গণহত্যা মামলা : বিচার নিয়ে সমন্বয়হীনতা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সরকার পতনের একদফার আন্দোলনে তৎকালীন সরকারের বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গণহত্যা চালানোর ঘটনায় ঢাকাসহ সারা দেশে হত্যা মামলা হচ্ছে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবার, দল  বা পুলিশের তরফে এসব মামলা হচ্ছে। মামলায় আসামি করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও দেশ ছেড়ে পালানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের। সাবেক মন্ত্রী-এমপি এবং নেতাকর্মীদেরও আসামি করা হচ্ছে বিভিন্ন মামলায়। গণহত্যার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালয়ও কাজ শুরু করেছে। সেখানেও অভিযোগ দায়ের করা হচ্ছে। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে হওয়া মামলায় গণহারে আসামি করা, অর্থের বিনিময়ে প্রকৃত আসামিদের নাম বাদ দেয়া বা আসামি করার ভয় দেখিয়ে অর্থ নেয়ার মতো অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। আন্দোলন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাধীন দেশে এমন গণহত্যার ঘটনা আর ঘটেনি। এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার এই মুহূর্তে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিচার নিশ্চিত করতে হলে সঠিক প্রক্রিয়ায় মামলা দায়ের এবং তার সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এখন যেভাবে মামলা হচ্ছে এবং ক্ষেত্রেবিশেষে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাউকে কাউকে আসামি করা হচ্ছে- এতে পুরো মামলার কার্যকারিতা বিঘ্নিত হতে পারে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা নিয়ে ইতিমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে আন্দোলন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্দোলনের সময় সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল এমন অপরাধীরা খুব একটা ধরা পড়ছে না। রাজনৈতিক নেতা ও সাবেক আমলারা ধরা পড়ছেন। আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী প্রকাশ্যে গুলি চালিয়েছে। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে তারা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্য সরাসরি গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে তাদেরও ধরা যাচ্ছে না। হত্যাকারীদের অনেকে ইতিমধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
আদালত ও থানায় দায়ের করা বিভিন্ন মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মামলা হওয়ার পরও অনেক  ক্ষেত্রে তদন্ত শুরু হয়নি। শুরু হলেও দায়সারাভাবে চলছে। এভাবে চললে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সহজ হবে না। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে দ্রুত ট্রাইব্যুনাল করে এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। এবং তদন্তে চৌকস ও প্রশিক্ষিত কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে।
গত ৫ই আগস্ট সরকার পতন হলেও ১৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে প্রথম মামলা করা হয়। ৪ঠা অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ২২২টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এসব মামলা নিয়ে সমালোচনাও আছে। কারণ বেশির ভাগ মামলার এজাহার প্রায় হুবহু, ফরমেট একই। বিভিন্ন মামলার এজাহারনামীয় বেশির ভাগ আসামিও এক। শুধুমাত্র থানা পরিবর্তন করে মামলা করা হয়েছে। তবে কিছু মামলার শেষের সারিতে আসামির নামে ভিন্নতা আছে। অনেক মামলায় ভুক্তভোগীর পরিবার বাদী হননি। অতি উৎসাহী হয়ে কেউ কেউ বাদী হয়েছেন। অনেক ভুক্তভোগীর পরিবারকে জোর করে বাদী করা হয়েছে। কিছু কিছু বাদী এজাহারে আসামি করা, মামলার ধরন কি সেটাও জানেন না। অনেক মামলায় উল্লিখিত ঘটনাস্থলের সঙ্গে বাস্তবতা ও আসামিদের মিল নেই। গণহত্যার বেশ কিছু মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এমন পরিস্থিতিতে গণহত্যার ঘটনায় করা গণমামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৬ বছরে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সরকারবিরোধীদের বিরুদ্ধে গণমামলা শুরু করে। হয়রানি করার উদ্দেশ্যে ঘটনা ঘটেনি অযথা মৃত ব্যক্তি থেকে শুরু করে নামে- বেনামে, ঘটনার সময় বিদেশে অবস্থান করা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। এ ছাড়া বিএনপি’র বিভিন্ন এলাকার নেতাদের কমিটি ধরে ধরে মামলার এজাহারভুক্ত করা হয়। এসব মামলা তখন গায়েবি মামলা হিসেবে পরিচিতি পায়। সব মামলার বাদী ছিলেন ওই পুলিশ বা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এ নিয়ে তখন ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর বিভিন্ন সেক্টরে যেখানে সংস্কারের আলোচনা চলছে। সংস্কারের প্রক্রিয়াও চলমান। কিন্তু তারপরেও আওয়ামী লীগ সরকারের মতো এখনো ঢালাওভাবে গণহত্যা মামলা হচ্ছে। বিভিন্ন মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিকেও আসামি করা হচ্ছে। অভিযোগ আছে ব্যক্তিগত ক্ষোভের প্রেক্ষিতেও অনেককে হত্যা মামলার আসামি করা হচ্ছে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হত্যা মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হয়। কিন্তু গণহত্যার ঘটনায় যেসব মামলা হচ্ছে সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নাই। নির্দেশদাতা-হুকুমদাতা হিসেবে আসামিদের উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিচারের জন্য আদালতে গেলে এসব মামলা টিকবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ আছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যার প্রমাণের কোনো অভাব নেই। দিনের আলোতে প্রকাশ্যে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। কারা গুলি করেছে, হামলা করেছে- তার ছবি ও ভিডিও আছে। এ ছাড়া যেসব স্থানে হত্যাকাণ্ড হয়েছে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার কি ভূমিকা ছিল তাও পরিষ্কার। আগে এসব তথ্য সংগ্রহ করে সুর্নিদিষ্ট
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, আমার মনে হয় তারা বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছে। তারাও চেষ্টা করছে মামলাগুলো যাতে সঠিকভাবে ফাইল করা হয়। আমি যতটুকু শুনেছি গণহারে যাতে মামলা না হয় সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। একদল অভিজ্ঞ আইনজীবীকে নিয়োগ দেয়া হবে। একটা লিগ্যাল সেল তৈরি করা হবে যাতে ভুক্তভোগীরা সঠিক বিচার পায়। বিচার নিয়ে শঙ্কা তৈরি নিয়ে তিনি বলেন, শঙ্কা তো তৈরি হবেই। এজন্য আমরাও বলেছি। সামনে এসব মামলার ব্যবস্থাপনার বিষয়ে পরিবর্তন আসবে বলে আমরা আশা করছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর অধিকাংশ মামলার আইনিভিত্তি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। একটা মামলার  ভিত্তি নিয়ে যখন বিতর্ক থাকে তখন শেষ পর্যন্ত কি ধরনের  বিচার হতে পারে সেটি শুরু থেকেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। বিগত ১৫ বছরে বা জুলাই বিপ্লবে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বা আহত ও নিহত হয়েছেন তাদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু একটা ব্যক্তিগত ক্ষোভকে সমন্বিতভাবে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে কীভাবে সমাধান করা যায়, সেটি যদি সরকার ভাবে তবে সেটি অধিকতর ফল দিবে। বিচ্ছিন্নভাবে ভাবলে বিচ্ছিন্নই থেকে যাবে। সেটির ফলাফল সৃষ্টি করা কঠিন হয়ে যাবে।

manabzamin