ঘোষণা দিয়েও বাস চালাননি: মালিক-শ্রমিকরা সড়ক ও নৌপথে দিনভর বিচ্ছিন্ন ঢাকা

সদরঘাট-কেরানীগঞ্জ নৌকা চলাচলও বন্ধ * চরম ভোগান্তিতে যাত্রীরা
 যুগান্তর প্রতিবেদন

 ১১ ডিসেম্বর ২০২২print sharing button
সড়ক ও নৌপথে দিনভর বিচ্ছিন্ন ঢাকা

সারা দেশের সঙ্গে ঢাকার সড়ক ও নৌযোগাযোগ শনিবার দিনভর কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ঢাকা থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। ঢাকার ভেতরেও বাস চলাচল করেনি।

একইভাবে নৌপথে দু’চারটি ছাড়া লঞ্চ চলাচলও বন্ধ ছিল। এমনকি সদরঘাট থেকে কেরানীগঞ্জ নদী পারাপারে নৌকাও বন্ধ ছিল। যদিও বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে সরকারপন্থি মালিক-শ্রমিক নেতারা বাস চালানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন।

অনেক মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে গাড়ি না পেয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েন। তবে অন্যান্য দিনের তুলনায় এদিন ঢাকায় সাধারণ মানুষের চলাচল অনেক কম ছিল। পরিবহণ নেতাদের দাবি, আতঙ্ক ও যাত্রী না থাকায় বাস নামেনি। তবে সন্ধ্যার পর বাস চলাচল শুরু হয়। ছেড়ে যায় কিছু নৌযানও। সরেজমিন ঘুরে এসব দৃশ্য দেখা গেছে।

ঘোষণা সত্ত্বেও বাস না চালানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ যুগান্তরকে বলেন, সকালে কিছু যাত্রী ছিল। সেজন্য কিছু গাড়িও বেরিয়েছিল। কিন্তু, সড়কে যাত্রী কম থাকায় পরবর্তীতে অনেক মালিক রাস্তা থেকে গাড়ি উঠিয়ে নিয়েছে। এছাড়া, শুক্রবার মিরপুরে একটি গাড়ি পোড়ানো হয়েছিল। সেই কারণে বাস মালিকরা আতঙ্কে রয়েছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো মালিককে রাস্তায় গাড়ি বের না করার বিষয়ে কোনো ধরনের নির্দেশনা দেইনি। রাজধানীর মহাখালী, গাবতলী ও গুলিস্তান বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, টার্মিনালে সারি সারি বাস। মিরপুর, কল্যাণপুর, তেজগাঁওয়ের অলিতে-গলিতেও বাস পার্কিং করে রাখা হয়েছে। কোনো বাসে ছেড়ে যাওয়ার মতো প্রস্তুতিও ছিল না। গাবতলী ও মহাখালীর বাসের কাউন্টারগুলোও বন্ধ ছিল।

এমনকি গাড়ি চালানোর ঘোষণা দেওয়া খন্দকার এনায়েত উল্যাহ’র মালিকানাধীন এনা পরিবহণের বাস ভোর থেকেই পার্কিং করে রাখা হয় বলে জানান তার কর্মচারীরা। গাড়ি চলাচল না করায় কর্মজীবী মানুষ বাধ্য হয়ে হেঁটে, ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজি অটোরিকশা ও রিকশায় গন্তব্যে গেছেন।

মহাখালী টার্মিনালে বেলা ১১টার দিকে আসেন আব্দুল আলিম ও তার স্ত্রী। যাবেন সিরাজগঞ্জ। বাস না পেয়ে ক্ষুব্ধ আব্দুল আলিম বলেন, টেলিভিশনে গাড়ি চালাবেন বলে মালিকদের বক্তব্য দেখেছি। এখন টার্মিনালে এসে দেখি বাস বন্ধ। তাহলে কী তারা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করলেন না? কী ধরকার ছিল এমন বক্তব্য দেওয়ার। এখন আবার সিএনজি ভাড়া দিয়ে ঝিগাতলার বাসায় যেতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পরিবহণ কোম্পানির মালিক জানান, শুক্রবার রাতেই বেশিরভাগ মালিক তাদের বাস রাজধানী থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছেন। যেসব বাসের মালিক বিভিন্ন জেলার, তাদের গাড়ি ওইসব জেলায় আগেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও ওই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আ

র সায়েদাবাদ টার্মিনালকেন্দ্রিক মালিকরা জানান, গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার খবর শুনেই বেশিরভাগ গাড়ি তারা সরিয়ে নেন। তবে গতকাল ওই টার্মিনাল ও আশপাশেও গাড়ি পার্কিং করা ছিল। গাড়ির পাহারায় ছিলেন শ্রমিকরা। তারা আরও জানান, দু’ চারটি বাসের চালক না জেনেই ঢাকায় যাত্রী নিয়ে এসেছে। তাদেরকে কয়েকস্থানে পুলিশ তল্লাশি করেছে। এমনকি গাড়ি নামানোর কারণে শাসানো হয়েছে।

দূর পাল্লার বাসের পাশাপাশি ঢাকা নগরীর ভেতরেও শনিবার সকাল থেকে বাস চলাচল কার্যত দেখা যায়নি। প্রাইভেট কারের সংখ্যাও নেহাত কম। লোকজনেরও তেমন ভিড় নেই, ফাঁকা রাস্তায় দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে মোটর সাইকেল রিকশা কিংবা অটোরিকশা। মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ থেকে সকাল ১০টায় মহাখালীতে অফিসে যাওয়ার জন্য গাড়ির অপেক্ষায় ছিলেন রিয়াজুল ইসলাম।

তিনি জানান, সাধারণত বাসেই আসা-যাওয়া করেন। কিন্তু শনিবার বাধ্য হয়ে বেশি টাকা খরচ করে রাইড শেয়ারিং বাইকে করে অফিসে যাচ্ছেন। মিরপুরের কাজীপাড়া থেকে মোটর সাইকেলে বনশ্রী যান আল মামুন। তার ভাষ্য, সড়কে একটা বাসও নেই। ৩০০ টাকা ভাড়ায় বাইক নিলাম।

লঞ্চ চলাচলও কার্যত বন্ধ : ঢাকা নদী বন্দর সূত্রে জানা গেছে, সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঢাকায় এসেছে ৭টি ও ছেড়ে গেছে ৫টি লঞ্চ। যেসব লঞ্চ ঢাকায় এসেছে সেগুলো শুক্রবার ছেড়ে আসা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএর একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাধারণ সময়ে ৫০টির বেশি লঞ্চ ঢাকায় আসে এবং একই সংখ্যক লঞ্চ ছেড়েও যায়। বিএনপির সমাবেশে মানুষ যাতে না আসতে পারে সেজন্য মালিকরা নিজেরাই লঞ্চ বন্ধ রেখেছেন। সরকার থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা ছিল না। জানতে চাইলে পারাবতের লঞ্চের মালিক শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, যাত্রী না থাকায় লঞ্চ ছাড়া হয়নি। শনিবার বিকাল থেকে যাত্রী সদরঘাট আসছে। লঞ্চও ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি বলেন, কারও নির্দেশনায় লঞ্চ বন্ধ ছিল না।

সদরঘাট-কেরানীগঞ্জ নৌকা পারাপার বন্ধ : সদরঘাট-কেরানীগঞ্জ নদী পারাপারে নৌকাও বন্ধ ছিল। ঘাটে সারি সারি নৌকা থাকলেও মাঝিরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। নৌ চলাচল বন্ধ থাকায় ঘাটে এসে যাত্রীরা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে ফিরে গেছেন। এতে ভোগান্তিতে পড়েন দু’পারের যাত্রীরা। ঘাটে নৌকা পারাপার বন্ধ থাকায় যাত্রীদের অনেককে বাবুবাজার সেতু দিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে।

ক্ষোভ প্রকাশ করে শুভাঢ্যার বাসিন্দা সেলিম উদ্দিন বলেন, ওপারে (কেরানীগঞ্জ) আমার বাসা। সেখানে আমার কাপড়ের দোকান। ওয়ারীতে বোনের বাসায় মায়ের সঙ্গে দেখা করে ঘাটে এসে দেখি নৌকা বন্ধ।

কয়েকজন নৌকার মাঝি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঘাট ইজারাদাররা নৌকা বন্ধ রাখতে বলেছে। কেউ যাত্রী পার করলে তাকে আর নৌকা চালাতে দেওয়া হবে না বলে শাসিয়ে দিয়েছে। এ কারণে আমরা নৌকা বন্ধ রেখেছি। নৌকা বন্ধ থাকায় আমাদের আয় নেই, যাত্রীদেরও ভোগান্তি হচ্ছে।

যুগান্তর প্রতিবেদন ও প্রতিনিধির পাঠানো খবর-

উত্তরা পশ্চিম (ঢাকা) : দুপুরে উত্তরার আব্দুল্লাহপুর, হাউজবিল্ডিং, আজমপুর, জসিমউদ্দিনসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন যাত্রীরা। বেশিরভাগই উত্তরা থেকে গাজীপুর যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন। আবার আব্দুল্লাহপুরে অনেকে দাঁড়িয়েছিলেন ঢাকামুখী বাসের অপেক্ষায়। দীর্ঘ অপেক্ষার পরও গাড়ি না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন যাত্রীরা।

গাজীপুর : ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ও জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল মহাসড়কে দূরপাল্লার গাড়ি চলেনি। চান্দনা চৌরাস্তা থেকে শুরু করে ভোগড়া বাইপাস, চন্দ্রা মোড়, টঙ্গী, মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় গাড়ি না থাকায় যাত্রীদের হেঁটে চলাচল করতে দেখা যায়।

নারায়ণগঞ্জ : শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালসহ সব বাসস্ট্যান্ডেই যাত্রীবাহী বাস ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। যাত্রীরা হতাশ হয়ে বিকল্প পন্থায় ছুটেছেন গন্তব্যে। তবে এক্ষেত্রে যাত্রীদের স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়েছে। অপরদিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে পাঁচ রুটে চলাচলকারী প্রায় অর্ধশত যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করেনি। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ সংস্থার দাবি, যাত্রী সংকটের কারণে কোনো লঞ্চ ছেড়ে যায়নি।

টাঙ্গাইল ও ভূঞাপুর : সকাল থেকে টাঙ্গাইল নতুন বাস টার্মিনাল থেকে কোনো বাস ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়নি। উত্তরবঙ্গ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে অন্যান্য দিনের মতো বাস চলাচল করেনি। এ কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক ছিল অনেকটাই গণপরিবহণ শূন্য। এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা জোয়াহেরুল ইসলাম এমপির নেতৃত্বে অন্তত ৩০০ গাড়িতে প্রায় ১৫ হাজার নেতাকর্মী সাভার গেছেন।

কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) : কেরানীগঞ্জের তেলঘাট থেকে খোলামোড়া পর্যন্ত ১৫টি খেয়াঘাট রয়েছে। এসব ঘাট থেকে প্রায় ৪ হাজার খেয়া নৌকা বুড়িগঙ্গায় যাত্রী পারাপার করে থাকে। ভোর থেকে বুড়িগঙ্গা নদীতে খেয়া পারাপার বন্ধ হয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাঝি জানান, রাতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা এসে নৌকা চালাতে নিষেধ করেছেন।

রাজবাড়ী : দৌলতদিয়া-পাঁটুরিয়া নৌরুটের ঢাকা-খুলনা জাতীয় মহাসড়কে তেমন যানবাহন দেখা যায়নি। ইজিবাইক ও মাঝেমধ্যে দুই একটা লোকাল বাস দেখা গেছে।

শিবচর (মাদারীপুর) : সকাল থেকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে দুই/একটি ট্রাক, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস দক্ষিণাঞ্চলমুখী যেতে দেখা গেছে। তবে ঢাকামুখী কোনো যানবাহন মহাসড়কে ছিল না।

সাভার : সকাল থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, নবীনগর-চন্দ্রা ও বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, ফাঁকা সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করছে পুলিশ। দূরপাল্লার কোনো গণপরিবহণ দেখা যায়নি। রিকশা, মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত পরিবহণের সংখ্যাও ছিল তুলনামূলক কম।

শ্রীনগর (মুন্সীগঞ্জ) : সকাল থেকে ঢাকা মাওয়া-সড়কে কোনো যাত্রীবাহী বাস চলাচল করেনি। তবে মাঝেমধ্যে কিছু মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, সিএনজি অটোরিকশা দেখা গেছে।

সিদ্ধিরগঞ্জ ও দক্ষিণ (নারায়ণগঞ্জ) : সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড, মৌচাক, শিমরাইল মোড়ে ঢাকাগামী অনেক যাত্রীকে যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। শিমরাইল মোড় দিয়ে পূর্বাঞ্চলের ১৮টি জেলার কোনো পরিবহণ চলেনি। দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ থাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসে গন্তব্য যান যাত্রীরা।