গতানুগতিক বাজেট, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই

  • মো: মাঈন উদ্দীন
  •  ২৬ জুন ২০২২, ২০:০০

গতানুগতিক বাজেট, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই – প্রতীকী ছবি

অর্থনীতিতে বাজেটের লক্ষ্য অনেক ব্যাপক; শুধু আয়-ব্যয় সংক্রান্ত রাজস্বনীতি দ্বারা সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ সাথে রয়েছে কর্মসংস্থান ব্যবস্থা, দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, মুদ্রানীতি, জাতীয় উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ও আয় নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলো।

গতানুগতিকভাবে গত ৯ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট পেশ করেছেন।

করোনা মহামারীর ক্ষতি থেকে অর্থনীতি যখনই উত্তরণের দিকে যাচ্ছে তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ আন্তর্জাতিক সরবরাহব্যবস্থার সঙ্কট ও মূল্যস্থিতির নিয়ন্ত্রণহীনতা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেটে আয় ধরা হয়েছে চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ও ঘাটতি দেখানো হয়েছে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫.৬ শতাংশ।

বাজেট ঘোষণার আগে ও পরে সংবাদমাধ্যম, গণমাধ্যম, অর্থনীতিবিদ, গবেষক, ও বিশ্লেষকগণ বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া, পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এসব প্রতিক্রিয়ার মাঝে বাজেটের ভালো-মন্দ বিষয়গুলো, চ্যালেঞ্জের বিষয়, সমস্যা ও সম্ভাবনার দিক উঠে আসে।

অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তব্যে সমস্যাগুলো উল্লেখ করেছেন ঠিকই কিন্তু তা সমাধানের কৌশল, সমন্বিত পদক্ষেপ তেমন একটা চোখে পড়েনি। বিশেষত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে জোরালো পদক্ষেপ নেই।
সাধারণত জনগণ, গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি চায় সাধ্যের মধ্যে পণ্যদ্রব্য ক্রয় করা স্বাভাবিক জীবন পরিচালনা ও আয় অনুসারে ব্যয় করতে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই বাজেটের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটটি বাংলাদেশের ৫১তম ও অর্থমন্ত্রীর চতুর্থ বাজেট। মন্ত্রী তার বক্তব্যে আগামী অর্থবছরের ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেন।

এগুলো হলো- মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানো, বিদেশী সহায়তা বাড়িয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা। মূল্য সংযোজন করের পরিমাণ ও ব্যক্তিকরদাতার সংখ্যা বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল রাখা। অর্থমন্ত্রী সমস্যাগুলো চিহ্নিত করলেও তার সমাধানের যথাযথ ব্যবস্থাপত্র দিতে পারেন নাই। চলমান অর্থবছরে (২০২১-২২) বাজেটের পরিমাণ ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা যদিও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে পাঁচ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ কোটিতে দাঁড়ায়। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ধরা হয়েছিল ৭.২ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.৫০ শতাংশ।

বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যার বেশির ভাগ জোগান দেয়া হবে দেশীয় ব্যাংক থেকে যা এক লাখ ছয় হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। বিশেষ বিদেশী ঋণ ৯৫ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা, ব্যাংক বহির্ভূত ঋণ ৪০ হাজার এক কোটি টাকা এবং বিদেশী অনুদান দ্বারা হয়েছে তিন হাজার ২৭১ কোটি টাকা। এতে সরকারের অভ্যন্তরীণ ব্যাংকনির্ভরতা বেসরকারি খাতকে ভোগাবে। বেসরকারি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ৮২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। ভর্তুকির মধ্য থেকে যেসব খাতে অর্থ দেয়া হবে সেসব খাত থেকে আয় আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিশ্ব-অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতিতে আমদানি কমাতে হবে, বিনিয়োগও তেমন বাড়বে না, ঘাটতির পরিমাণও বড়, তার মধ্যে ঋণ পরিশোধ; কিভাবে জিডিপি সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে তা বোধগম্য নয়।

বাজেটে করপোরেট কর তৃতীয়বারের মতো কমছে ২.৫ শতাংশ, সোনা আমদানি পর্যায়ে উৎসকর ৫ শতাংশের পরিবর্তে শূন্য শতাংশ করা হয়েছে। রয়েছে স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের জন্য সুখবর। স্টার্টআপ উদ্যোক্তার টার্নওভার কর হার ০.৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি স্টার্টআপ কোম্পানির আয়কর রিটার্ন দাখিল বাদে বাকি সব রিপোর্ট থেকে অব্যাহতি এবং ৯ বছর পর্যন্ত লোকসান সমন্বয় করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাঁচ কোটি টাকার বেশি জমার ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে ধনীদের ওপর অতিরিক্ত করারোপ করা হলো। নীতিগত দিক থেকে এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলেও ব্যাংকে সঞ্চয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যে ভর্তুকি বৃদ্ধি করা প্রশংসনীয় উদ্যোগ তবে কৃষি বিপণনের সমস্যা দূর করতে উদ্যোগ নিতে হবে।
বাজেটের আরো কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে।

যেমন- কিছু খাতে ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে, পোলট্রি ও লাইভস্টকের ওপর ট্যাক্স কমিয়ে দেয়া হয়েছে। দেশীয় শিল্পকে সংরক্ষণের জন্য যে নীতি রয়েছে তার জোরদার করার কথা বলা হয়েছে। তবে ক্ষুদ্র মাঝারি খাতের দিকে বেশি নজরদারি করা উচিত। আমাদের অনানুষ্ঠানিক খাতে জনসংখ্যার বড় একটি অংশ রয়েছে। তাদের আয়ের উৎসটি নিশ্চিত করা উচিত। মানুষের আয় বাড়লে বিদ্যমান কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সহজ হবে। বাজেটের সম্পদের বৈষম্য, আয়বৈষম্যকে কিভাবে সমন্বয় করা যায় সেদিকে তেমন নির্দেশনা নেই। ব্যাংকিং সেক্টরকে ঢেলে সাজানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল। সুদের হারকে বাজার ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার জন্য শুধু রাজস্বনীতি নয়, মনিটারি পলিসিও দেখা উচিত।

সরকারের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৬.৩ শতাংশ সেখান থেকে ৫.৬ শতাংশের লক্ষ্য কিভাবে অর্জন হবে তার কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা বাজেটে পাওয়া যায়নি। ব্যয়প্রবাহ ও সঙ্কোচনের সুযোগও কম।

বাজেটের আর একটি বিষয় যা বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হলো- পাচার হওয়া অর্থ দেশে আনার ক্ষেত্রে সরকারের নীতি নিয়ে। পাচার হওয়া অর্থ দেশে এনে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করলে কেউ প্রশ্ন করবে না। এই সুযোগ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিকতার দিক থেকেও অগ্রহণযোগ্য এতে যারা সৎভাবে ব্যবসা করেন তারা কর দিতে নিরুৎসাহিত হবেন। এতে দেশের টাকা বাইরে যাওয়ার প্রবণতা আরো তৈরি হতে পারে। বরং সরকার পাচারকারীদের বিচারের আওতায় এনে অর্থপাচার রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে। যারা দেশের টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করে তারা কোনো দিনও দেশপ্রেমিক হতে পারে না। দেশে অর্থ ফেরতে যত সুযোগ দেয়া হোক না কেন তাতে মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গল বেশি হতে পারে। অর্থপাচার কিভাবে হচ্ছে এর উৎস অনুসন্ধান করতে হবে। অর্থপাচারের পথ বন্ধ করতে হবে । বিকল্প পন্থায় পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি পাচারকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এবারের বাজেটটিও গতানুগতিক। চ্যালেঞ্জগুলো অর্থমন্ত্রী চিহ্নিত করলেও অভ্যন্তরীণ ও বৈশি^ক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

যেসব উন্নয়ন প্রকল্প চলমান ও সম্পন্ন হওয়ার কাছাকাছি রয়েছে তাতে প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড়িয়ে সময়মতো সম্পন্ন করা উচিত। প্রকল্প সময়মতো সম্পন্ন না হলে ব্যয় বেড়ে যায়। এ ধরনের পুরোনো রীতি রোধ করতে হবে। সরকার ব্যাংকঋণ বেশি মাত্রায় নিলে তা ব্যক্তি-ঋণের ওপর প্রভাব ফেলবে। দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের কল্যাণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি যাতে যথাযথভাবে সঠিক ক্ষেত্রে পৌঁছানো যায় সে ব্যবস্থা করা উচিত। এই খাতে এবারো বরাদ্দ বেড়েছে কিন্তু তা বর্তমান প্রেক্ষাপটের তুলনায় অপ্রতুল; দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ভাঙার জন্য সহায়ক নয়।

অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, দেশে মধ্যবিত্ত বা তদূর্ধ্ব শ্রেণীর জনসংখ্যা প্রায় চার কোটির মতো। তারা বেশির ভাগ আয়কর দেন না। ফলে কর ফাঁকি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা উচিত। গত এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত টিআইএন-ধারীর সংখ্যা ৭৫ লাখ ১০ হাজার মার্চ; ২২ পর্যন্ত কর দিয়েছে ২৯ লাখ। কর দেয়া ও রিটার্ন দাখিল সহজ করা উচিত। মানুষের মধ্যে কর দেয়ার ভীতি দূর করতে হবে। করের আওতা বাড়াতে হবে।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। গত মার্চ পর্যন্ত আদায় হয়েছে দুই লাখ ৭০ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। জুন পর্যন্ত আদায় করতে হবে এক লাখ ১৮ কোটি ৩৬১ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত কত আদায় হয় তা দেখার বিষয়। নতুন অর্থবছরে চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বিশাল এক রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের ওপর করের চাপ বাড়বে। বাজেটের প্রস্তাবাগুলো আরো কয়েক দিন ধরে আলোচনা-পর্যালোচনা হবে। তাতে আশা করা যায়, সঠিক ও বাস্তবসম্মত রূপরেখা বেরিয়ে আসবে।

প্রস্তাবিত বাজেটে গরিব মানুষের খাবার জোগান দেয়া, মধ্যবিত্তদের আয় বর্ধন, চাকরির সুযোগ, বেকার ও কর্মহীনদের কর্মের ব্যবস্থা করা, দুস্থ ও দুর্বল মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার আওতার বরাদ্দ আরো বাড়িয়ে তার যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সবার প্রত্যাশা। রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে তা কতটা সম্ভব হবে তা নির্ভর করবে বিনিয়োগের ওপর। বিনিয়োগ না বাড়লে রাজস্ব আদায় বাড়বে না। আয়কর, ভ্যাট, কিংবা আমদানি-রফতানি যা-ই বলি না কেন, সব কিছুর সাথে বিনিয়োগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই বিনিয়োগ বাড়ানো এবং ব্যাংক সুদহার বাজারব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার
ইমেইল : [email protected]