এ লেখা প্রথম আলোয় প্রকাশিত আনিসুল হকের কলাম ‘ঘুষ নেয় না কেবল বোকারা’ শীর্ষক কলামের পাঠপ্রতিক্রিয়া। ঘুষ গ্রহণে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বোকা-চালাক, ধনী-দরিদ্র, বড় কর্তা-ছোট কর্তা এমন বর্গীকরণের সুযোগ কম। ঘুষ বাস্তবতা আজ সর্বজনীন সত্য। ঘুষ নিয়ে ভাববাদী ভাবনা ধূসর হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি। ঘুষ বিষয়ে নৈতিক দ্বন্দ্বের সীমারেখা ক্ষীণ হচ্ছে।
সলিমুল্লাহ খান ‘আহমদ ছফার গব্যপুরাণ’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ঘুষ শব্দটি ফারসি, আদি অর্থ ‘কান’। কানে ফিসফিস করিয়া যে টাকা গছাইয়া দেওয়া হয় তাহাকেই ‘ঘুষ’ বলে। ঘুষ ঘৃণার যোগ্য। তবে এ ঘৃণা এখন অবিকৃত বা বিশুদ্ধ নয়। এ ঘৃণা সংশয়সূচক। দাতা–গ্রহীতা ঘুষের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, অপছন্দ করছেন কিন্তু বাস্তবতা হলো ঘুষ চালু রয়েছে। অনেক চাকরিজীবী বেতনের চেয়ে বেশি ঘুষ পান। তাঁরা বেতনজীবী না ঘুষজীবী, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়?
ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার দারুণ জন-অভ্যাস গড়ে উঠেছে! মানুষ ঘুষ দিতে চায়। কাজ উদ্ধার করতে চায়। অফিস-আদালতে ঘুষগ্রহীতাদের উদ্দেশ্যে ঘুষদাতাদের একটি শব্দ কানে বিঁধে, ‘খরচা আছে না?’ মানুষ যে খুশি হয়ে ঘুষ দিচ্ছে, তা নয় বরং ঘুষ দিচ্ছে কাজ তুলে নেওয়ার জন্য। কারণ, মানুষ জেনে গেছে সৎ থাকাটা ব্যয়বহুল।
পেশাগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অনেকে ঘুষ দিতে না পারলে মন খারাপ করেন। বিশেষত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা ঘুষের হিসাব কষতে পারঙ্গম হয়ে উঠেছেন। কারণ, ঘুষ ছাড়া ফাইল বা বিল ছাড়ানো যায় না। চাকরি, সেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে ঘুষের দাম বেড়েছে। দেশে কেবল মুদ্রাস্ফীতি হয় না, ঘুষেরও স্ফীতি ঘটে।
অফিসভেদে ঘুষের পরিমাণে পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্য লিখিত না। অলিখিত হলেই তো কোনো কিছু অসত্য হয়ে যায় না। বরং ঘুষ সত্য ঘটনা, যা মানুষ দেখে ফেলেছে। মানুষ যা একবার দেখে ফেলে, তাকে অদেখা বানানো যায় না।
ভূমি অফিসে সরকার–নির্ধারিত ফি দিয়ে নামজারির আশায় মাসের পর মাস না ঘুরে কিছু ঘুষ দিলে যদি কাজ হয়, তাতে মন্দ কী? ঘুষ না দিলে অফিসে গিয়ে ছোট-বড় কর্তাদের ভাবভঙ্গি দেখা, ছোটখাটো অজুহাতে বারবার আবেদন বাতিল বা সার্ভার ডাউনের মতো তথাকথিত অজুহাত শুনতে হয়।
ঘুষ দিলে সিএনজি ভাড়া, অফিস ছুটির বিড়ম্বনা, মানসিক দুশ্চিন্তা ও পরিবারের চাপ এড়ানো যায়। ঘুষের পরিমাণ, সৎ থাকার চেষ্টা এবং কাজ না হওয়ার আশঙ্কা এতগুলোর বিকল্পের মধ্যে ঘুষ দিয়ে ফেলেই সেবাগ্রহীতার কাছে উত্তম পন্থা বলে বিবেচনা হচ্ছে।
আকবর আলি খান তাঁর পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে দ্বিতীয় অধ্যায় ‘শুয়োরের বাচ্চাদের’ অর্থনীতিতে একজন পাঞ্জাবি লোকের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন, ‘এই দুর্ভাগা দেশে তিন কিসিমের লোক আছে। আছেন সজ্জন যাঁরা ঘুষ খান না, যেমন আপনি। আছে বদলোক যাঁরা ঘুষ খান এবং (আমার চোখের দিকে চেয়ে) আছে শুয়োরের বাচ্চারা যারা ঘুষ নেয় অথচ ঘুষ প্রদানকারীকে কোনো সাহায্য করে না ।’
সুতরাং ঘুষ দেওয়া শেষ কথা নয়। কাজ উদ্ধার চূড়ান্ত অভিলক্ষ্য। ঘুষ দিয়ে কাজ উদ্ধার করা বিশেষ দক্ষতা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। অনেকে ঘুষ নেন কিন্তু কাজ করেন না, টাকা মেরে দেন, এ ধরনের মানুষের সংখ্যা সমাজে একেবারে নগণ্য নয়, যাদের কথায়ই উল্লেখ করেছেন আকবর আলি খান।
ঘুষের টাকায় গড়ে উঠছে এক নতুন শ্রেণি। এ শ্রেণির সবাই বড় চাকরি করেন না। ঘুষের অর্থে তাঁরা আপন সৌধ গড়ছেন। তা গড়ছেন দেশে ও বিদেশে। একধরনের অপরাধবোধ থেকে ধর্মীয় কাজ ও সহায়-সম্বলহীনদের সহায়তায় এগিয়ে আসছেন। সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে দেশ-বিদেশে পাঠাচ্ছেন। ঘুষের এ উৎপাদ আগামী দিনে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে। মন্দ কী!
ঘুষের ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক নিয়ে জানা শেষ কথা নয়। বরং এ বিষয়ে নিগূঢ় সত্য জানা জরুরি। সক্রেটিস বলেছিলেন, মানুষ কখনো জেনে ভুল করে না। যদি করে তাহলে বুঝতে হবে জানাতে ভুল আছে। ঘুষের ক্ষেত্রেও এটি সত্য। ঘুষজ্ঞানে এখন নেই কোনো পরিপক্বতা। একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে নৈতিকতার অবজেক্ট মূল্য নেই। এখানে নৈতিকতা কাজে লাগানোর সুযোগ কম। তবে কি মানুষ নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকবে? উত্তর—না। তাকে বিকল্প খুঁজতে হয় আর সেই বিকল্প হলো ঘুষের পথ।
অনলাইনভিত্তিক ‘বিশ শব্দের গল্প গ্রুপে’ একটি গল্প বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গল্পটি হলো: অফিসে ঘুষের টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা চলছে। একজন কর্মচারীকে ঘুষের টাকার ভাগ দেওয়া হচ্ছে না। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, ঘুষের টাকার ওপর কি তার ন্যায্য হক নেই? গল্প থাকে সমাজবাস্তবতার প্রতীকী উপস্থাপন। যে সমাজে ঘুষের টাকার ওপর ন্যায্য হক প্রতিষ্ঠিত হয়, সে সমাজের ক্ষয় ও ক্ষরণ কত গভীর, তা সহজেই অনুমেয়।
ঘুষ অভিযোজন এক বিশেষ প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামে গিয়ে দেখলাম একজন ভূমিহীন বর্গাচাষি দুটি গরু পালছেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী জন্য গরু পালন করছেন, আপনার তো জমি-জিরাত নেই। প্রত্যুত্তরে বললেন, ছেলে মাস্টার্স পাস করলে চাকরির জন্য ঘুষ দিতে হবে। তখন সে কোথায় টাকা পাবে? ঘুষের টাকা সংগ্রহ করার জন্য তিনি আগাম দুটি গরু পালছেন। ঘুষ ব্যবস্থাপনায় একজন প্রান্তিক বর্গাচাষির এ উদ্যোগ আজ এক নিদারুণ বাস্তবতা?
ঘুষহীনতায় গতি নেই। ঘুষ মানেই গতিশীলতা। দেশের সার্বিক অগ্রগতির পেছনে ঘুষের উপযোগিতা অস্বীকার করা যায়। কারণ, ঘুষ না থাকলে কর্মস্পৃহা ও উদ্যম থাকে না। সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রে ঘুষ জীবন্ত সত্তা। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পেছনে রয়েছে ঘুষকেন্দ্রিক নেক্সাস। অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে রেন্ট সিকিং ইকোনমি। উৎপাদনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থেকেও যাঁরা নানাভাবে লাভ তুলে নেন, তাঁরা হলো রেন্টসিকার। ঘুষ একক ব্যাপার নয়, এর রয়েছে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সংস্করণ। ঘুষ অনেক পক্ষের পারস্পরিক সমঝোতামূলক এক যজ্ঞ।
বালিশ ক্রয়, সরকারি অফিসে বিভিন্ন আসবাবপত্র ক্রয়ে দুর্নীতির প্রতিবেদন দেখে পাঠক আহত হন, উদ্বিগ্ন হন। এ আহত বা উদ্বিগ্নতা যত না ঘুষের কারণে, তার চেয়েও ঘুষের পরিমাণগত অস্বাভাবিকতার কারণে। এ অস্বাভাবিকতাই হলোÔ‘ঘুষ শক’। ঘুষের পরিমাণ সহনশীল মাত্রায় থাকলে তা সংবাদ হতো না বা পাঠক আহত হতেন না। আবারও বলি, কাজ ও সেবা পেতে ঘুষের পরিমাণ নিয়ে মোটামুটি একটা স্ট্যান্ডার্ড দাঁড়িয়ে গেছে। সেবাগ্রহীতা ঘুষ প্রদানে এক সহনশীল অভ্যাসের আওতায় চলে এসেছেন।
নৈতিকতার গুরুত্ব ছোট করে দেখছি না। কিন্তু এর মূল্য আজ অনেক বেশি। নৈতিকতা ধরে রাখতে গিয়ে জরুরি প্রয়োজনে আপনি সেবা না–ও পেতে পারেন। যেমন জরুরি পাসপোর্টের কথা ভাবুন। ভালো ভালো কথা কাগজে লেখা থাকে, থাকে নীতি-পরিকল্পনা ও বিজ্ঞাপনে। কিন্তু তা সব সময় প্রকৃত বাস্তবতা নয়। বাংলাদেশ আজ অনেকগুলো নিষ্ফলা দলিলে সমষ্টি।
বাস্তবতা হলো জনগণকে ঘুষনির্ভর সমাজে বাস করতে হচ্ছে। এ ধরনের সমাজে বাস করতে নাগরিকের বিশেষ কিছু দক্ষতা লাগে। এমন দক্ষতা সবার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয় না। যাঁরা এসব দক্ষতা অর্জন করতে পারেন না, তাঁরা পিছিয়ে পড়েন, কখনো কখনো হতাশায়ও ভোগেন। বিরক্ত হয়ে যেতে চান দেশ ভূগোলের বাইরে।
ঘুষের সমাজতত্ত্ব বিবেচনা ছাড়া এ দেশে বহু দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি নিয়ে কাজ করছে। তাদের কাজ মূলত পারফরম্যান্স–বেজড অর্থাৎ গাণিতিক হিসাব-নিকাশ ও সূচক মূল্যায়ননির্ভর। ঘুষের রমরমা বাজারের ব্যবচ্ছেদ দরকার।
দুর্নীতি প্রতিরোধে চলছে গণমাধ্যমসহায়ক প্রদর্শনবাদ, যা গুটিকয়েককে দুর্নীতিবিরোধীকে মুখপত্র হয়ে উঠতে সাহায্য করছে। এসব তৎপরতা বিশেষ কোনো সুফল দিচ্ছে না। দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলার সময় বাধা না দেওয়া, চুপচাপ থাকা বা মৌনসম্মতি দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে, যা ঘুষ পরিস্থিতি পুষ্টকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
অফিসে যতটুকু প্রবেশগম্যতা, ঠিক ততটুকু ঘুষ দেখা যায়। কিন্তু এটি শেষ কথা নয়। এর বাইরেও রয়েছে ঘুষের লম্বা ছায়া। যেমন ২০১৭ সালে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয় যে অর্পিত সম্পত্তি ফিরে পেতে লেগেছে ২ হাজার ২৭০ কোটি টাকা ঘুষ।
ঘুষের টাকায় গড়ে উঠছে এক নতুন শ্রেণি। এ শ্রেণির সবাই বড় চাকরি করেন না। ঘুষের অর্থে তাঁরা আপন সৌধ গড়ছেন। তা গড়ছেন দেশে ও বিদেশে। একধরনের অপরাধবোধ থেকে ধর্মীয় কাজ ও সহায়-সম্বলহীনদের সহায়তায় এগিয়ে আসছেন। সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে দেশ-বিদেশে পাঠাচ্ছেন। ঘুষের এ উৎপাদ আগামী দিনে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে। মন্দ কী!
ঘুষ বন্ধে কার্যকর রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার। বাংলাদেশ অঙ্গীকারের মেঘমালা, যেখানে বৃষ্টি ঝরে কম, অঙ্গীকার পূর্ণতা পায় কম। আরবি ভাষায় একটি প্রবাদ রয়েছে, যার বাংলা হলো: অঙ্গীকার হলো মেঘ আর এর পূর্ণতা হলো বৃষ্টি। ঘুষ বন্ধে অঙ্গীকার পূর্ণতা পাক সেই বৃষ্টির জন্য অধীর অপেক্ষায়।
- খান মো. রবিউল আলম যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ