ঈদের মাত্র ক’দিন পর মাছ ব্যবসায়ী সুলতান আহমেদের জুতা চুরি গেছে চট্টগ্রাম নগরীর ফিশারিঘাট মসজিদ থেকে। দু’দিন পর সেই জুতা পেয়েছেন কয়েক কিলোমিটার দূরে নগরীর নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাতের একটি দোকানে। খোয়া যাওয়া দুই হাজার টাকা দামের জুতা তিনি আবার কিনেছেন ৮০০ টাকায়।
সুলতান আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “আমি জানতাম চোরা জুতাগুলো এখানেই বিক্রি হয়। তাই একবার ঢুঁ মারলাম। পেয়েও গেলাম।”
চট্টগ্রাম নগরীতে চুরি যাওয়া সব জুতা বিক্রি হয় স্টেশন রোডের ফুটপাতের দোকানগুলোতে। এজন্য পুরাতন স্টেশন থেকে নতুন স্টেশন পর্যন্ত পুরো এলাকাটি পরিচিতি পেয়ছে ‘চোরা মার্কেট’ নামে। শুধু জুতা নয়, স্ক্রু ড্রাইভার থেকে শুরু করে পুরাতন কাপড়, ঘড়ি থেকে মোবাইল এবং হাঁড়ি-পাতিল বা গৃহস্থালী পণ্যসামগ্রীও বিক্রি হয় এই চোরা মার্কেটে। প্রায় চার দশক ধরে এলাকাটি চোরা মার্কেট নামে পরিচিতি স্থানীয় মানুষের কাছে। পুলিশের অভিযানে ২০১৯ সালে প্রায় সব দোকান উচ্ছেদ হয়েছিল। করোনা মহামারির পর দোকানগুলো আবার বসেছে।
যেভাবে গড়ে উঠলো চোরা মার্কেট
স্বাধীনতার পরপর উত্তর চট্টগ্রামের নাজিরহাটের বাসিন্দা নুর ইসলাম প্রথম পুরাতন স্টেশনের ফুটপাতে হকারি শুরু করেন। বার্মার আরাকান রাজ্য থেকে এসেছিলেন বলে ‘মগ’ নামে পরিচিত ছিলেন এখানে। পরে ১৯৭৩ সালে অন্যরাও স্টেশন রোড এলাকায় ব্যবসা শুরু করেন। প্রথমদিকে জাম্বুরাসহ বিভিন্ন ফল বিক্রি করতেন। এরপর শুরু করলেন পুরাতন কাপড়ের ব্যবসা।
তখন নগরীর মুরাদপুর, বহাদ্দারহাট, মাদারবাড়ির মতো ঘনবসতি এলাকার বাসাবাড়িতে গিয়ে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিলের বিনিময়ে পুরাতন কাপড় সংগ্রহ করতেন ফেরিওয়ালারা। পুরাতন কাপড়ের সঙ্গে অল্প কিছু টাকা দিলেই নতুন হাঁড়ি-পাতিল পেত মানুষ। ধারাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফেরিওয়ালারা এসব পুরাতন কাপড় সংগ্রহের পর স্টেশন রোডের ফুটপাতের পুরাতন দোকানে বিক্রি করতেন। এরপর এসব কাপড় ধোলাই করে মানুষের কাছে বিক্রি করতেন দোকানিরা। এভাবেই পুরাতন জিনিসপত্র বিক্রির প্রচলন শুরু হয় এখানে। ওই সময় মাত্র ৫-৬টি দোকান ছিল এখানে। বর্তমানে দুই শতাধিক দোকান রয়েছে।
চট্টগ্রামের প্রধান রেলওয়ে স্টেশনের পাশাপাশি বিভিন্ন রুটের বাসের কাউন্টার রয়েছে নিউমার্কেট এলাকায়। এ কারণে চোর, ছিনতাইকারী বা পকেটমারের আনাগোনা বেশি ছিল এ জংশনে। পুরাতন কাপড়ের পাশাপাশি চোরাই ঘড়ি, ব্যাগ, কাপড়, জুতাও বিক্রি শুরু করেন দোকানিরা। এরপর সময়ের পরিক্রমায় চোরাই মালামালের নিরাপদ বিক্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয় ব্যস্ত এলাকাটি। চোরা মালামাল বিক্রির পরিসর আশপাশের এলাকাও ছাড়িয়ে গেছে।
১৯৯৩ সালে পুরাতন স্টেশনের ফুটপাতের দোকানিরা গঠন করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হকার্স সমিতি। ২০০২ সালে এ সংগঠনের সদস্য ছিল ১৬০ দোকান। বর্তমানে সদস্যভুক্ত মাত্র ৪৫টি দোকান চালু আছে। চোরাই মাল বিক্রি বন্ধ করতে ২০০৮ সালে সংগঠন-পুলিশের সমন্বয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করে সকাল-সন্ধ্যা টহল দেওয়া হতো। সর্বশেষ ২০১৯ সালে দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এরপরও বন্ধ হয়নি চোরাই মালামাল বিক্রি।
গত মাসের এক সন্ধ্যায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রতিবেদক চোরা মার্কেটের একজন ব্যবসায়ী ও স্থানীয় এক চা দোকানির সঙ্গে কথা বলছিলেন। এসময় এক চোর নিয়ে সেখানে হাজির পুলিশ। নগরীর টাইগারপাসের একটি দোকান থেকে চুরি যাওয়া একটি বাটন মোবাইল, এক জোড়া জুতার সন্ধানে আসা তাদের। চোরা মার্কেটের এক দোকানি নিজে ব্যবহারের জন্য ১০০ টাকায় ওই জুতা জোড়া কিনেছেন। পুলিশের তলবে তা বাসা থেকে এনে দেন। তবে মোবাইলটি অন্যজনের কাছে বিক্রি করায় সন্ধান মেলেনি। কোন সুরাহা না করতে পেরে চোরকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায় পুলিশ।
টিবিএস প্রতিবেদক ওই চোরের সঙ্গে কথা বলেন। তিনিও জানিয়েছেন পুরো ঘটনা। জানান- টাইগারপাসের একটি দোকান থেকে একটি মোবাইল ও এক জোড়া জুতা চুরি করে এখানে বিক্রি করেন তিনি। পরের দিন আবার টাইগারপাসের আরেকটি দোকান থেকে ছোট সাউন্ড বক্স চুরি করতে গিয়ে ধরা! উত্তম-মধ্যমের পর দিলো পুলিশে। আগের দিন চুরি যাওয়া মোবাইলের সন্ধানে সারাদিন পেটানোর পর চোরা মার্কেটে নিয়ে আসেন পুলিশ। পরে চোরা মোবাইল ক্রেতাকে দেখিয়ে দিতে না পারায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
ওই চোরের সরল স্বীকারোক্তি- “চোরকে আদালতে চালান দিলে উল্টো সরকারের টাকার লোকসান হবে। এজন্য ছেড়ে দিয়েছে। তবে আমি যার কাছে মোবাইল বিক্রি করেছি, তাকে দেখিয়ে দেইনি।”
মোবাইলের যুগে পরিচিত পায় চোরাই মার্কেট
চোরা মার্কেটের ব্যাপক প্রসার ও পরিচিতি পায় ২০০০ সালের পরে। দেশের মোবাইল ফোনের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে জমজমাট হয়ে ওঠে বেচাকেনা। পকেটমার থেকে ছিনতাই অথবা বাসা-বাড়ি থেকে চুরি যাওয়া সব মোবাইল এখানে এনে বিক্রি করা হতো। অল্প দামে মোবাইল বিক্রির কারণে দ্রুত পরিচিতি পায়। পুরাতন স্টেশন থেকে নতুন স্টেশন পর্যন্ত কয়েকশো মিটার এলাকার ফুটপাতজুড়ে শতাধিক দোকানে শোভা পায় হাজার হাজার চোরা মোবাইল। বাটন মোবাইল থেকে শুরু করে নামী ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন বেচাকেনা হয়। চার্জার, ক্যাবল, ব্যাটারি বা ইয়ারফোনের মতো আনুষঙ্গিক উপকরণও এখানে বিক্রি হয়। মোবাইল চুরির পর আইএমইআই নাম্বার পরিবর্তন করে বিক্রি করা হয়।
সাইফুল ইসলাম নামে নগরীর খুলশী এলাকার এক ব্যবসায়ী টিবিএসকে বলেন, “২০১২ সালে আমি সিটি কলেজে পড়ার সময় চোরাই মার্কেট থেকে সনি এরিকসনের একটি মোবাইল কিনেছিলাম মাত্র ৮ হাজার টাকায়। তখন বাজারে মোবাইলটির দাম ছিল ১৭ হাজার টাকা।”
ঈদের জুতা চুরির মৌসুম
সাধারণত মানুষ রমজানের ঈদে নতুন পোশাকের সঙ্গে জুতাও কেনেন। এসব জুতা নিয়ে যাত্রা শুরু হয় ঈদের নামাজ থেকে। আর চোরদেরও অভিযান শুরু হয় সেখান থেকে।
চোরা মার্কেটের দোকানিদের সঙ্গে এ বিষয়ে খোলামেলা কথা হয়েছে টিবিএসের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানিয়েছেন আদ্যপ্রান্ত। তারা বলেন, ঈদের নতুন জুতা সবচেয়ে বেশি টার্গেটে রাখে চোররা। ওই সময় মসজিদ, বাসা-বাড়ি থেকে একেবারে নতুন জুতা চুরি হয় বেশি। নতুন জুতার কদরও বেশি। তবে সারা বছরই জুতা চুরি হয়। পুরাতন স্টেশন থেকে নতুন স্টেশন হয়ে হকার্স মার্কেটের ফুটপাট পর্যন্ত শতাধিক দোকান রয়েছে চোরাই জুতার। এছাড়া ফুটপাতের কিছু নতুন জুতার দোকানেও বিক্রি হয় চোরা জুতা। স্থায়ী চোরেরা নিয়মিত জুতা চুরি করে সেখানে বিক্রি করেন।
এক চোরা জুতার দোকানি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “চোরাই জুতা- একটা ব্র্যান্ড। এখানে অনেক ভালো কোম্পানির ভালো মানের জুতা বিক্রি হয় কম দামে। নির্দিষ্ট জুতা চোর রয়েছে। যারা প্রতিদিন জুতা চুরি করে এখানে এনে বিক্রি করেন। জুতার অবস্থা অনুযায়ী, ধোয়া-মোছা, পলিশ কিংবা রংও করা হয় এখানে।”
চোরাই মালামালেও ভেজাল!
চোরাই মোবাইল অর্থাৎ একজনের ব্যবহৃত ভালো মোবাইল- এই সুনামের কারণে পরিচিতি পেয়েছিল এ মার্কেট। তবে অল্প সময়ের মধ্যে ভেজালে সয়লাব হয়ে গেছে। পুরাতন বা নষ্ট মোবাইল বিভিন্ন সার্ভিসিংয়ের দোকানে ঠিক করা হয়। এরপর তা এখানে এনে চোরাই মোবাইল বলে বিক্রি করা হয়। মেরামত করায় কিছু দিন পর আবার নষ্ট হয়ে যায়। শুধু মোবাইল নয়, লোকাল কারখানার জুতা বানিয়ে নামী ব্র্যান্ডের সিল লাগানো হয়। তা ঘষামাজায় পুরাতন রূপ দিয়ে চোরাই জুতা বলে বিক্রি হয় এখানে। এসব কারণে আগের সেই জৌলুস হারিয়েছে। বর্তমানে বেশিরভাগ ভালো মানের চোরাই মোবাইল বিক্রি হয় কয়েকশো মিটার দূরের জলসা মার্কেটে।