গুলিবিদ্ধ সাইম ও রায়হানের চিকিৎসা ঋণের টাকায়, কিস্তি পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পরিবার

পকেটে থাকা মুঠোফোন ভেদ করে ঢোকা গুলিতে ঊরুর হাড় ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছিল মো. সাইমের
পকেটে থাকা মুঠোফোন ভেদ করে ঢোকা গুলিতে ঊরুর হাড় ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছিল মো. সাইমেরছবি: সংগৃহীত

 

৫ আগস্ট, বেলা দেড়টা। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় ছাত্র-জনতার এক দফা দাবির বিক্ষোভ মিছিল থেকে ফিরছিলেন মো. সাইম। হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি গুলি এসে লাগে সরকারি হাটহাজারী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করা মো. সাইমের ডান পায়ের ঊরুতে। এরপর বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি।

সাইমের অভিযোগ, চিকিৎসার জন্য সরকার থেকে এখন পর্যন্ত এক টাকাও অর্থসহায়তা পাননি তিনি। একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চিকিৎসার খরচ সরবরাহ করছে তাঁর পরিবার। এই কিস্তির টাকা পরিশোধ করে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁর বাবাকে।

মো. সাইমের বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার রহুল্লাপুর গ্রামে। বাবা মোহাম্মদ সিরাজ পেশায় নিরাপত্তাপ্রহরী। দুই বোন আর এক ভাইয়ের পরিবারের একমাত্র আশার আলো ছিলেন সাইম। তবে গুলি লাগার পর থেকে অনিশ্চয়তায় দিন কাটাতে হচ্ছে সাইমকে।

জানতে চাইলে সাইম প্রথম আলোকে বলেন, গুলিটি তাঁর পকেটে থাকা মুঠোফোন ভেদ করে ঊরুর হাড় ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছিল। ১২ দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর গত ১৭ আগস্ট অস্ত্রোপচার করে তাঁর ঊরুতে রড লাগানো হয়। তিনি ৩০ আগস্ট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান। ওই দিন চিকিৎসকেরা এক মাস পর যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। অবস্থার উন্নতি না হলে দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারও করতে হবে বলেও জানানো হয়েছিল তাঁকে।

সাইম বলেন, তাঁর অবস্থার উন্নতি হয়নি। তাঁকে এখনো পা সোজা রাখতে হয় সব সময়। ক্রাচে ভর করে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন তিনি। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারের কথা জানালেও এখন সে বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তাঁকে বলা হচ্ছে মাসখানেক সময় নিয়ে দেখতে। তবে তিনি কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করেছেন। তাঁরা অস্ত্রোপচার করা যাবে বলে জানিয়েছেন। অন্যথায় ভবিষ্যতে চলাফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে বলে জানানো হয়েছে।

সরকার থেকে আর্থিক সহায়তা পাননি অভিযোগ করে সাইম বলেন, প্রতি মাসে তাঁদের ১০ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হচ্ছে। স্বল্প আয়ের সংসারে এই চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে তাঁর পরিবার। এখন পর্যন্ত তাঁর এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তিনি ৩০ হাজার টাকা বেসরকারি সহায়তা পেয়েছেন। সরকার কিংবা জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে এক টাকাও পাননি। টাকার অভাবে দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার করাতে পারছেন না।

গুলিবিদ্ধ রায়হানেরও চিকিৎসা ব্যাহত

সাইমের মতো আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আবু রায়হান। ৪ আগস্ট মাদ্রাসার কাছে এক মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। এর পর থেকে নগরের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

জানতে চাইলে আবু রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বাড়ি কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার বড় মহেশখালীর পাহাড়তলী গ্রামে। বাবা আবুল কালাম পেশায় দিনমজুর। সংসারে সারা বছর আর্থিক অনটন লেগেই থাকে। অর্থকষ্টে তাঁর ছোট ভাইয়ের লেখাপড়া শেষ করাতে পারেননি তাঁরা।

নিজের অর্থকষ্টের কথা জানিয়ে আবু রায়হান বলেন, তাঁর প্রতিদিন দুই হাজার টাকার ওষুধ লাগে। ৪ আগস্ট রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম অস্ত্রোপচারে গুলি বের করতে পারেননি চিকিৎসকেরা। ওই দিনই পরিবারের লোকজন তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখান তাঁর দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করা হয়। এখন পর্যন্ত চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে। স্থানীয় দুটি সমবায় সমিতি থেকে দুই লাখ আর বাকি টাকা আত্মীয়দের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন তাঁর বাবা। এখন প্রতি সপ্তাহে তাঁদের ৫ হাজার ১০০ টাকা করে কিস্তি দিতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে তাঁদের অর্থকষ্টে দিন যাচ্ছে।

আন্দোলনে চট্টগ্রামে আহত হয়েছেন এমন ৩৯৪ জনের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এর মধ্যে প্রায় ৭০ জন এখনো চিকিৎসাধীন। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে রয়েছেন ২০ জন আর নিয়মিত ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসক দেখাচ্ছেন আরও ১০ জন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটির চট্টগ্রামের প্রতিনিধি মো. এনামুল হক প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

মো. এনামুল হক বলেন, এখন পর্যন্ত সরকার কিংবা জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আহতদের কেউ এক টাকাও পাননি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ও পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা ফ্রি। তবে এসব হাসপাতালে সব ধরনের পরীক্ষা করা যায় না। এ ছাড়া যাতায়াত খরচ, ওষুধের খরচও দেওয়া হয় না। আর ভিড় তো লেগেই থাকে। তিনি আরও বলেন, এত দিন তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় থেকে সহায়তা নিয়ে আহতদের খরচ দিয়েছেন। তবে এখন আর কেউ সহায়তা দিচ্ছে না। অন্তত আটজন তাঁদের কাছে টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না জানিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।

prothom alo

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here