সোহরাব হাসান
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৫৮১ জন নিহত হয়েছেন। এর প্রতিটি হত্যার বিচার হওয়া জরুরি। কিন্তু মামলাতেই যদি গলদ থাকে, তাহলে বিচার হবে কী করে?
প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অনেক মামলার বাদীকে চেনেন না ভুক্তভোগীর পরিবার, অনেক মামলায় মৃত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো মামলায় ৫ আগস্ট ক্ষমতা পরিবর্তনের পর আসামির তালিকা সংশোধন করা হয়েছে। বিএনপি–জামায়াতের নেতাদের স্থলে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী–এমপিদের নাম এসেছে।
আন্দোলনের সময় যাত্রাবাড়ীতে একটি হত্যার ঘটনায় আসামিদের তালিকার ৪ নম্বরে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে মো. মাহবুব হোসেনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তখনো পর্যন্ত তিনি সাবেক হননি। যখন বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হলো বাদী মো. নাদিম ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে মো. মাহবুব হোসেনের নাম প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে বলেন, ‘ভুলবশত’ তাঁর নাম এসেছে।
মামলাটির তদন্ত চলমান থাকায় নাম প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। আদালত হত্যা মামলাটি আইনানুগভাবে তদন্ত করার নির্দেশ দেন। এর একদিন আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদেও রদবদল ঘটল। নতুন মন্ত্রিসচিব হলেন শেখ আবদুর রশীদ।
ওই মামলার এজাহারে বলা হয়, যাত্রাবাড়ী থানার রায়েরবাগে গত ১৯ জুলাই কামরাঙ্গীরচরের টেকেরহাট ইউনিট আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খোকনসহ অন্য নেতারা ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে সশস্ত্র হামলা করেন। ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে বুলেট ও গুলি ছোড়া হয়। একপর্যায়ে মেহেদী হাসান (১৮) নামের এক তরুণের থুঁতনিতে গুলি লাগে। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
ইউনিট আওয়ামী লীগের একজন নেতা যদি হামলায় নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন, তাহলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব তার আসামি হন কী করে?
৭ অক্টোবর ডেইলি স্টার–এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাকিব হাসান (২২) ও জাহাঙ্গীর আলম (৫০) নামের দুই ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে দুটি মামলা করা হয়। দুটি মামলার এজাহারে অবিকল একই কথা লেখা, শুধু নিহত ব্যক্তির নাম-ঠিকানা আলাদা। বাদী আবু বকর নিজেকে বিএনপির অঙ্গসংগঠন শ্রমিক দলের কর্মী হিসেবে দাবি করেছেন।
নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা বাদীকে চেনেন না। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে বলেন, ‘আমি আমার বাবার মৃত্যুর বিচার চাই এবং একই সঙ্গে যে ব্যক্তি আমাদেরকে না জানিয়ে এই মামলা করেছেন, তার শাস্তি হোক, এটাও চাই।’
সাকিব হাসানের বাবা মোর্তোজা আলমও জানান, ‘পুলিশ আমার ছেলেকে গুলি করেছে। কিন্তু মামলা হয়েছে রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে।’ অর্থাৎ তিনিও মনে করেন, মামলাটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
গাজীপুরের শ্রীপুর থানায় করা একটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয় মো. কালা মিয়া ওরফে কালাম মিয়াকে। ৫ অক্টোবর শ্রীপুর থানায় মামলাটি করা হয়। কালা মিয়া কাওরাইদ ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য ছিলেন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা যান কালা মিয়া। তাঁর মেয়ে শ্যামলী আক্তারের অভিযোগ, ‘আমার মরা বাবারে ক্যামনে আসামি করল তারা?’
ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে হামলার অভিযোগে গত ৩ অক্টোবর রাতে মো. এমরান হোসেন নামের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমন্বয়ক মামলা করেন। মামলায় তিনি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের সাবেক দুই চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাসহ ৯৬ জনের নাম উল্লেখ করেন।
মামলায় ২৭, ৩৩ ও ৫৫ নম্বর আসামি হিসেবে যে তিনজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম দেওয়া হয়েছে, তাঁরা মৃত। ২৭ নম্বর আসামি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কৃষিবিষয়ক সম্পাদক মো. কামাল উদ্দিন মজুমদার, ৩৩ নম্বর আসামি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক আবদুল মমিন এবং ৫৫ নম্বর আসামি উপজেলার পূর্ব জোড়কানন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ওয়াহিদুর রহমান ওরফে ফরিদ।
সদর দক্ষিণ উপজেলার গলিয়ারা দক্ষিণ ইউনিয়নের সাওড়াতলী গ্রামের বাসিন্দা মো. কামাল উদ্দিন মজুমদার ২০২৩ সালের ১১ জুলাই মারা যান। চলতি বছরের ২৪ জুন ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার শিকারপুর এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান আবদুল মমিন। আর ওয়াহিদুর রহমান গত বছরের সেপ্টেম্বরে কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
আওয়ামী লীগের আমলে ‘গায়েবি মামলা ও গায়েবি আসামির’ চল ছিল। বোমা হামলার ঘটনা না ঘটলেও হামলার কথা বলে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হতো। পুলিশ যথারীতি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদনও দাখিল করত। ওই সব মামলায় তাঁরা ইচ্ছেমতো নাম ঢুকিয়ে দিত।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে। মামলার ধারা বদলায়নি। এখনো গায়েবি মামলা না হলেও সেখানে এসেছে গায়েবি আসামি।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৬ আগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৯২ হাজার ৪৮৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যা বা অন্য কোনো অপরাধের অভিযোগে অন্তত ১ হাজার ৪৭৪টি মামলা করা হয়েছে। ৩৯০ জন সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উপদেষ্টা, মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে মোট ১ হাজার ১৭৪টি মামলা করা হয়েছে। বেশির ভাগই হত্যা মামলা।
সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবীর কাছে জানতে চেয়েছিললাম, সবার বিরুদ্ধে গয়রহ হত্যা মামলা কেন? তিনি বললেন, হত্যা মামলা করলে আটকাতে সুবিধা। জামিন মেলে না, রিমান্ডে নেওয়া যায়। কিন্তু যেসব মামলার তথ্যপ্রমাণই নেই, সেসব মামলা টিকবে কি? তিনি বললেন, মামলা টেকার জন্য তো করা হয়নি। করা হয়েছে নিজেদের তৎপরতা দেখাতে। তাঁর মতে, আদালত প্রাঙ্গনে আসামিদের হাজির করা নিয়ে যে সব অঘটন ঘটছে, সেটা কোনো সভ্য দেশে হতে পারে না।
আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট লেখা আছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’
এই প্রসঙ্গে আদালত প্রাঙ্গনে সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর মামলায় একশ্রেণির আইনজীবীর অপেশাদার আচরণের কথা উল্লেখ করা যায়। ওই মামলার বিচারক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, আইনজীবীর পোশাক পরে অআইনজীবীর মতো আচরণ করবেন না। প্রতিপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্যে বাধা দেওয়াও ফ্যাসিবাদী আচরণ।
স্বাধীনতার পর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘নকশাল কারও গায়ে লেখা থাকে না।’ ফ্যাসিবাদও কারও গায়ে লেখা থাকে না। আচরণের মাধ্যমেই মানুষ প্রমাণ করে সে গণতান্ত্রিক না ফ্যাসিবাদের সমর্থক।
আওয়ামী লীগ আমলে আদালত অঙ্গনে আসামির প্রতি ডিম ছোড়া ও জুতা ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। এর অর্থ এই নয় যে এখনো সেটি ঘটবে? তাহলে পরিবর্তন হলো কোথায়? কেউ অপরাধ করলে শাস্তি পাবেন। কিন্তু বিচারের আগে আপনি তাঁকে শাস্তি দিতে পারেন না।
সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিনই আওয়ামী লীগ আমলের মন্ত্রী–নেতাদের ভয়াবহ দুর্নীতি ও লুটপাটের খবর প্রকাশ পাচ্ছে। ক্ষমতায় থেকে যাঁরা দুর্নীতি করেছেন, যাঁরা জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করেছেন, যাঁরা বিদেশে অর্থ পাচার করে দেশকে ফোকলা বানিয়েছেন, তাঁদের বিচার হোক। যাঁরা মানুষ হত্যা করে ছাত্র–জনতার আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছেন, তাঁদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা হোক—এটা সময়ের দাবি।
কিন্তু তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে মামলা করলে ন্যায়বিচারের পথই কেবল রুদ্ধ হবে না, অপরাধীরাও পার পেয়ে যাবেন।
- সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি
- prothom alo