গুরুতর অভিযোগ লঘুতর জবাব

Daily Nayadiganta

গুরুতর অভিযোগ লঘুতর জবাব – নয়া দিগন্ত

এক একটি প্রতিষ্ঠান, পেশা বা বিষয়ে নিজস্ব কিছু গতানুগতিক শব্দাবলি বা বাকভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। যারা সংবাদপত্রের মানুষ এবং যারা রাজনীতি করেন তাদের কাছে একটি পরিচিত শব্দগুচ্ছ: ‘সর্বৈব মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। সংবাদকর্মীরা লেখেন এবং রাজনীতিবিদ বা কোনো কোনো সময়ে ব্যক্তিগত বয়ানেও এ ভাষা যথেচ্ছ ব্যবহৃত হয়। পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ খণ্ডাতে এ যেন এক গৎবাঁধা বুলি। ঠিক ১০ দিন আগে ২০ ডিসেম্বর ২০২০ সব সংবাদপত্রে ফলাও করে একটি খবর ছাপা হয়। ‘ইসির অভিসংশনযোগ্য অপরাধের তদন্ত দাবি, বিশিষ্টজনদের সংবাদ সম্মেলন’। দেশের শীর্ষস্থানীয় ৪২ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি এই নিরুত্তাপ সময়ে কিছুটা উত্তাপ ছড়ায়। স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকারি দলের কর্তা ব্যক্তিরা ইসির ইজ্জত রক্ষায় উদ্ধারকারী হামযার মতো এগিয়ে আসেন। লক্ষণীয়, অভিযোগগুলো কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে ছিল না। সেই যে কথা আছে, ‘পাক ঘরে কে- আমি কলা খাই না’-এর মতো। যাই হোক, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা নিজেই এগিয়ে আসেন অভিযোগ খণ্ডনে। ২৪ ডিসেম্বর ২০২০ আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে আহূত এক সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত অভিযোগগুলোকে সিইসি ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে মন্তব্য করেন। ৪২ নাগরিকের অভিযোগগুলো ছিল-গুরুতর। তার জবাব যেভাবে তিনি দিয়েছিলেন তাকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বলতে চান-লঘুতর। গতানুগতিক জবাবে সন্তুষ্ট হয়নি গণমাধ্যম। সচেতন নাগরিক সাধারণ বলছেন, গুরুতর অভিযোগগুলো এড়িয়ে গতানুগতিক উত্তর দেয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আনা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। একই সাথে সিইসি দাবি করেন, তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি পদে ২-৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ভোট পড়ে ৬০-৮০%। নির্বাচনের প্রতি আস্থা চলে গেছে এমন মন্তব্যও নাকচ করেন সিইসি নুরুল হুদা। বক্তব্যের শুরুতেই সিইসি বলেন, ইসির বিরুদ্ধে ৪২ নাগরিকের আনা অভিযোগ নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। বিষয়টি কমিশনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা প্রয়োজন বলে এই সংবাদ সম্মেলন। ইসিকে দায়ী করে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে তা অনভিপ্রেত এবং গ্রহণযোগ্য নয়। বক্তব্য শেষে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে চাইলে তিনি জানান, কোনো প্রশ্ন নেয়া হবে না। লিখিত বক্তব্যে তিনি ৪২ নাগরিকের অভিযোগের উত্তরে যেসব বিষয়ের অবতারণা করেন তা এরকম : একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রশিক্ষণের জন্য ১৫ জন বিশেষ বক্তার সম্মানিভাতা বাবদ এক কোটি চার লাখ টাকা এবং পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৪৭ লাখ ৭০ হাজার সংস্থান রাখা হয়। ১৫ জন বিশেষ বক্তার জন্য কর্মপরিকল্পনায় দুই কোটি টাকার বরাদ্দই ছিল না। বিশেষ বক্তা হিসেবে বক্তৃতা দেয়ার নামে দুই কোটি টাকার মতো আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়মের অভিযোগ অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে। যা ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী সব ব্যয় অডিটযোগ্য। অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি না হলে ব্যয়কৃত অর্থ কোষাগারে ফেরত যাবে। সব প্রক্রিয়া দালিলিক প্রমাণভিত্তিক। এ ক্ষেত্রে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। এভাবে সিইসি একই ভাষায় সব অভিযোগ নাকচ করে দেন। নির্বাচন প্রসঙ্গে তার বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। ইসি ভোটে অনিয়মসংক্রান্ত যেকোনো অভিযোগ আমলে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে দাবি করে সিইসি বলেন, এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে তা অনভিপ্রেত এবং আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন দেশের কুটনীতিকরা একাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা কোনো অভিযোগ তোলেননি। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি আদালতের দ্বারস্থ হয়ে থাকলেও আদালত থেকে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল বা পরিবর্তনসংক্রান্ত কোনো আদেশ ইসি পায়নি।

৪২ বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য মূলত নির্বাচনকেন্দ্রিক। ২০১৮ সালে এই নির্বাচন কমিশন চোখ-কান খোলা রেখে যেভাবে নির্বাচন ‘প্রকৌশল’কে বিনাদ্বিধায় অনুমোদন করেছে, এখনো করছে (ইসির সংবাদ সম্মেলন বক্তব্য) তা জাতিকে বিস্মিত করছে। তার কারণ নির্বাচন কিভাবে হয়েছে কী কী হয়েছে কারা নির্বাচন করেছে দেশের কোটি কোটি মানুষ তা দেখেছে। এখন যদি নির্বাচন কমিশন ছেড়া কাঁথা দিয়ে সূর্যের মতো সত্যকে ঢাকতে চান তা হবে অসার, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অস্বাভাবিক।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]