২৩ জানুয়ারী ২০২৩
আবু সালেহ ইয়াহিয়া
আজ ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি। আজ থেকে ঠিক ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারির মধ্য রাত। এই রাতেই আমাকে ঢাকা থেকে গুম করা হয়। আর এই গুম মিশনে নেতৃত্ব দেন ডিবির তৎকালীন এডিসি মি. শহীদুল্লাহ এবং এডিসি মি. আশিক।
পরিস্থিতি ছিল কিছুটা থমথমে। আমি তখন তৃতীয় বারের মত কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে রাজপথ উত্তপ্ত হচ্ছিল ঘন ঘন। আন্দোলনের প্রয়োজনে এবং প্রচার বিভাগের দায়িত্বের খাতিরে আমাকে প্রায় সব কর্মসূচীতেই থাকতে হত। এদিকে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে একশনে যাবার জন্য পূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আওয়ামী প্রশাসন। সঙ্গত কারণে তারা আমার মত নগণ্য মানুষটিকেও টার্গেট করেছিল। প্রতিমাসে একবার করে অসুস্থ মাকে আমি দেখতে সিলেটে যাওয়া ছিল আমার রুটিন। কিন্তু টানা ৪ মাস হয়ে গেলেও আমি সিলেটে যাইনি নিরাপত্তা সংকটের কারণে। ২৪ জানুয়ারি ২০১৩ ছিল আমার চাচাতো বোন হ্যাপির বিয়ে। আমার মরহুম চাচার আবেগ ও কান্না জড়িত অনুরোধ আমি ফেলে দিতে পারিনি। ভাবলাম, কতবারইতো গ্রেফতার হওয়া থেকে অলৌকিকভাবে আল্লাহ রক্ষা করেছেন। আল্লাহ ভরসা।
সিলেটে যাবার জন্য ঢাকার আরামবাগ থেকে গ্রীনলাইন বাসে উঠে আসন গ্রহণ করি। টিকেটটা কিনেছিল কেন্দ্রীয় অফিসের স্টাফ আমাদের সবার প্রিয় বাহাদুর। আমি অবশ্য টিকেট করতে বলেছিলাম আমাদের আরেক প্রিয়মুখ জাফরকে। জাফরকে আমি নিরাপত্তা জনিত কারণে ফোনে বলিনি। সরাসরি বলেছিলাম। জাফর সারাদিন ব্যস্ত থাকায় টিকেট কিনতে যেতে পারেনি এবং সে আমাকে তা না জানিয়ে বাহাদুরকে ফোনের মাধ্যমে টিকেট কেটে আমার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিতে বলে। আমার বিশ্বাস, জাফর এবং বাহাদুরের এই ফোনালাপই আমার যাতায়াতের তথ্য ডিবির কাছে পৌঁছে দেয়। কারণ আমাদের তথ্য জানার জন্য গোয়েন্দারা তাদের মোবাইলে আড়ি পাতত বলে আমরা জানি। আর এটাই স্বাভাবিক।
ভোরবেলাই সাংগঠনিক কাজে মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাই। বাসায় ফিরি রাত ১১ টায়। গোসল করে ক্লান্ত শরীরে একটু গা এলিয়ে দেই। ১১.৩০ এর দিকে টিকেট হাতে নিয়ে বের হয়ে যাই বাস স্টেশনের দিকে। সাথে নিয়ে যাই বাহাদুরকে। নজরদারি এড়াতে মোটরসাইকেল না নিয়ে রিক্সা করে সাধারণ যাত্রীর মত যাচ্ছিলাম আমরা। আলো আঁধারির পথ মাড়িয়ে নটরডেম কলেজের গেইটের অন্ধকার জায়গায় গিয়ে থামল রিক্সা। চারিদিকে ভাল করে তাকিয়ে নিলাম। সন্দেহজনক কিছুই নজরে পড়েনি। বাহাদুরকে বিদায় দিয়ে আল্লাহ উপর ভরসা করে টিকেট কাউন্টারে গিয়ে সতর্কতার সাথে চারিদিক একবার দেখে নিলাম। বাস এখনো আসেনি। টিকেট কাউন্টারে অপেক্ষা না করে বাইরে এসে চিরচেনা নয়াদিগন্ত পত্রিকার গলির অন্ধকারের মধ্যে দাড়িয়ে থাকলাম। ৫ মিনিটের মধ্যে বাস চলে আসল। অন্য যাত্রীদের সাথে বাসে উঠে নিজের সিটে (F-1) বসে পড়লাম।
ধীরে ধীরে বাস চলতে শুরু করল। আমি সিকিউরড একটি মোবাইল দিয়ে মাকে একটা ফোন দিয়ে দোয়া দুরুদ পড়তে ব্যস্ত। বাস ইতোমধ্যে ইত্তেফাক মোড় পেরিয়ে ডেইলি নিউনেশন পত্রিকার গেইটে চলে এসেছে। হঠাৎ করে ব্রেক করল বাস। গেইট খুললও হেল্পার। তারপর হুড় হুড় করে কোর্ট টাই পরা ২ জন ব্যক্তি বাসে উঠলেন। সবাই ভাবছিল উনারা যাত্রীই হবেন হয়ত। কিন্তু এদের চেহারা দেখেই আমার সন্দেহ হয়। আমার অজান্তেই আমার মন যেন আমাকে সতর্ক করে দেয়। আমার হাতে থাকা মোবাইলটি শব্দহীন ভাবে নিচে রেখে দিয়ে পা দিয়ে সরিয়ে দেই। চাদর দিয়ে মুখটা একটু ঢেকে ঘুমের ভাব করতে থাকি। ২/৩ সেকেন্ডের মধ্যেই উনারা আমার কাছে চলে আসেন। সামনে এডিসি শহিদুল্লাহ আর পেছনে এডিসি আশিক। শহিদুল্লাহ আমার চেহারার দিকে ভাল করে একবার তাকিয়ে নিজের হাতে থাকা মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে একবার তাকিয়ে নেন। তারপর খপ করে আমার শার্টের কলার চেপে ধরে আমাকে দাড় করিয়ে দেন। এদিকে আশিক বলে উঠেন, স্যার এইটাই, নিয়ে চলেন। কিন্তু শহিদুল্লাহ সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমার নাকে মুখে একের পর এক কিল ঘুষি দিয়ে বলতে থাকেন, “এই তোর সাথে আর কে আছে? তুই তো একা যাবার কথা না”।
বললাম, আমি একাই যাচ্ছি। বিশ্বাস না করে কিল ঘুষি চালাতেই থাকলেন। এক পর্যায়ে আমার হাতে থাকা টিকেট ও গায়ের চাদর ফ্লোরে পড়ে যায়। আশিক ফ্লোর থেকে পড়ে যাওয়া টিকেটটি তুলে চোখ বুলিয়ে বলল, স্যার টিকেট একটাই। শহিদুল্লাহ তবুও আশে পাশে সিটের মানুষদেরকে জিজ্ঞেস করছিল, উনারা কেউ আমার সাথে যাচ্ছে কিনা। তটস্থ হয়ে পরিস্থিতি অবলোকন করতে থাকা অন্য যাত্রীরা বললেন, না আমরা উনাকে চিনিনা।
ইতোমধ্যে পোশাক পরা আরো ৫/৬ জন পুলিশ বাসে উঠল। আমাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেয়া হলো। শহিদুল্লাহ উচ্চ স্বরে বাসের যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এটা একটা বিরাট সন্ত্রাসী। আমরা ডিবির লোক। আমাদের কাছে তথ্য আছে, ও বিশাল বড় বোমা নিয়ে এই বাসে উঠেছে বোমা মারার জন্য। তাই ওকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা এখন যেতে পারেন। আপনারা এখন নিরাপদ।”
উপর্যুপরি কিল-ঘুষির ফলে আমার কান ও মাথা দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। ঘাড়টা একটু বাঁকা করে বাসের যাত্রীদের দিকে একবার দুচোখ বুলিয়ে নিলাম। এই আশায় যে এটলিষ্ট যদি কেউ আমাকে চিনতে পারে। হয়তো আমার গুম হওয়ার খবরটি আমার সংগঠন কিংবা পরিবারের কাছে পৌঁছে দেবে। আমি কাউকে চিনতে পারিনি, কেউ আমাকে চিনল কিনা তাও বুঝতে পারিনি। সবার চোখে-মুখে যেন এক অজানা ভয় বিরাজ করছে। পিন-পতন নীরবতার মাঝেই অনেকটা জোর করে আমাকে বাস থেকে নামানো হলো। দেখলাম, বাসের গেইটের দুই পাশে দুইটি সাদা মাইক্রোবাস দাড়িয়ে আছে। আর অস্ত্র হাতে দাড়িয়ে আছে আরো ৮/১০ জন পুলিশ। আমাকে একটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে দু’পাশে দু’জন অস্ত্র ঠেকিয়ে ধরল। এডিসি শহিদুল্লাহ ড্রাইভারের পাশের সীটে বসার পরপরই মাইক্রোবাসটি চলতে শুরু করলো।
প্রথমে মাইক্রোবাসের গন্তব্য যাত্রাবাড়ীর দিকে থাকলেও পরে মিন্টু রোডের ডিবি অফিসের দিকে যাত্রা শুরু করে। এখানে অনেক কাহিনী আছে। তা অন্য কোন লেখায় শেয়ার করব, ইনশাআল্লাহ। ডিবি অফিসে যাবার পর একজন পুলিশ অফিসার আমাকে এডিসি শহিদুল্লাহ ও আশিকের পরিচয়টি আস্তে করে জানিয়ে দেন। তখন রাত প্রায় ১২.৩০। এডিসি আশিকের রুমে নেয়া হলো আমাকে। দরজায় একজনকে পিস্তল হাতে দাড় করিয়ে রাখা হয়। রাত প্রায় ৪ টা পর্যন্ত চলে একটানা জিজ্ঞাসাবাদ আর লাঠি পেটা চলতে থাকে। শহিদুল্লাহ মারতে মারতে ক্লান্ত হলে আশিক শুরু করেন। আবার আশিক ক্লান্ত হলে শহিদুল্লাহ শুরু করেন। রাত ৪ টার দিকে বিরতি দিয়ে তারা বাসায় চলে যান। আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় নিচতলার ডিবি হেফাজতে। এভাবে ২৫ তারিখ রাত পর্যন্ত প্রতিদিন দু’বার করে এডিসি শহিদুল্লাহর রুমে নিয়ে টর্চার ও জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। ২৫ জানুয়ারী রাতে ১০ টার দিকে আমাকে নেয়া হয় তৎকালীন ডিবির এডিসি মোল্লা নজরুলের রুমে। আমি তাকে আগেই চিনতাম। তাছাড়া দরজার বাইরে তার নাম লেখা দেখে নিশ্চিত হই। মোল্লা নজরুল তার চেয়ারের পেছন থেকে কালো কাপড় পেঁচানো বাঁকা একটি লাঠি নিয়ে আমাকে টর্চার করতে শুরু করেন। আঘাত সইতে না পেরে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তখন বুট দিয়ে একের পর এক আঘাত করতে থাকেন। টানা এক ঘন্টার অত্যাচারে আমার বাম হাতের শাহাদাত আঙ্গুলের গোড়ালি ভেঙ্গে যায়।
সেই ২৩ জানুয়ারি রাত থেকে ২৫ জানুয়ারী রাত পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে আমার ডিবি অফিসের গুম জীবন।
২৫ জানুয়ারী রাতে ১১ টার দিকে আমাকে তুলে দেয়া হয় মতিঝিল থানা পুলিশের এস আই মোকাররমের হাতে। তখন আমি বুঝতে পারি, আমি আর গুম নই। পরদিন ২৬ জানুয়ারী হয়ত আমাকে অনেকগুলো মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার আদালতে তুলা হবে। হলোও তাই। তারপর একে একে ৮ দিনের পুলিশ রিমান্ড পার করে ৭ মাস পর আদালত আমাকে জামিন দিতে রাজি হলে ২০১৩ সালের আগস্টের শেষের দিকে আমার মুক্তি মিলে আওয়ামী শোষণ ও নিপীড়নের কারাগার থেকে।