওয়া দরকার, তা জানা।

এক কথায় বলতে গেলে, পূর্বের সকল শিল্প বিপ্লবগুলোর মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল কৃষি, প্রাণিশক্তি, রাজনৈতিক শক্তি, ভৌগোলিক পরিবর্তন ইত্যাদি। কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লব অনেকাংশেই ভিন্ন। অন্যান্য শিল্প বিপ্লবের সাথে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লব শুধুমাত্র মানুষের শারীরিক পরিশ্রমকে প্রতিস্থাপন করেছে; কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক বা মস্তিষ্কের পরিশ্রমকে প্রতিস্থাপন করবে।

অন্যদিকে চতুর্থ শিল্প বিল্পবের জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে তৈরি হওয়ার কথা ছিলো তা হয় নি।যা আমাদের সম্ভাবনা কে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন বৈশ্বিক সূচকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাঙ্কিং একেবারে গ্রহণযোগ্য নয়। সর্বশেষ টাইমস হায়ার এডুকেশন র‌্যাঙ্কিং ২০২২ অনুসারে, দেশের মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বব্যাপী র‌্যাঙ্কিংয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (৮০১-১০০০), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (১০০১-১২০০) ও বুয়েট (১২০১+)।

২০২২ সালে এশিয়া র‍্যাঙ্কিংয়ে দেশের ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই যদি হয় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন তাহলে আমাদের ভবিষ্যত কি? আজকে আমরা যদি চিন্তা করি বাংলাদেশে সবচেয়ে বহুল শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি? উত্তর হলোঃ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। আজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে লাক্ষ লাক্ষ শিক্ষার্থী বেকারত্বের অভিশাপে ভুগতেছে।এরা না জানে কোনো কারিগরি শিক্ষার দক্ষতা, না জানে ভালো একাডেমি পড়াশোনা, না জানে ভালো উদ্ভাবনী দক্ষতা। তাহলে এত বৃহৎ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত কি শুধু সার্টিফিকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। তাহলে এরা জীবনের বড় একটা অংশ কেনো শিক্ষার নামে ব্যয় করতেছে? চতুর্থ শিল্প বিল্পব হলে এদের অবস্থান কি হবে? এরা যাবে কোথায়? তাই আমাদের অবশ্যই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চতুর্থ শিল্প বিল্পবের মুখী করে গড়ে তুলতে হবে।

আমাদেরকে ব্যবহারিক শিক্ষায় জোর দিতে হবে,বের হয়ে আসতে নকল এবং মুখস্থ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে।আমাদের কে কর্মমুখী শিক্ষার দিকে যেতে হবে। আরও যেতে প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার দিকে।যেখানে চতুর্থ শিল্প বিল্পবের মূল বক্তব্য হচ্ছে, পুরো বিশ্ব কে একটা গ্রাম হিসেবে কল্পনা করে কাজ করা হবে।তাহলে প্রযুক্তির ব্যবহার জানা অবশ্যই প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষার্থীরা যারা আগামীর ভবিষ্যত তারা কতটুকু প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন! আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্বল র‍্যাঙ্কিংয়ের একটি প্রধান কারণ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। দেশের দুটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে এটি মাত্র ৩ ও ০ শতাংশ। পক্ষান্তরে, বেশির ভাগ অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী রয়েছে। বিদেশি শিক্ষার্থী থাকলে প্রতিবছর বিলিয়ন ডলার আয় হয় এবং র‌্যাঙ্কিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

আমাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম পুরোনো। প্রায়ই প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে সেটা তৈরি বা হালনাগাদ হয় না। বিসিএসকেন্দ্রিক শিক্ষা আমাদের দীর্ঘ মেয়াদে সাহায্য করবে না। একাডেমিয়া ও ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে একটি বড় ব্যবধান স্পষ্ট এবং আমাদের পাঠ্যক্রমে এটির সমাধান করতে হবে। একটি স্নাতক বা স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামের শেষ বছরে শিক্ষার্থীদের ইন্ডাস্ট্রিতে অনুশীলনের সঙ্গে আরও বেশি যুক্ত হওয়া উচিত, সেখানে একটি ক্যাপস্টোন প্রোজেক্ট বা থিসিস অপশন থাকতে পারে। ওই সময়ে প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বা দুটি কোর্স অনলাইনে অফার করা যেতে পারে। এ ধরনের উদ্যোগের পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারি ও বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে।

সফট স্কিল, যেমন যোগাযোগের ক্ষমতা, ভাষা দক্ষতা, জ্ঞানীয় বা মানসিক সহানুভূতি, সময় ব্যবস্থাপনা, দলগত কাজ, নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য কর্মসংস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি মূলত চাকরির স্থান (স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক), ফ্রিল্যান্সিং, কনসালট্যান্সি প্রোফাইল ডেভেলপমেন্ট, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট গাইডেন্স এবং আইজিএ (ইনকাম জেনারেটিং অ্যাকটিভিটিস) নিশ্চিত করতে পারে। বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি তৃতীয় ভাষার দক্ষতা চাকরির ক্ষেত্রে অনেক সময় অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে।

আজকে আমাদের গ্রামীণ বয়ষ্ক মহিলারা সাধারণ স্মার্ট ফোনের ব্যবহার জানে না,জানে মোবাইলে ব্যবহৃত ইংরেজি শব্দের অর্থ। তাহলে যখন চতুর্থ শিল্প বিল্পবে সকল লেনদেন, যানবাহন, যোগাযোগ প্রযুক্তির সাহায্যে চলবে এদের অবস্থা কি হবে?

আবার আরেকটা সমীকরণ দেখুন, আমাদের দেশে একটা বিল্ডিং নির্মাণের জন্য মনে করুণ ৫০ জন লোক শ্রমিক কাজ করতেছে।যারা প্রায় অশিক্ষিত। এখন চতুর্থ শিল্প বিল্পবের পর যদি বিল্ডিং নির্মাণের দুই-তৃতীয়াংশ কাজ যদি রোবট বা অন্য কোনো প্রযুক্তি দিয়ে করিয়ে নেওয়া যায় অল্প খরচে, অল্প সময়ে তাহলে তো মানব শ্রমিক দিয়ে কেউ কাজ করাবে না। তখন এই মানব শ্রমিকগুলোর কর্মসংস্থান কোথায় হবে? এরা জীবনযাপন কেমনে করবে? এদের ভবিষ্যৎ কি? এর ফলাফল হবে তিমিরের লোক আজীবন তিমিরে থেকে যাবে। আলোর পথ দেখবে না। বিশ্ব কতটা সুন্দর যদি বিশ্ব কে মনে মনে কল্পনা করা যায়।

আমরা যদি এটাও চিন্তা করি যে,চতুর্থ শিল্প বিল্পব কিভাবে সৃষ্টি হলো? উত্তর হবে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়নি। মানুষের মেধা ও অভিজ্ঞতার বিরতিহীন প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে অর্জিত হয়েছে। জনগণের তথা করদাতাদের অর্থায়নে এ চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্ভবপর হয়েছে। বৃহৎ কোম্পানিগুলো মূলত সরকারি অর্থায়নে আবিষ্কৃত প্রযুক্তিগুলোকে নিজেদের করায়ত্ত করে একচেটিয়া বাজার তৈরি করছে। এতে করে যা ছিল সরকারি অর্থায়নে সৃষ্ট গণপণ্য, এখন তা হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্য।

দ্বিতীয়ত, এ বৃহৎ কোম্পানিগুলো ব্যাপক মুনাফা করছে। এই হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি সামান্য সংখ্যক বেতনভুক্ত কর্মচারী নিয়োগ করে। যাদের এ প্রযুক্তির ব্যবহারকারী বলা হয়, তারাই অধিকাংশ এ প্রযুক্তি উৎপাদন করে থাকে। কিন্তু তাদের মজুরি দিতে হয় না; বরং তারা ভোক্তা বা ক্রেতা হিসেবে এ বাজারে নিয়োজিত। এই একচেটিয়া কোম্পানিগুলো দুই প্রক্রিয়ায় উদ্বৃত্ত অর্জনের মাধ্যমে অত্যধিক অস্বাভাবিক মুনাফা করছে। একদিকে তাদের স্বেচ্ছায় ব্যবহারকারী তথা উৎপাদনকারীদের মজুরি দিতে হচ্ছে না। অন্যদিকে ভোক্তার কাছেই পণ্য বা সেবা বিক্রি করে মুনাফাও পাচ্ছে। অথচ সনাতনী উৎপাদন ব্যবস্থায় বেতনভুক্ত কর্মচারীর নিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন হয়।

তৃতীয়ত, এ ডিজিটাল বাজারকে ভোক্তাদের জাগতিক কল্যাণের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু বহু গবেষণায় অসংখ্য তথ্য ও উপাত্ত দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, যে ভোক্তাদের কোম্পানির তুলনায় অসম্পূর্ণ তথ্য থাকায়, অসম ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় এবং মায়জাল ও প্রতারণার সাহায্যে মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পদ্ধতিগতভাবে শোষণ ও প্রান্তিকীকরণ করা হয়। ডিজিটাল বাজারগুলো ন্যায়ভিত্তিক হওয়ার পরিবর্তে অজ্ঞ গ্রাহকদের বোকা বানাচ্ছে। এ জাতীয় বাজারব্যবস্থা যদি সর্বস্তরে নিয়ন্ত্রিত না হয়, তবে প্রান্তিক ভোক্তাদের স্বাধীনতা এবং আত্ম-পূর্ণতার সুযোগ দেয়ার পরিবর্তে শোষণ ও নিপীড়নের সুযোগ তৈরি করে দেবে।

চতুর্থ, শিল্প বিপ্লব পুরো জীবনব্যবস্থাকে প্রভাবিত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষ, প্রকৃতি এবং সমাজের সর্ম্পক বৃহত্তর রূপান্তর হতে পারে। এ ডিজিটাল ব্যবস্থার মধ্যে থাকা সব অংশীজনদের অবশ্যই তাদের ন্যায়সঙ্গত অংশ ভোগ করার সুযোগ থাকতে হবে। অন্যথায় প্রান্তিকীকরণ বেড়ে যাবে। নিশ্চয়ই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কাঙ্ক্ষিত ভালো পথই খুঁজে নেবে।

মাজহারুল ইসলাম শামীম,
শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ।
বিভাগ : ব্যবস্থাপনা।
বর্ষ : তৃতীয়।