এ রকম অনেকে এখন বলছেন, হামাসের ‘আল-আকসা ফ্লাডে’র পর মধ্যপ্রাচ্য আর আগের মতো থাকবে না। দিনটি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি আমূল বদলে দেবে। সত্যতা আছে এ কথায়।
বাস্তবতা হলো ইসরায়েল নয়, মধ্যপ্রাচ্যকে বদলে দিচ্ছেন ইরানি সমরবিদেরা। গাজাযুদ্ধ সে রকম এক সমরবিদ হাসান তেহরানি মোগাহ্দ্দামের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
যেভাবে একটা মিথ ধ্বংস হলো
এটা প্রায় সবার জানা, বহুকাল ফিলিস্তিনি তরুণদের প্রতিরোধ অস্ত্র ছিল পাথর বা ইটের টুকরা। হাসান তেহরানির অবদান এটুকু, ওই তরুণদের হাতে ইটের টুকরার বদলে রকেট প্রযুক্তি ধরিয়ে দিয়েছেন।
‘আল-আকসা ফ্লাড’ অভিযানের প্রথম দুই সপ্তাহে হামাস প্রায় ৫ হাজার রকেট ছুড়েছে। অভিযানে দূরপাল্লার মিসাইলও ব্যবহার হচ্ছে। রকেট ও মিসাইল সামলাতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশ মজবুত। কিন্তু হামাসের সব মিসাইল ও রকেট তারা থামাতে পেরেছে এমন নয়। তাদের আহত-নিহত নাগরিকদের সংখ্যা জানাচ্ছে দেশটির মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ততটা সফল নয়—যতটা প্রচারিত।
যুদ্ধে এ পর্যন্ত ইসরায়েলের প্রায় দেড় হাজার মানুষ মারা গেছেন। সংখ্যাটা নিহত গাজাবাসীর তুলনায় অনেক কম। কিন্তু ওয়াশিংটন ও তেল আবিবের জন্য সংখ্যাটা বিব্রতকর।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এত দিন ধারণা দেওয়া হয়েছিল ইসরায়েলের আকাশ অজেয়। যুদ্ধে তারা কেবল মারতে শিখেছে। হামাস নয়, এই মিথ ধ্বংস করেছেন আসলে একজন শিল্প প্রকৌশলী। মোটর অপারেটর হিসেবে শুরু করেছিলেন দেশসেবা। এখন ইরানের ‘মিসাইল প্রযুক্তির জনক’ বলা হয় তাঁকে। জীবিতকালে হাসান তেহরানি একজন শৌখিন পর্বত আরোহীও ছিলেন। এই শৌখিনতার মাঝে তাঁর পেশাগত বৈশিষ্ট্যের প্রায় পুরোটা খুঁজে পাওয়া যায়।
৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের নাগরিকেরা বিশ্বাস করতে শিখেছেন আগের মতো আর তাঁরা নিরাপদ নন। ইরানের একজন প্রযুক্তিবিদ তাঁদের নিরাপত্তা ছিনতাই করে নিয়ে গেছেন। এমনকি ১৭ জন (অনানুষ্ঠানিক সূত্রে ৩৮ জন) সহযোগীসহ তাঁকে হত্যার পরও অবস্থার অবনতি থামানো যায়নি।
ইসরায়েলের নেতারা দশকের পর দশক আরব শাসকগোষ্ঠী ও আমেরিকার বন্ধুত্বের ওপর ভরসা করে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার অগ্রাহ্য করে গেছে। তারা ধারণা করতে পারেনি প্রযুক্তি জ্ঞান শিগগিরই তাদের কৌশলকে আত্মঘাতী প্রমাণ করতে চলেছে।
যখন গেরিলা দলগুলোর হাতে মিসাইল প্রযুক্তি
২০১১ সালের ১২ নভেম্বর তেহরানের কাছে এক রহস্যময় বিস্ফোরণে হাসান তেহরানি মারা যান। ইরানের ভেতরে-বাইরে প্রায় সবার অনুমান এই বিস্ফোরণের পেছনে অন্য দেশের হাত ছিল। তেহরানি নিজেও সেটা জানতেন হয়তো। তাই মৃত্যুর আগে বলে গিয়েছিলেন তাঁর কবরের ফলকে যেন লেখা থাকে: ‘রুয়ি কবরম বানোয়েসেয়েদ ইনজা মদফন কস আস্ত কে মি খোয়াস্ত ইসরাইল মারা নাবুদ কন্দ’ (এখানে এমন একজন শুয়ে আছেন, যিনি ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে চাইতেন)।
জীবন হারানোর ঝুঁকি নিয়ে প্রতিরোধ-চিন্তায় লেগে থাকার একটা সংস্কৃতি আছে শিয়া ঐতিহ্যে। বহির্বিশ্বের অনেকে ইরানি জনজীবনের এই দিকটা বুঝতে অক্ষম। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল মৈত্রীর বিপরীতে ইরান-হামাসের হুংকারকে অনেকের কাছে তীব্র এক অসম যুদ্ধ মনে হতো একদা। এখন আর সে রকম মনে হয় না। সমরপ্রযুক্তি সব বদলাচ্ছে। তারই কারিগর-নেতা ছিলেন হাসান তেহরানি।
তেহরানি বা ইরান কখনো ইসরায়েলে হামলা চালাননি। তাঁদের কৌশল ছিল ভিন্ন। তাঁরা দুটো কাজ করেছেন: মিসাইল প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং সেই জ্ঞান হামাস, ইসলামি জিহাদ, হিজবুল্লাহসহ কয়েকটি গেরিলা দলের সঙ্গে ভাগাভাগি করা ও তাদের প্রশিক্ষিত করা। কাজটি কী মাত্রায় হয়েছে, তার সামান্যই হামাস হয়তো প্রদর্শন করেছে। চলতি যুদ্ধে লেবাননের হিজবুল্লাহ জড়ালেই কেবল তেহরানির সবচেয়ে চৌকস শিক্ষার্থীদের কাজ-কারবার দেখা যাবে।
ইসরায়েল যে প্রতিদিন হুমকি দেওয়ার পরও গাজায় স্থল অভিযান শুরু করতে দেরি করেছে, তার বড় একটি কারণ তখন হিজবুল্লাহও তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। হিজবুল্লাহর হাতে হামাসের চেয়েও বহুগুণ বেশি এবং অপেক্ষাকৃত দূরপাল্লার মিসাইল রয়েছে। এই প্রযুক্তি-জ্ঞান হিজবুল্লাহ ‘টিম-তেহরানি’ থেকেই পেয়েছে।