- এলাহী নেওয়াজ খান
- ১২ নভেম্বর ২০২২, ১৯:৫৯
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ক্রিকেট তারকা ইমরান খানকে হত্যার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর দেশটির অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো জটিল ও উত্তেজনাকর হয়ে উঠেছে। যেন পরিণত হয়েছে বারুদের বাক্সে, যেকোনো সময় তা বিস্ফোরিত হতে পারে। বলা যায়, দেশটি এখন গভীর খাদের কিনারায় পৌঁছেছে।
ইমরান খান হত্যা প্রচেষ্টার আকস্মিকতায় পাকিস্তানের জনগণ বেদনায় বিমূঢ় হয়ে পড়লেও সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে শুরু হয় প্রতিবাদের ঝড়। হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে। কোনো কোনো স্থানে প্রতিবাদ সহিংসতায়ও রূপ নেয়। জনগণ সেনা প্রতীকেও হামলা করে, যা ছিল নজিরবিহীন। সাধারণভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সব সময় অকুণ্ঠ জনসমর্থন পেয়ে এসেছে। হঠাৎ যেন সে দৃশ্যপট বদলে গেছে। আর এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বর্তমান অস্থিরতা রক্তাক্ত সঙ্ঘাতে রূপ নিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
গত এপ্রিল মাসে পরিকল্পিত সরকার পরিবর্তনের ঘটনার পর বিগত আট মাস ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কোনো পক্ষই উদ্যেগ গ্রহণ করেনি। বরং ঘৃতে আগুন দেয়ার কাজটিই করে গেছে সবাই। সরকার পরিবর্তনের পর পরই আগাম নির্বাচনের দাবিতে ইমরান খানের কঠোর অবস্থান এবং তার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এ আভাস দিচ্ছিল যে, অবিলম্বে সংসদ বিলুপ্ত করে নির্বাচন না দিলে পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়বে; কিন্তু শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে পিডিএম জোট সরকার এবং তার সহযোগী শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো তা আমলে না নিয়ে ইমরান খানকে রাজনীতি থেকে চিরবিদায় করার অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কারণেই বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
আর সে প্রচেষ্টা কতটা বেপরোয়া ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ইমরান খানকে বারবার গ্রেফতার করার উদ্যোগ ও একের পর তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, গত অক্টোবরে পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতি যখন ২৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায় এবং ভয়াবহ বন্যায় দেশটিতে ৪০ বিলিয়ন ডলারের মতো ক্ষতি সাধিত হয়, ১৭ শ’ মানুষ প্রাণ হারায় এবং যখন ইমরান খান নিজে বন্যাদুর্গতের জন্য এক রাতে মাত্র দু’ঘণ্টায় পাঁচশ’ কোটির বেশি রুপি উত্তোলন করেন, তখন শাহবাজ সরকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পিটিআই নেতাদের গ্রেফতারসহ সবধরনের হয়রানি করতে থাকে, যা ছিল পাকিস্তানে চলে আসা প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার নোংরা রাজনীতির নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। এ ছাড়া সাম্প্রতিক উপনির্বাচনগুলোতে ইমরানের দলের কাছে পিডিএম প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয় ক্ষমতাসীনদের আরো বেপরোয়া করে তোলে।
অন্য দিকে গত সপ্তাহে পাকিস্তানের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’ প্রধান লে. জেনারেল নাভিদ আনজুম এক সংবাদ সম্মেলনে নজিরবিহীনভাবে অভিযোগ করে বলেন যে, ‘ইমরান খান সংবিধানপরিপন্থী পদক্ষেপ নিয়ে তার সরকারের প্রতি সমর্থন দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেনাবাহিনী সংবিধানবিরোধী ওই প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় ইমরান খান এখন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছেন।’ তার ওই অভিযোগ ধোপে টেকার মতো নয়। বরং জেনারেল আঞ্জুমের ওই মন্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে যে, পাকিস্তানের সংবিধান ও সেনা কর্তৃত্ব সমান্তরাল অবস্থানে বিরাজ করছে। কারণ সাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে কোনো গোয়েন্দা প্রধানের এ ধরনের বক্তব্য সংবিধানবিরোধী ছাড়া আর কী হতে পারে! ভারত কিংবা অন্য যেকোনো পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশে কোনো সেনাকর্মকর্তা এ ধরনের বক্তব্য দিলে সঙ্গে সঙ্গে তার চাকরি চলে যেত। এখানেই পাকিস্তানের বর্তমান সঙ্কটের কারণ নিহিত।
যতদূর জানা গেছে, পাকিস্তানে কোনো গোয়েন্দা প্রধানের সংবাদ সম্মেলন করে কোনো রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে এমন মন্তব্যের ঘটনা অতীতে আর কখনো ঘটেনি। আর এ থেকে এখন এটা আরো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে গত ৭৫ বছর ধরে সেনাবাহিনী কিভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শাসন করে আসছে। এমনকি ২০১৮ সালে ইমরান খানও সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। সেটি সত্য হলেও সৎ ও স্পষ্টভাষী ইমরান খানের সাথে সে সহযোগিতা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বিশেষ করে ইমরান খানের বিদেশী প্রভাবমুক্ত পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের চেষ্টা, আফগান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ভাড়া না খাটার অঙ্গীকার, পাকিস্তানের পশ্চিমা মদদপুষ্ট সামন্ত এলিটদের আতঙ্কিত করে তুলেছিল, যাদের রক্ষক হচ্ছে সেনাবাহিনী। তারই প্রতিফলন ঘটেছে পরিকল্পিত সরকার পরিবর্তনের ঘটনায় এবং সা¤প্রতিক জেনারেল আঞ্জুমের মন্তব্যের মধ্যে।
এটা সত্য যে, পাকিস্তানে কোনো নির্বাচিত সরকারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। আবার কোনো নির্বাচিত সরকারের সাথে কোনো সেনাপ্রধানও ভালো সম্পর্ক রাখতে পারেনি। যদিও অনেক ক্ষেত্রে এ জন্য রাজনীতিবিদরাও কম দায়ী নন। কারণ পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই রাজনৈতিক নেতাদের উচ্চাভিলাষ, ব্যাপক দুর্নীতি, অদক্ষতা, স্বজনপ্রীতি ও পরস্পরের মধ্যকার দ্ব›দ্ব-সঙ্ঘাত বারবার সেনা নেতৃত্বকে ক্ষমতা দখলে উসকে দিয়েছে। পাকিস্তানের রাজনীতিকরা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার চেয়ে পরিবারতন্ত্রকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।
বিশেষ করে ইমরান খানের দুর্নীতির অভিযোগে দিশেহারা হয়ে শরিফ ও জারদারি পরিবারের ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নেয়াও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য কম দায়ী নয়। যে নওয়াজ শরিফ রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর খবরদারি হ্রাস করতে গিয়ে বারবার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন, সেই নওয়াজ শরিফ এবং তার ভাই শাহবাজ শরিফ ও তাদের পরিবারবর্গ কেবল দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বাঁচতে তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্ব›দ্বী ও চরম দুর্নীতিগ্রস্ত জারদারি পরিবারকে সাথে নিয়ে হাত মিলিয়েছে সেনাবাহিনীর সঙ্গে। এরা সবাই একত্রিত হয়ে ইমরান খানকে হটিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এবার সেনাবাহিনী নয়, রাজনীতিবিদরাই নির্বাচিত সরকারকে হটিয়েছে। আর এ জন্য তারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করে। তারা রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে বলেই আজ এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
পিডিএম নেতারা যদি সত্যই রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রকে প্রাধান্য দিতেন, তাহলে ক্ষমতাসীন হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই নির্বাচনের দিকে চলে যেতেন; কিন্তু তারা সে পথে না হেঁটে মেয়াদ পূরণের দৃঢ়তা প্রদর্শন করে আসছেন। তারা দেখাতে চেয়েছে যে, তারা পিটিআই সরকারের চেয়ে বেশি যোগ্য।
যদিও পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই সে দেশটির রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা, সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ১৯৫১ সালে এক জনসভায় ভাষণদানকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৯৭৯ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের শিকার হতে হয়। আবার ২০০৭ সালে এক জনসমাবেশে বক্তৃতার সময় গুলি ও বোমা হামলা চালিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কন্যা, পিপিপি প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে হত্যা করা হয়। ইমরান খানের হত্যাচেষ্টার ঘটনাও দেশটির অস্থিতিশীল রাজনীতিরই পরিচয়ই বহন করে, যা পাকিস্তানকে কখনোই অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে দেয়নি।
এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, অতীতের ওই সব হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় আজো পর্যন্ত জনসম্মুখে আসেনি। লিয়াকত আলীর হত্যাকারীকে সাথে সাথে হত্যা করা হয়। ফলে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা জড়িত ছিল তা আজো অনুদঘাটিতই রয়ে গেছে। তবে ইমরান খানের হত্যা প্রচেষ্টাকারী গ্রেফতার হয়েছে। এ ছাড়া অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের বিখ্যাত সাংবাদিক আরশাদ শরিফকে কেনিয়ায় হত্যার ঘটনা, ইমরান খানকে হত্যার চেষ্টা এবং ইমরান খানকে হত্যার হুমকি দেয়ায় নওয়াজ মুসলিম লীগের একজন নেতার গ্রেফতারের ঘটনা এবং অতঃপর জেনারেল আঞ্জুমের বক্তব্য একই সুতায় গাঁথা বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, সাংবাদিক আরশাদ শরিফ হরহামেশাই সেনাবাহিনীর সমালোচনা করতেন। আর এ কারণে তার প্রাণনাশের হুমকি প্রবল হলে তিনি পালিয়ে কেনিয়ায় চলে যান। কিন্তু দূরদেশে আশ্রয় নিয়েও তিনি রক্ষা পেলেন না। একইভাবে ইমরান খানও সেনাবাহিনীকে জবাবদিহির আওতায় আনতে চান, যেমনটা ঘটেছে তুরস্কে। বর্তমানে সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে ইমরান খানকে চিরতরে সরিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনীর বশংবদ একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতায় না গিয়ে তাদের বসানো একটি পুতুল সরকার দিয়ে দেশ চালাতে চায়।
কিন্তু ইমরান খানের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ও জনগণের আকাক্সক্ষার বিপরীতে এ ধরনের অভিসন্ধি কার্যকর করা কতটা সম্ভব হবে তা এখন দেখার বিষয়। কারণ এখনই নির্বাচন দিলে ইমরান খানের দল দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করবে। তাই পরিকল্পনাবিদরা ইমরান খানকে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনে ঠেলে দিয়ে তাকে ক্লান্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইমরানের ওপর হামলার পর, যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে সব পরিকল্পনা উল্টে গেছে। এখন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে পাকিস্তান। নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। আর এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে দেশটি কার্যত গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে। এর থেকে দ্রুত পরিত্রাণ পেতে সেনাবাহিনী যদি অভ্যুত্থান ঘটিয়েও বসে, তাহলে সেটিও হবে আরো বিপর্যয়কর। কারণ সেটি করতে গেলে সেনাবাহিনীকে নিজ জনগণের ওপর গুলি চালাতে হবে। তবে জেনারেল আঞ্জুমদের মতো কিছু জেনারেল চাইলেও আর্মির সাধারণ পদস্থ সৈনিকরা তা করবে কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। কারণ পাকিস্তানের প্রতিটি ঘরই সৈনিকের ঘর। পাকিস্তানের এমন কোনো পরিবার নেই, যে পরিবারে একজন সৈনিক নেই। তারা তাদের নিজের ভাইয়ের দিকে গুলি চালাবে বলে মনে হয় না।
এখন এ রকম এক নাজুক পরিস্থিতি থেকে আপাতত উত্তরণ পেতে পাকিস্তানের নেতাদের সামনে একটিই পথ খোলা আছে, তা হচ্ছে, অবিলম্বে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা। সে জন্য দরকার জাতীয় সংলাপ। সম্ভবত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি গত ৬ নভেম্বর ইমরান খানকে দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সঙ্কট উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রের ‘স্টেক হোল্ডারদের’ নিয়ে যে সংলাপের কথা বলেছেন, তাতে সে ঈঙ্গিত বহন করছে।
সংলাপ না হলে পাকিস্তান চরম সঙ্কটে পড়বে। ইসলামী উগ্রবাদীরা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। বেলুচিস্তানে ননস্টেট সশস্ত্র হামলা আরো বাড়বে। আফগান সীমান্তে সৃষ্টি হবে অস্থিতিশীলতা। আজাদ কাশ্মিরে ভারত প্রলুব্ধ হবে আরো বেপরোয়া অবস্থান নিতে। তাই বলা যায়, পাকিস্তান এখন গভীর খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে।