গায়েবি বা পাইকারি হারে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নামে মামলা সংবিধান বর্ণিত মৌলিক অধিকার পরিপন্থি

ব্যারিস্টার নাজির আহমদ : কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধীদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত আদালতের (Competent Court) মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়া (Due process) অনুসরণ করে শাস্তির ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইনের শাসন (Rule of law) ও ক্ষমতার পৃথকীকরণ (Separation of power) নীতি অনুযায়ী অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব। যদিও প্রসিকিউশনের জন্য উন্নত বিশ্বে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সংস্থা আছে (যেমন বৃটেনে আছে Director of Public Prosecutors – DPP) কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটি বা সেভাবে নেই। আর বিচার করে খালাস দেয়া বা শাস্তির ব্যবস্থা করা আদালতের দায়িত্ব। সুবিচার নিশ্চিত করতে হলে মামলা দায়ের বা রুজু, গ্রেপ্তার ও তদন্ত করতে হবে নিরপেক্ষভাবে ও বস্তুনিষ্ঠভাবে (objectively) সর্বোচ্চ পেশাগত মান বজায় রেখে। নতুবা বিচারের বানী নিভৃতে কাঁদবে, নিপীড়িত ও নির্যাযিত হবে নিরপরাধ সাধারণ মানুষ।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দিকে তাকালে মনে হয় যেন দেশে গায়েবি মামলা ও পাইকারি হারে হাজার হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নামে মামলার হিরিক পড়ে গেছে। এ সংস্কৃতি অনেক দিন ধরে চলে আসছে। তবে ইদানিং এর মাত্রা আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে। গায়েবি মামলা হলো এমন ঘটনা উপলক্ষ করে মামলায় জড়ানো যেখানে আদৌ তেমন কোনো ঘটনা বাস্তবে ঘটেনি। এটাকে অনেকটা কাল্পনিক বা বানানো (concocted) মামলা বলা হয়।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে নিবর্তন বা নিপীড়নের উদ্দেশ্যেই এ ধরনের মামলা করা হয় বা মামলায় জড়ানো হয়। এমনটি না হলে মধ্যস্থরের একজন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে ৪৫১টি মামলা হয় কী করে!

 

সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজে যেখানে আইনের শাসন বিদ্যমান সেখানে গায়েবি মামলার কথা চিন্তাই করা যায় না। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি আব্দুল মতিন সম্প্রতি এক ওয়েবিনারে গায়েবি মামলাকে গায়েবি জানাযার সাথে তুলনা করেছেন। এ ধরনের মামলা বেআইনি ও মৌলিক অধিকার পরিপন্থি। গায়েবি মামলা নামক মিথ্যা মামলা যারা দায়ের করেন তাদের বিরুদ্ধে বরং মামলা করার অনেক বিধান আছে Code of Criminal Procedure-এ (CrPC’তে)। কিন্তু এই বিধানের চর্চা বাংলাদেশে হয় না।

অপরদিকে বাংলাদেশে এক বিপজ্জনক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে যে কোনো ঘটনার পর কিছু লোকের নাম উল্লেখ করে মামলা দিয়ে এর সাথে অজ্ঞাত হাজার হাজার লোকদের ঐ মামলায় আসামি করা হয়। অথচ ঐ ব্যক্তিদের কোনো ধরনের পরিচয় নাই, করা হয়নি কোনো ধরনের শনাক্ত। এ কেমন আচরণ ও সংস্কৃতি? আশ্চর্য হচ্ছি এমন সংস্কৃতি বাংলাদেশের তাবৎ সুশীল সমাজ, বিবেকবান মানুষ ও আদালত নীরবে সহ্য করে যাচ্ছেন! মনে হয় যেন এটা দেশে অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে! আসামি নামক ব্যক্তিকে সঠিকভাবে শনাক্ত না করে তার নামে মামলা করা যায় কিভাবে? কোনো ব্যক্তিকে শনাক্ত করার ন্যূনতম প্রাথমিক দুটি উপাদান হচ্ছে তার নাম ও ঠিকানা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যক্তিদের শনাক্তই করতে পারলো না অথচ আসামি করে ফেললো হাজারে হাজার! এ যেন চিঠি “ছাড়া”র কথা পোস্ট বক্সে, কিন্তু পোস্ট বক্স শনাক্ত না করে “ছাড়া” হলো রাস্তায় বা পুকুরে! এমন চিঠি কোনোদিন কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছবে? ঠিক একইভাবে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নামে মামলা দিয়ে আর যাই হোক আইনের শাসন ও সুবিচারের অবজেকটিভ কোনোদিনই  অ্যাচিভ হবে না।

বৃটেনে গায়েবি মামলার কোনো অস্তিত্বই নেই। ৩৪ বছরের বিলেত জীবনে এবং ২৫ বছরের আইনপেশার জীবনে এমন মামলা রুজু বা মামলাতে জড়ানো দেখিনি। গায়েবি মামলা দায়ের হলে তাৎক্ষণিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে বা যারা এমন মামলা করেছেন তাদের সাসপেন্ড করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা নেয়া হতো। পাইকারি হারে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নামে মামলা রুজু করার রেওয়াজও বৃটেনে গড়ে উঠেনি। ২০১২ সালে লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায় ভয়াবহ দাঙ্গা (riots) হয়ে গেলো তাতে বহু দোকানপাঠ ভাঙচুর ও লুটপাট হলো। পুলিশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। একটি বুলেটও পুলিশের খরচ করতে হয়নি। ঠিক অনুরূপভাবে গত কয়েক বছর আগে পূর্ব লন্ডনে বিশেষ করে নিউহ্যাম বারায় এসিড নিক্ষেপের বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। পুলিশ দ্রুত প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করে। উভয় ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে আদালতের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করেছে পুলিশ। তবে কোনো পরিচয়হীন অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তারা কোনো মামলা দায়ের করেনি। বরং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের সঠিকভাবে শনাক্ত করেই কেবল তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে মুখে ফেনা তুলে এখন বলা হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ। এই আধুনিক ডিজিটাল বা স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করেই তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসামিদের সঠিকভাবে শনাক্ত করার পর কেবল তাদের নামে মামলা দেয়ার কথা, পাইকারিহারে পরিচয়বিহীন হাজার হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হবে কেন?

নাম নাই, ঠিকানা নাই, পরিচয় নাই – এমন হাজার হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিদের রিরুদ্ধে মামলা দেয়া মানে অগণিত নিরপরাধ নাগরিকদেরকে মামলার অহেতুক ঝুঁকি ও হয়রানিতে ফেলে দেয়া। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের ইচ্ছামতো কাউকে মামলায় ঢুকাতে পারবে অথবা মামলা থেকে বাদ দিতে পারবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তো ফেরেস্তা নয়। তাদের অনেকের অপেশাদারিত্ব, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও সাধারণ মানুষকে মিথ্যা মামলায় জড়ানোর খবর তো অহরহ আমরা গণমাধ্যমে দেখি। ইয়াবা পকেটে ঢুকিয়ে বা অস্ত্র হাতে ধরিয়ে মামলা জড়ানোও অজানা নয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যদের ব্যাপারে অনেক নেতিবাচক তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান এসেছে। এমতাবস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হাজার হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের এখতিয়ার বা স্বাধীনতা দেয়া কতটুকু যুক্তিসঙ্গত, আইনসম্মত ও সাংবিধানিক?

হাজার হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিদের রিরুদ্ধে মামলা দেয়ার এমন এখতিয়ারে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের সুনাম ও ব্যক্তি স্বাধীনতার হানি ঘটার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। অহরহ এমন দেখা যায়-ঘটনার সময় ওই জায়গায় ছিলেনই না অথবা যে দলের সমাবেশে ঘটনা ঘটেছে ঐ দলের সাথে তার কোনো সম্পৃক্ততাই নেই এমন ব্যক্তিদেরও “অজ্ঞাত ব্যক্তিদের” মোড়কে মামলায় জড়ানো হচ্ছে বা গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে! এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মান, সম্মান ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়। অথচ সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ পরিস্কার করে বলেছে “…..আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।” একইভাবে ৩২ অনুচ্ছেদ বলেছে “আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।”

সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত যথাক্রমে right to protection of law (আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার) এবং protection of right to life and personal liberty (জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ) হলো সংবিধানের তৃতীয়ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভূক্ত। এই অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। গায়েবি মামলা ও অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলার কোনো বিধান আইনে বা সংবিধানে নেই। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী CrPc বা পুলিশ আইনের মোড়কে এগুলো করার কথা হয়তো বলতে পারেন কিন্তু CrPc বা পুলিশ আইনে যেভাবে করা হচ্ছে এভাবে করার বিধান নেই। আর যদি থেকেও থাকে তবে CrPC’র বিধান বা পুলিশ আইন কোনোভাবেই সংবিধানের উপরে হতে পারে না। সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ পরিস্কার করে বলেছে “This Constitution is, as the solemn expression of the will of the people, the supreme law of the Republic, and if any other law is inconsistent with this Constitution that other law shall, to the extent of the inconsistency, be void” (অর্থাৎ “জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে”)। অপরদিকে মৌলিক অধিকারের উপর গুরুত্ব আরোপ করে সংবিধানের ২৬(১) অনুচ্ছেদ বলেছে “All existing law inconsistent with the provisions of this Part shall, to the extent of such inconsistency, become void on the commencement of this Constitution” (অর্থাৎ “এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসমঞ্জস সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে”)।

Universal Declaration of Human Rights (UDHR) এবং International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR) – এ দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য ও signatory বাংলাদেশ। তাই এ দুটি সংস্থা ও ডকুমেন্টের অনুচ্ছেদগুলো মানতে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক আইনে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। UDHR-এর Article 9 এবং ICCPR-এর Article 9 – এ প্রায় অভিন্ন ভাষায় কাউকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার, আটক বা নির্বাসনে পাঠাতে নিষেধ করা হয়েছে। UDHR-এর ৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “No one shall be subjected to arbitrary arrest, detention or exile.” (অর্থাৎ কাউকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার, আটক বা নির্বাসনের শিকার করা যাবে না)। অনুরুপভাবে ICCPR-এর ৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “Everyone has the right to liberty and security of person. No one shall be subjected to arbitrary arrest or detention” (অর্থাৎ প্রত্যেকেরই স্বাধীনতা ও ব্যক্তির নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। কাউকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার বা আটক করা যাবে না)। UDHR-এর ১২ অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে “No one shall be subjected to arbitrary interference with his privacy, family, home or correspondence, nor to attacks upon his honour and reputation. Everyone has the right to the protection of the law against such interference or attacks” (অর্থাৎ “কেউ তার গোপনীয়তা, পরিবার, বাড়ি বা চিঠিপত্রের সাথে স্বেচ্ছাচারী হস্তক্ষেপের শিকার হবে না বা তার সম্মান এবং খ্যাতির উপর আঘাত করা যাবে না। প্রত্যেকেরই এই ধরনের হস্তক্ষেপ বা আক্রমণের বিরুদ্ধে আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে”)।

আইন ও শাস্তির শ্বাশত বিধান হচ্ছে কোনোভাবেই কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে সাজা বা শাস্তি দেয়া যাবে না তাতে অনেক অপরাধী পার পেয়ে গেলেও। ঠিক এ কথাটা বৃটেনের অষ্টাদশ শতকের প্রতিথযশা আইনবিদ Sir William Blackstone ১৮৯২ সালে তাঁর “Commentaries on the Laws of England” বইতে বলে গেছেন এভাবে “The law holds that it is better that ten guilty persons escape, than that one innocent suffer” (অর্থাৎ “আইন বলে যে একজন নিরপরাধের ভোগান্তির চেয়ে দশজন দোষী ব্যক্তির পালানো ভালো”)।

প্রত্যেক অপরাধের বিচার হওয়া আবশ্যক। প্রকৃত অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাক-এটাই প্রত্যাশিত। তবে গায়েবি মামলা বা পাইকারি হারে হাজার হাজার পরিচয়হীন অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নামে মামলা করার অবাধ লাইসেন্স আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেয়া ঠিক নয়, কেননা এটা সংবিধান বর্ণিত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি ও আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ। বেশ কিছুদিন ধরে চালু হওয়া এই অপসংস্কৃতির লাগাম টেনে ধরা আশু প্রয়োজন সংবিধানে উল্লেখিত দেশের মালিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার স্বার্থে।

নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।

মানব জমিন