গণ-অভ্যুত্থানকে সংবিধান থেকে বৈধতা আদায় করতে হয় না

গণ-অভ্যুত্থানকে সংবিধান থেকে বৈধতা আদায় করতে হয় না

সারোয়ার তুষার

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের, বিশেষত ঢাকার, বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম একটা প্রধান পরিবর্তন হচ্ছে সংবিধানকেন্দ্রিক আলাপ-আলোচনা।

প্রাক্‌-অভ্যুত্থান পর্বে সংবিধানকেন্দ্রিক আলোচনা একেবারে যে ছিল না, তা নয়। কিছু কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক গোষ্ঠী বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে সংবিধান ও রাষ্ট্র প্রশ্নে তাৎপর্যপূর্ণ পর্যালোচনা জারি রেখেছিল।

তবে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সংবিধান বিতর্কের গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক রয়েছে। প্রাক্‌-অভ্যুত্থান পর্বে সংবিধানকেন্দ্রিক পর্যালোচনা স্রেফ বুদ্ধিবৃত্তিক ও তাত্ত্বিক চর্চা আকারে ছিল। অন্যদিকে অভ্যুত্থান-পরবর্তী এ ধরনের আলোচনা বাস্তব রাজনীতিকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র ধারণা

সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার অর্থ করা হয় যেকোনো মূল্যে পুরোনো রাষ্ট্র, আইন ও বিধিবিধানের ধারাবাহিকতা। অর্থাৎ এমনকি গণবিদ্রোহ ও অভ্যুত্থানের পরেও একই ধরনের ক্ষমতাকাঠামো—যার বিরুদ্ধে জনবিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে—বহাল থাকতে হবে, এ–ই হচ্ছে যুক্তি। এ ক্ষেত্রে ‘সাংবিধানিক শূন্যতা’র দোহাই দেওয়া হয়। অভ্যুত্থান বা বিদ্রোহের পর পুরোনো সংবিধান বাতিল করে দিলে সাংবিধানিক শূন্যতার দরুন সমাজ-রাষ্ট্রে অস্থিরতা ও অরাজকতা তৈরি হবে—এমন ভয় দেখানো হয়।

বলা বাহুল্য, এ আশঙ্কা অমূলক এবং এই যুক্তি ঔপনিবেশিক। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত জনগণ কখনো পুরোপুরি ইচ্ছা ও অভিপ্রায়হীন হয় না, ফলে সাংবিধানিক শূন্যতার প্রশ্নও অবান্তর। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় লিখিত কি অলিখিত, তা ভিন্ন আলাপের বিষয়।

গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পুরোনো সংবিধান বাতিল বা অকার্যকর হওয়ার পর নতুন সংবিধান প্রণয়নের আগপর্যন্ত বিদ্যমান আইন ও প্রশাসনিক বিধিবিধান দ্বারা দৈনন্দিন রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড চলতে পারে। তেমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আইনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায়।

উপনিবেশিত জনগণ নিজেরা নিজেদের পরিচালনা করতে সক্ষম নয়, তারা নিজেদের জন্য আইন ও সংবিধান প্রণয়ন করতে পারবে না; কাজেই ‘মহৎ’ সভ্যতা রক্ষার উদ্দেশ্যে তাদের শাসন করতে হবে—ঔপনিবেশিক শাসনের যুক্তি এ রকমই ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাক্ষাৎ উপনিবেশ উঠে গেলেও দেশীয় শাসকশ্রেণির এই ঔপনিবেশিক মনোভাব এখনো রয়ে গেছে। এখনো মনে করা হয়, জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণে সংবিধান প্রণয়ন করার উদ্যোগ নিলে তা অরাজকতায় রূপ নেবে।

খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে, শাসকশ্রেণির বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে ক্ষমতার ভাগ–বাঁটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা থাকলেও জনগণকে ক্ষমতাহীন করে রাখার ব্যাপারে এক বিরল ঐকমত্য রয়েছে। যেকোনো মূল্যে তারা ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখতে বদ্ধপরিকর। আলংকারিকভাবে ‘জনগণ’ শব্দটি ব্যবহার করলেও শ্রেণিগত ও দলীয় ক্ষমতা কায়েম করার দিকেই শাসকশ্রেণির পূর্ণ মনোযোগ। গণক্ষমতা নয়, দলীয় ক্ষমতা কায়েম করতেই তারা উদ্‌গ্রীব।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মাফিয়া শাসকগোষ্ঠীর আপাতপরাজয় ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু পুরোনো ক্ষমতার মাধ্যমে জনগণকে শাসন করার অভিলাষ ধারণ করা শাসকশ্রেণি ও তাদের উপযোগী ক্ষমতাকাঠামো বহাল তবিয়তে আছে। ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ তাদের ঢালমাত্র। তাদেরই একাংশ গণ-অভ্যুত্থানের আগের রাতে (৪ আগস্ট) সাংবিধানিকভাবে শেখ হাসিনার পদত্যাগের ফর্মুলা হাজির করেছিল। বাংলাদেশের জনগণ যখন শেখ হাসিনার পতন ঘটানোর লক্ষ্যে নিজেদের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিল, তখন পুরোনো ক্ষমতার তল্পিবাহকেরা ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র ফর্মুলা পেশ করেছিল। এ কথা বাংলাদেশের জনগণ কখনো ভুলতে পারবে না।

কিন্তু এই ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ আসলে কী জিনিস? শাসকশ্রেণি কর্তৃক প্রচারিত সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা মূলত জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ছেদের ধারাবাহিকতা। উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি এমন হয়, যেখানে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করার সাংবিধানিক পথ রুদ্ধ করা হয়েছে, তখন লিখিত সংবিধান খোদ অসাংবিধানিকতায় রূপ নেয়। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় তথা গণসার্বভৌমত্বের জোরেই ফ্যাসিবাদী রেজিম ও সংবিধানকে উৎখাত করা তখন কেবল ন্যায়সংগতই নয়; আইনসংগতও বটে।

২০১১ সালে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এর ফলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণ–অভিপ্রায় যাচাইয়ের সাংবিধানিক যাত্রায় ছেদ ঘটেছিল।

স্বীকার করা প্রয়োজন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সমস্যার সমাধান নয়; খোদ সমস্যার অংশ। শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন থাকলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হয় না। অথচ তেমন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের ধ্রুপদি পথ অনুসরণ করার প্রতি রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক ভালো রেফারির মধ্যস্থতায় দুই মন্দের মধ্যে এক মন্দকে বেছে নেওয়ার ফরমাশ করা বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির গুরুতর এক ব্যাধি।
তবু এই ব্যবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের ফসল ছিল। জনগণের তাতে সম্মতিও ছিল। সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আদালতকে ব্যবহার করে এই ব্যবস্থা বাতিলের ক্ষতিকর নজির সৃষ্টি করেছিল আওয়ামী লীগ। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে ২০০৮ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। সরকার গঠন করার পর জনগণকে অন্ধকারে রেখে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছিল আওয়ামী লীগ।

সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার তর্কে ফেরা যাক। শাসকশ্রেণির তরফে এ যদি হয় পুরোনো রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক ক্ষমতাকাঠামো বহাল রাখার রাজনীতি, জনগণের তরফে এর ব্যাখ্যা কী হবে? আগে আমরা উল্লেখ করেছি, শাসকশ্রেণির প্রচারিত সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা মূলত জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ছেদের ধারাবাহিকতা মাত্র। লম্বা সময়ের জন্য (বাংলাদেশের জন্য অন্তত এক দশক, ২০১৪ সাল থেকে) জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় বাধাগ্রস্ত হওয়ার ইতিহাস থাকার পর সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার ধুয়া তোলা অসাংবিধানিকতারই নামান্তর।

জনগণের দিক থেকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার অর্থ হতে পারে কেবল ও কেবলমাত্র জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ধারাবাহিকতা। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটার মানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটা। এমনকি তা যদি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে হয়ে থাকে, তবু। অর্থাৎ বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক বাস্তবতায় শাসকশ্রেণির সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার ধারণা জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ধারাবাহিকতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে যাচ্ছে। এর আরেক অর্থ এ–ই, শাসকশ্রেণির সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার রাজনীতি খোদ অসাংবিধানিক তথা গণ–অভিপ্রায়পরিপন্থী।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে এ আলোকেই বোঝা দরকার। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনটি জালিয়াতির নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গণরায় ব্যক্ত করার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। তারপরও জনগণের অবিচ্ছেদ্য অধিকার—যেমন জীবনধারণের অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি—হরণ করার মাধ্যমেও জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ে ছেদ ঘটানো হয়েছে। এ অবস্থায় গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণ সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা তথা জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ধারাবাহিকতা ব্যক্ত করার প্রক্রিয়ায় ফেরার চেষ্টা করেছে মাত্র।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ কথাটা নতুন নয়। এই পশ্চাৎপদ ও গণবিরোধী ধারণার কারণেই সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের কাছ থেকে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। রাজনীতিতে পতিত স্বৈরাচার এরশাদের পুনর্বাসন ঘটেছিল।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এরশাদ রাজনীতিতে বহাল তবিয়তে ছিলেন। গণ-অভ্যুত্থানকে পুরোনো গণবিরোধী সাংবিধানিক ক্ষমতার খোপে পুরে দেওয়ার মতো নেতিবাচক নজির সৃষ্টি হয়েছিল। চব্বিশের অভ্যুত্থানের পরেও একই চক্রের পুনরাবৃত্তির চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে জনগণের পক্ষের শক্তিগুলোর সতর্কতা প্রয়োজন।

গণ-অভ্যুত্থান নিজেই নিজের বৈধতা জাহির করতে সক্ষম। এ কথার আরেক অর্থ এ–ই, গণ-অভ্যুত্থানকে সংবিধানের ভেতর থেকে বৈধতা আদায় করতে হয় না; বরং গণ-অভ্যুত্থান খোদ নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থার বৈধতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এ কারণে দর্শন ও আইনশাস্ত্রে গণ-অভ্যুত্থানকে নতুন গাঠনিক মুহূর্ত (কনস্টিটুয়েন্ট মোমেন্ট) হিসেবে অভিহিত করা হয়, যার ওপর ভর করে জনগণ গাঠনিক ক্ষমতা, তথা আইনপ্রদায়কের মর্যাদা অর্জন করে।

তবু ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র পশ্চাৎপদ মতবাদের শক্তিশালী উপস্থিতি আমাদের সমাজের শিক্ষিত সমাজের একাংশের মধ্যে রয়েছে—এ কথা স্বীকার করতে হয়। জনগণের দিক থেকে এ বাহাসে অংশ নেওয়ার সময় কিছুটা উল্টো পথে হাঁটার বিকল্প নেই। ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ কথাটার যদি কোনো অর্থ থাকে, তা হচ্ছে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ধারাবাহিকতা। কাজেই জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ে ছেদ ঘটায়—এমন সংবিধান ও ক্ষমতার ব্যবস্থাপনাকে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র নামে টিকিয়ে রাখার দুরভিসন্ধি খোদ অসাংবিধানিক; গণ-অভ্যুত্থানই সাংবিধানিক।

গণ-অভ্যুত্থান ও গণতন্ত্র

গণ-অভ্যুত্থান জনগণের গণতান্ত্রিক অভিপ্রায়ের সর্বোচ্চ প্রকাশ। গণসার্বভৌমত্ব কোনো বিদ্যমান সংবিধান বা আইনের অধীন নয়; বরং গণসার্বভৌমত্বই নতুন আইনি ব্যবস্থার ধাত্রী। গণ-অভ্যুত্থান ঔপনিবেশিক আইনকানুনসহ যাবতীয় গণবিরোধী বিধিবিধানকে পরাভূত করে গণ–অভিপ্রায় অনুসারে নতুন সংবিধান প্রণয়নের শর্ত তৈরি করে। গণ-অভ্যুত্থানকে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র খোপে পোরার পেছনে পুরোনো ক্ষমতা বহাল রাখার অভিলাষ ক্রিয়াশীল থাকে।

তাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দুটি ধারা সক্রিয় থাকে। এক, নতুন আইনি ব্যবস্থা প্রণয়নের ধারা; দুই, পুরোনো ব্যবস্থার কাছে গণ-অভ্যুত্থানকে সমর্পণ করার ধারা। কোনটি বিজয়ী হবে, তা রাজনৈতিক তৎপরতা ও শক্তি সমাবেশের ওপর নির্ভর করে।

এবারও সংবিধানের মধ্য থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের ফর্মুলা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা লক্ষণীয়। নব্বইয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা হবে গণ-অভ্যুত্থানবিরোধী তৎপরতা। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতিত সামরিক স্বৈরাচার এরশাদকে সাংবিধানিকভাবে অপসারণ করার পরিণতি ছাত্র-জনতার কাছে স্পষ্ট। যার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন, তার কাছ থেকে ক্ষমতা অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করার মতো তামাশা আর কিছু হতে পারে না।

ভুলে গেলে চলবে না যে ‘সাংবিধানিক ক্ষমতা হস্তান্তর’-এর নাম করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার গর্ভেই এক-এগারোর সুশীল-সামরিক সরকার বাংলাদেশে এসেছিল। বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রেজিম তথাকথিত নির্বাচনের নামে এক-এগারোর ফাঁক গলে ক্ষমতাসীন হয়েছিল। ক্ষমতাসীন হয়ে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা ‘অনির্বাচিত’—এই ধুয়া তুলে তা বাতিলও করে দিয়েছিল। এই পুরো প্রক্রিয়া যাদের ফর্মুলায় ঘটেছে, দায় তাদেরও। এখন আবার একই উদ্দেশ্যে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ও ক্ষমতা হস্তান্তরের’ তত্ত্ব প্রচার করা হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন তোলা অমূলক হবে না।

স্রেফ রেজিম চেঞ্জ করে পুরোনো ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা দেশি-বিদেশি কায়েমি স্বার্থের পক্ষে অনুকূল। কিন্তু আন্দোলনকারী তরুণ নেতৃত্ব ঘোষণা দিয়েছে, তারা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ চায়। এ দাবির পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের ধাত্রী পুরোনো রাষ্ট্রযন্ত্র ও সাংবিধানিক ক্ষমতাকাঠামোর বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের গোড়াপত্তন। গণ–সার্বভৌমত্বের বলে নির্বাচিত গণপরিষদে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানসম্মত। গণসার্বভৌমত্বের এখতিয়ার ও পরিধিকে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার ভেতর আঁটানোর বাসনা গণবিরোধী।

বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা নতুন ইতিহাস সৃষ্টির পথে ইতিমধ্যেই এই ইতিহাস সৃষ্টির প্রথম ধাপ হিসেবে ফ্যাসিবাদী শাসকের পতন নিশ্চিত করেছে। দ্বিতীয় ধাপ, তথা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপসাধন এখনকার রাজনৈতিক কর্তব্য। নব্বইয়ের ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র পুনরাবৃত্তি এবং এক-এগারোর সাংবিধানিক পথে ক্ষমতা হস্তান্তরের ফর্মুলা এ দফা ছাত্র-জনতা প্রত্যাখ্যান করবে বলেই মনে হয়।

  • সারোয়ার তুষার লেখক ও গবেষক। জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য।
  • prothom alo