গ্রামে ব্যাংকে আমানত কমেছে ২৭.৫৬%

উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সঞ্চয় কমেছে মানুষের। পাশাপাশি গত প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আহরণ কমেছে ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ১৩ শতাংশ। এ দুয়ের প্রভাবে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে গ্রামে ব্যাংক আমানত কমেছে এক-চতুর্থাংশেরও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত প্রান্তিকে দেশের গ্রামাঞ্চলের ব্যাংকগুলোয় জমা আমানত হ্রাস পেয়েছে আগের প্রান্তিকের (এপ্রিল-জুন) তুলনায় প্রায় ২৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

এপ্রিল-জুন প্রান্তিক শেষে গ্রামে তফসিলি ব্যাংকের শাখাগুলোয় জমা আমানতের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৭৫৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা। জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে তা নেমে এসেছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৭০ কোটি ২২ লাখ টাকায়। সে অনুযায়ী, তিন মাসের ব্যবধানে গ্রামাঞ্চলের ব্যাংকগুলোয় জমা আমানতের পরিমাণ কমেছে ৯৮ হাজার ৮৮৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

মাত্র তিন মাসে গ্রামে ব্যাংক আমানত প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি কমে যাওয়ার বিষয়টি এখন ভাবিয়ে তুলছে অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের। তারা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন। দেশে আহরিত রেমিট্যান্সের মূল গন্তব্যস্থল হলো গ্রামাঞ্চল। এ রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশ ব্যাংকে জমা হয় আমানত হিসেবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে রেমিট্যান্সের পাশাপাশি গ্রামের ব্যাংকগুলোয়ও আমানত ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪৯০ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। ২০২২ সালের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৫৬৭ কোটি ২৮ লাখ ডলার। সে হিসাবে গত প্রান্তিকে এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে সাড়ে ১৩ শতাংশের কিছু বেশি।

গ্রামের ব্যাংকগুলোয় আমানত কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন বলে মনে করছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গ্রামের অর্থনীতির অবস্থা শহরের চেয়ে ভালো। সেখানে আমানত কমে যাওয়ার কারণটি সুস্পষ্ট না। মূল্যস্ফীতির কারণে আমানত কিছুটা কমতে পারে। তবে এটা এত কমার কথা না।’

গ্রামীণ শাখাগুলোয় আমানত কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, রেমিট্যান্সসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোয় আমানত কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বেশি। রেমিট্যান্স বৈধ চ্যানেলে এলে সেটির একটি অংশ ব্যাংকের শাখাগুলোয় আমানত হিসেবে জমা হয়। কিন্তু হুন্ডির মাধ্যমে এলে সে অর্থ ব্যাংকে ফিরতে অনেক সময় লাগে। এছাড়া গত প্রান্তিকে গ্রামের ব্যাংক আমানত কমে যাওয়ার পেছনে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ আর অর্থনৈতিক মন্দারও ভূমিকা রয়েছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘‌প্রায় দুই বছর ধরে দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি মন্থর। এ কারণে দেশের ব্যাংক খাতে তারল্যের সংকটও তৈরি হয়েছে। কিছু ব্যাংক এখন ১২-১৩ শতাংশ সুদেও আমানত সংগ্রহের ঘোষণা দিচ্ছে। এর পরও প্রত্যাশিত আমানত মিলছে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে ব্যাংকে সঞ্চয়ের মতো অর্থ বেশির ভাগ মানুষের হাতেই অবশিষ্ট থাকছে না। আবার জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের আতঙ্ক আছে। নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত হলে ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি ফিরে আসতে পারে।’

দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আমানতকারীদের একটি বড় অংশের সঞ্চয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশসহ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোয় জমা রয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে এ ধারার বেশির ভাগ ব্যাংকের কর্মকাণ্ড নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চলছে। এতে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর আমানত প্রবাহ কমেছে। বিশেষ করে এ ধারার ব্যাংকের গ্রামীণ শাখাগুলোয় আমানত তুলে নেয়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

শরিয়াহভিত্তিক একটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, ‘‌অনেক গ্রাহকই ব্যাংকের শাখা থেকে আমানত তুলে নিচ্ছেন। নেতিবাচক প্রচারণার কারণে মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামের মানুষ এ ধরনের প্রচারণায় প্রভাবিত ও আতঙ্কিত হয় বেশি। এ কারণে আমাদের গ্রামীণ শাখাগুলোয় আমানত উত্তোলন বন্ধ করা যাচ্ছে না।’

শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর গ্রামীণ শাখা থেকেও আমানত কমে যাচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। যদিও এ সময় দেশের ব্যাংক খাতে জমা মোট আমানতে প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় ছিল। চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোয় মোট আমানত জমা ছিল ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা। জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে তা ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১৩ হাজার ১৩৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকায়।

গ্রামের মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে সঞ্চয় ভাঙছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ব্যাংকের স্থানীয় শাখার ব্যবস্থাপকরাও। দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেডের যশোর শাখার ব্যবস্থাপক (এসএভিপি) রবিউল ইসলাম জানান, মূলত জীবনযাত্রার মান অনেক বেড়ে যাওয়ায় মানুষ সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি হওয়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা আয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে চলতে পারছে না। যে কারণে তারা ডিপিএস ভেঙে ফেলছে। এতে আমাদের আমানতও কমে আসছে।

চলতি ২০২৩ সালের শুরু থেকেই দেশে মূল্যস্ফীতির হার রয়েছে ১০ শতাংশের কাছাকাছি। আর গত সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ হলেও খাদ্যে তা ১২ শতাংশের বেশি ছিল। এ সময় গ্রামের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারও ছিল শহরের তুলনায় বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক অন্যান্য সেবার ব্যয় বেড়েছে। গ্যাস থেকে শুরু করে কৃষি উপকরণ এবং পশু, পোলট্রি ও মৎস্য খাদ্যের দাম বেড়েছে। সব মিলিয়ে জীবনযাত্রা, কৃষিসহ সবদিকেই ব্যয় বেড়েছে। এতে মানুষকে সঞ্চয়ে হাত দিতে হচ্ছে। আবার আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে এক ধরনের আশঙ্কাও অনেকের মধ্যে কাজ করেছে। অনেকেই হয়তো আপৎকালীন ব্যয়ের জন্য টাকা ধরে রাখছে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, বিভাগভিত্তিক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত আমানত কমেছে ঢাকার গ্রামীণ এলাকায়। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চট্টগ্রামের গ্রামীণ এলাকায় আমানত কমেছে ১৯ শতাংশ। ১১ শতাংশ আমানত কমেছে সিলেট বিভাগের। আর রাজশাহী ও বরিশালে এ হার সাড়ে ৮ শতাংশের বেশি। ময়মনসিংহ বিভাগেও এ হার ২ শতাংশ।

আমানত ব্যাপক মাত্রায় কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সংশয়ে আছেন খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাও। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘‌গ্রামীণ আমানত এতটা কমে যাওয়ার তথ্যটি অস্বাভাবিক। এ বিষয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের কাছে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হবে। আমানতের তথ্য সন্নিবেশিত করার ক্ষেত্রে ভুলও হতে পারে।’

যদিও পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি মনে করছেন মূল্যস্ফীতির প্রভাবেই এমনটি ঘটে থাকতে পারে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌আগে গ্রামের মানুষ ১০০ টাকার মধ্যে ৮০ টাকা ব্যয় হলে ২০ টাকা সঞ্চয় করত। এখন সেই ব্যয় ৯৫ টাকায় ঠেকেছে। তাই ৫ টাকা সঞ্চয় হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সঞ্চয় শূন্য হয়ে উল্টো ধার করে চলতে হচ্ছে। কারণ আয় ঠিক থাকলেও মূল্যস্ফীতি এত পরিমাণে বাড়ছে যে তাদের সঞ্চয়ে হাত দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ ভোক্তাদের ব্যয়যোগ্য আয় কমছে। আবার ভোক্তার ভোগপ্রবণতাও আগের চেয়ে বেড়েছে। তাই তারা ভোগে বেশি ব্যয় করে কম সঞ্চয় করছে।’

সূত্র : বনিক বার্তা