চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি তলানিতে ঠেকছে। বছর কয়েক আগেও কোটি কোটি টাকার হাজার হাজার ইউনিট গাড়ি আমদানি হলেও বর্তমানে তা একেবারে কমে গেছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের অসহযোগিতাসহ বন্দরের নানা পদক্ষেপের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি তলানিতে ঠেকেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। শুধু ঢাকার আমদানিকারকই নয়, চট্টগ্রামের আমদানিকারকেরাও মংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি করছেন। নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেও যেসব আমদানিকারক চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গাড়ি আনতেন তারাও মংলা বন্দর মুখে ছুটতে বাধ্য হচ্ছেন। এইচএস কোডের গ্যাঁড়াকলে পড়ে গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাইক্রোবাস খালাস বন্ধ রয়েছে। আটকাপড়া শ’খানেক গাড়িতে সরকারের ১৫ কোটি টাকারও বেশি শুল্কও আটকা পড়েছে। বছরের পর বছর ধরে একই এইচএস কোডে গাড়ি আমদানি হলেও চট্টগ্রাম কাস্টমস গত সপ্তাহে এইচএস কোড পাল্টে শুল্কায়নের প্রস্তাব করে সব গাড়ি আটকে দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে গাড়ি আমদানিকারকদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের মোটরযান সেক্টর পুরোপুরি আমদানি নির্ভর। বছর কয়েক আগেও জাপান থেকে হাজার হাজার রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করে দেশের মোটরযান সেক্টর সচল রাখা হতো। ১৯৭৯ সাল থেকে দেশে প্রথম রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি শুরু হয়। প্রথমদিকে খুব বেশি গাড়ি আমদানি না হলেও পরবর্তী বছরগুলোতে হাজার হাজার গাড়ি আমদানি করা হয়। অবশ্য গত বছর কয়েক ধরে প্রচুর নতুন গাড়িও আমদানি হচ্ছে। এক সময় চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে বছরে অন্তত ৩২ হাজার রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করা হলেও বর্তমানে তা মাত্র কয়েক হাজারে নেমে এসেছে।
দেশের ঢাকা চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানের ছয়শ জনের মতো আমদানিকারক গাড়ি আমদানি করে থাকেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট এবং খুলনায় চার শতাধিক শো রুমের মাধ্যমে গাড়ি বিক্রি হয়। চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দরের মাধ্যমে এসব গাড়ি আমদানি হচ্ছে। জাপান থেকে রো রো ভ্যাসেল এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কন্টেনারে ভর্তি করে গাড়ি আমদানি করা হয়। এই খাতে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর সরকারকে চার হাজার কোটিরও বেশি টাকা ট্যাক্স প্রদান করে এসব গাড়ি বন্দর থেকে ছাড় করানো হয়। এছাড়া ইনকাম ট্যাক্স এবং ভ্যাট মিলেও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করা হয় গাড়ি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বছর কয়েক আগেও গড়ে ত্রিশ হাজারের বেশি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করা হলেও বন্দরের ভাড়ার তারতম্যের কারণে ক্রমে চট্টগ্রামে গাড়ি আমদানি কমে যায়। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পুরো বছরে পাঁচ হাজার গাড়িও আসে না। গাড়ি আমদানির প্রায় পুরোটা চলে গেছে মংলা বন্দরে।
আমদানিকারকেরা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের শেডে একদিন একটি গাড়ি রাখতে সাড়ে নয়শ টাকা ভাড়া গুণতে হয়। মংলায় যা সাড়ে তিনশ টাকা। ভাড়া কমের পাশাপাশি ৩০ দিন পর চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ি অকশন ক্যাটালগে তুলে দেয়া হয়। মংলা বন্দরে বিষয়টি নিয়ে বেশ স্বস্তি থাকায় আমদানিরকারকেরা চট্টগ্রামবিমুখ হয়ে উঠেছেন বলেও জানিয়েছেন। শুধু ঢাকারই নয়, চট্টগ্রামের আমদানিকারকেরাও মংলা দিয়ে খালাস করে সেই গাড়ি সড়কপথে চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। দূরত্ব ছাড়াও পথ খরচ বাড়তি যাওয়ার পাশাপাশি নানাভাবে কষ্ট হলেও শুধুমাত্র বন্দর এবং কাস্টমসের ভোগান্তি এড়াতে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা মংলায় গাড়ি খালাস করেন বলে জানিয়েছেন।
চট্টগ্রামের প্রতি এক ধরনের বিমাতাসুলভ আচরণ বিরাজমান বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে একাধিক আমদানিকারক জানিয়েছেন, গত বেশ কিছুদিন ধরে বিরাজিত উপরোক্ত বেহাল অবস্থার মাঝে নয়া সংকট দেখা দিয়েছে এইচএস কোড। কোন ক্যাটাগরির কত সিসির গাড়ি কোন এইচএস কোডে শুল্কায়িত হবে তা নির্দিষ্ট করা রয়েছে বলে উল্লেখ করে আমদানিকারকেরা বলেন, গত ১৫ বছর ধরে হাইএইচ মাইক্রোবাস এইচএস কোড–৮৭০২.৯০৪০ তে শুল্কায়ন হয়ে আসছে। কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে এই এইচএস কোড ভুল বলে ঘোষণা দিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ মাইক্রোবাসের শুল্কায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। এটি ভুল হলে কোনটি শুদ্ধ সেটিও কাস্টমস বলছে না। এনবিআর থেকেও কোনো ঘোষণা দেয়া হচ্ছে না। ১৫ বছর ধরে যে এইচএস কোড কাস্টমসে ব্যবহৃত হলো সেটি রাতারাতি কিভাবে ভুল হয়ে গেলো তারও কোনো ব্যাখা নেই। এমতাবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরে থাকা শতাধিক মাইক্রোবাসের শুল্কায়ন বন্ধ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকেরা গাড়িগুলো খালাস করতে না পারায় সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্বও আটকা পড়েছে। এক একটি গাড়িতে সরকারের গড়ে ১৫ লাখ টাকার মতো শুল্ক পাওয়ার কথা। চট্টগ্রাম বন্দর শেডে আটকা পড়া শতাধিক গাড়িতে সরকারের ১৫ কোটিরও বেশি টাকার শুল্ক অনিশ্চয়তায় পড়েছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল একাধিক গাড়ি আমদানিকারক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, বছরের পর বছর ধরে যে এইচএস কোড ব্যবহার করে শুল্কায়ন হয়ে আসছে হুট করে তা ভুল বলে আটকে দেয়া হয়েছে। এতে গাড়ি আমদানিকারকেরা বেকায়দায় পড়েছেন। এটি চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে গাড়ি আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র বলেও তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার সন্তোষ সরেন বলেন, এইচএস কোড নিয়ে তো কোনো সমস্যা হয়নি। এইচএস কোড বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে। গাড়ি নতুন কিংবা পুরাতন এবং সিসি ভেদে এইচএস কোড চেইঞ্জ হয়। এসব গাড়ির ক্ষেত্রে তেমন কিছু হতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অবশ্য আমদানিকারকেরা বলেছেন, তারা আগের মতো পুরাতন গাড়িই আমদানি করেছেন। সিসিও একই রয়েছে। দুই হাজার সিসির এসব গাড়ির সিটিং ক্যাপাসিটিও একই। সবসময় একই গাড়িই আমদানি হয়েছে। একই এইচএস কোডে শুল্কায়ন হয়ে খালাস হয়েছে। কিন্তু এবারই একজন এআরও এইচএস কোড ভুল বলে শুল্কায়ন আটকে রেখেছেন।