দেশের বাজারে এক বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ডলার সংকট। এই সংকটের মধ্যে, মূলত ব্যাংকিং খাতের ক্ষয়িষ্ণু স্বাস্থ্যের জন্য, এলসি (ঋণপত্র) কনফার্মেশন চার্জ বাড়িয়ে দিয়েছে বিদেশি ব্যাংকগুলো। এর ফলে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের খরচ অনেক বেড়ে গেছে।
আর এই বাড়তি খরচের বোঝা সরাসরি চাপানো হচ্ছে ভোক্তাদের ঘাড়ে। ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাচ্ছে।
ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এলসি কনফার্মেশন ফি হিসেবে এখন বছরে আমদানি মূল্যের ৩.৫ শতাংশ গুনতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। অথচ গত বছরের জুনেও এ হার ছিল ১.৭ থেকে ২ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে এলসির মাধ্যমে বাংলাদেশ যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে, তা হিসাব করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
পরিসংখ্যান বলছে, জুলাই ও আগস্টে ব্যাংকগুলো যথাক্রমে ৫.৫৫ বিলিয়ন ডলার ও ৫.৫৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের এলসি খুলেছে। ধরা যাক, এই এলসিগুলোর ৮০ শতাংশ ৩.৫ শতাংশ চার্জে তৃতীয় পক্ষের ব্যাংক কনফার্ম করেছে। এর ফলে বছরে বাংলাদেশের ব্যয় হয়েছে ৩৯০ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকারও বেশি। এই ব্যয় শেষপর্যন্ত গ্রাহকদেরই বহন করতে হবে। এলসি যদি ছয় মাসও বিলম্বিত (ডেফারড) হয়ে থাকে, তবু অতিরিক্ত খরচের পরিমাণ এই প্রাক্কলিত ব্যয়ের অর্ধেক হবে।
এলসি কনফার্মেশন ফি বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের অন্যতম বৃহৎ পণ্য আমদানিকারক মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, বেশির ভাগ ব্যাংক সাইট এলসি খুলছে না বলে ফি বেড়েছে।
এর ফলে তিনি নিজেও ইউপিএএস এলসি খুলতে বাধ্য হচ্ছেন। ইউপিএএস এলসি হচ্ছে আমদানিকারকদের জন্য ডেফারড এলসি সিস্টেমের আওতায় পরিচালিত একটি আমদানি অর্থ পণ্য। মোস্তফা কামাল বলেন, ইউপিএএস এলসি গ্রহণ করার জন্য তৃতীয় পক্ষের ব্যাংকের কনফার্মেশন লাগে।
এছাড়াও বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের ওপর ২০ শতাংশ কর আরোপ করায় খরচ আরও বেড়েছে উল্লেখ করে মোস্তফা কামাল বলেন, এর ফলে ব্যবসায়ীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘বাধ্যতামূলক বিদেশি পেমেন্ট করতে না পারলে আমাদের খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এখন আমাদের হাতে আর কী বিকল্প আছে?’
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও স্বীকার করেন যে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এলসি কনফার্মেশন ফি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। ফির এই ঊর্ধ্বগতির কারণে বেড়েছে আমদানি ব্যয়। তিনি বলেন, এই বাড়তি ব্যয় গিয়ে চাপে ভোক্তাদের কাঁধে, যা সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ক্রেতার ব্যাংকের ইস্যু করা এলসি বিক্রেতার দেশের কোনো ব্যাংক বা তৃতীয় পক্ষের ব্যাংক দিয়ে কনফার্ম করা যায়। এর মাধ্যমে ক্রেতার ব্যাংক খেলাপি হলেও বিক্রেতার পেমেন্ট পাওয়া নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশি ব্যাংক ও আমদানিকারকদের জন্য যেসব ব্যাংক এলসি কনফার্মেশন দেয়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এইচএসবিসি, মাশরেক, জেপি মরগান এবং সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু ব্যাংক।
কী পরিমাণ বাড়তি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে?
কাস্টমসের তথ্য উদ্ধৃত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশ গত অর্থবছরে ৭৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে।
ব্যাংকাররা বলেন, মোট আমদানির প্রায় ৮০ শতাংশ বা ৬০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানিতে তৃতীয় পক্ষের ব্যাংকের এলসি কনফার্মেশন নিতে হয়েছে। গড় এলসি কনফার্মেশন ফি যদি ৩ শতাংশ ধরা হয়, তাহলে দেশের আমদানিকারকরা গত অর্থবছরে অতিরিক্ত ১.৮ বিলিয়ন ডলার বা ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই ফি যদি ১.৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বা ১৫০ বেসিস পয়েন্ট না বাড়ত, তাহলে দেশের কত টাকা সাশ্রয় হতে পারত? মোট আমদানির ৮০ শতাংশ বা ৬০ বিলিয়ন ডলারে তৃতীয় পক্ষের ব্যাংকের এলসি কনফার্মেশন নেওয়া হয়েছে ধরে নিলে—এবং এলসি কনফার্মেশন ফি না বাড়লে—বাংলাদেশ ৬০০ মিলিয়ন ডলার বা ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় করতে পারত।
চার্জ এভাবে বেড়ে গেল কেন?
এলসি কনফার্মেশন চার্জ সাধারণত চারটি মূল বিষয়ের ওপর নির্ভর করে—ব্যাংক ঝুঁকি, দেশের ঝুঁকি, আমদানিকারক ও পণ্য।
এবার সেই তালিকায় আরও কিছু ঝুঁকি যোগ হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি আছে দেশে সৃষ্ট সমস্যা। সেগুলো হচ্ছে: স্থানীয় ব্যাংকের ঋণযোগ্যতার পড়তি দশা, দেশের ঋণমানের অবনমন এবং পেমেন্টে বিলম্ব বা খেলাপি হওয়া।
চতুর্থ কারণটি বৈশ্বিক—সুদের হার ৫ শতাংশ বা ৫০০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি। ব্যাংকাররা বলেন, বৈশ্বিক সুদহারের এই বৃদ্ধি ব্যাংকগুলোর ঋণের খরচ বাড়িয়ে দেবে। এর প্রতিক্রিয়ায় এই বাড়তি ব্যয়ের বেশ কিছুটা অংশ ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। এলসি কনফার্মেশন সেবা চাওয়া গ্রাহকরাও আছে এই তালিকায়।
বাংলাদেশে এলসি কনফার্মেশন চার্জ বেশি কেন
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর আমদানিকারকদের তুলনায় বাংলাদেশের আমদানিকারকদের এলসি নিশ্চিত করার জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি খরচ করতে হয়।
এমনকি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, রপ্তানি হ্রাস ও মন্থর জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে উচ্চ অর্থনৈতিক ঝুঁকির মুখে থাকা দেশ পাকিস্তানের আমদানিকারকরাও এলসি কনফার্মেশনের বাংলাদেশের আমদানিকারকদের চেয়ে অনেক কম অর্থ ব্যয় করে।
ভারতে ১০ কোটি রুপি পর্যন্ত মূল্যের এলসির জন্য কনফার্মেশন চার্জ ০.৭৫ শতাংশ; আর ১০ কোটি রুপির বেশি এলসির জন্য এ চার্জ ০.৫০ শতাংশ। অন্যদিকে, পাকিস্তানে কনফার্মেশন চার্জ ১.৫ শতাংশ থেকে ২.৫ শতাংশ পর্যন্ত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মতে, স্থানীয় ব্যাংকগুলোর ত্রুটিই বাংলাদেশের চড়া এলসি কনফার্মেশন চার্জের জন্য দায়ী।
তিনি বলেন, অনেক ব্যাংক নিজেদের পেমেন্ট সক্ষমতার বাইরে গিয়ে এলসি খুলেছে। ফলে ওই ব্যাংকগুলো খেলাপি হয়েছে। এর জেরে বিদেশি ব্যাংকগুলো কনফার্মেশন চার্জ বাড়িয়ে দিয়েছে।
তবে ব্যতিক্রমও আছে। তেমনই একটি ব্যতিক্রমী ব্যাংক হচ্ছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক। এই ব্যাংকটি এলসি কনফার্মেশন চার্জ কম রাখতে পেরেছে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মোহাম্মদ শিরিনের মতে, পেমেন্ট সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিচক্ষণতার সঙ্গে এলসি খোলার কারণেই তারা এই সাফল্য পেয়েছেন।
তিনি বলেন, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। আগে যেখানে ব্যাংকটির মাধ্যমে প্রতি মাসে ২০০ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসত, এখন সেখানে আসছে ২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যাংকটি খেলাপি না হয়েই পেমেন্ট করতে পারছে। ‘এর পেছনে কোনো জাদু নেই। আমরা আমাদের পেমেন্ট সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে এলসি খুলেছি,’ বলেন তিনি।
একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান বলেন, অনেক ভারতীয় ও পাকিস্তানি ব্যাংকের বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নিজস্ব শাখা রয়েছে। এই ব্যাংকগুলো তাদের নিজ নিজ দেশের পক্ষে এলসি নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন কাজ করে।