বেপরোয়া রায় ফাঁসের সাজাপ্রাপ্ত আসামি ব্যারিস্টার এ কে এম ফখরুল ইসলাম গণস্বাস্থ্যের অর্থ তছরুপ মিশনে সফল হতে মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার হুমকি
০৩ জুলাই ২০২৩
আদালতের রায় ফাঁস ও জামিন সনদ জালিয়াতির মতো অপকর্ম করা ব্যারিস্টার এ কে এম ফখরুল ইসলাম এবার গরিবের হাসপাতাল খ্যাত গণস্বাস্থ্যের অর্থ তছরুপের মিশনে নেমেছেন। বারবার চিঠি দেয়ার পরও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া প্রায় ১ কোটি টাকার হিসাব দিচ্ছেন না বিতর্কিত এই আইনজীবী। অর্থ লোপাটের চেষ্টার প্রতিবাদ করায় প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. নাজিম উদ্দিন আহমেদকে প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন ব্যারিস্টার ফখরুল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর এক মাস পার হতে না হতেই অসাধু কর্মকর্তারা গণস্বাস্থ্য থেকে ট্রাস্টিদের বিতাড়িত করে প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পাঁয়তারা শুরু করেছে। ট্রাস্টি আইন অমান্য করে নতুন টাস্ট্রি নিয়োগ দেখিয়ে টাস্ট্রি ডিড রেজিস্ট্রি করার তৎপরতা চালায় তারা। ব্যারিস্টার ফখরুলের নেতৃত্বাধীন এই অসাধু চক্রের তৎপরতার বিষয়টি আঁচ করতে পারেন ডা. নাজিম উদ্দিন আহমেদ। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে এই মুক্তিযোদ্ধা গত ৭ মে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন বরাবর চিঠি দেন। ফলে আর্থিক লেনদেনে অনিয়মসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে গত ২ জুন গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার ও অর্থ পরিচালক মনিকা সরকারকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রতিষ্ঠানটি। অসাধু সিন্ডিকেটের ২ প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থা নিলেও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ট্রাস্টের চেয়ারপারসন প্রফেসর আলতাফুন্নেসাকে ম্যানেজ করে প্রতিষ্ঠানের আইন উপদেষ্টা সুচতুর ব্যারিস্টার ফখরুল থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ডা. নাজিম উদ্দিন আহমেদকে প্রাণনাশের হুমকি দিতে শুরু করেন। এ নিয়ে ধানমন্ডি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন নাজিম উদ্দিন (জিডি নং-৫৯৩, ১০ মে ২০২৩)। অন্যদিকে নানা অভিযোগের ভিত্তিতে গত ৩ জুন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ট্রাস্টের চেয়ারপারসন প্রফেসর আলতাফুন্নেসা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন মামলার অবস্থা এবং অর্থের হিসাব চেয়ে ব্যারিস্টার ফখরুলকে চিঠি দেন। চিঠিতে জবাব দেয়ার জন্য ৭ দিনের সময়ও বেঁধে দেয়া হয়। নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও ব্যারিস্টার ফখরুল চিঠির জবাব না দেয়ায় গত ১২ জুন ২৪ ঘণ্টার সময় দিয়ে ফের চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু এর কোনো জবাব দেননি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীর রায় ফাঁস মামলার ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত এই আইনজীবী।
গণস্বাস্থ্য সূত্র ও নথি থেকে জানা যায়, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ট্রাস্ট সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ২০২১ সাল থেকে ব্যারিস্টার ফখরুলের নেয়া ৯৮ লাখ ৮৩ হাজার ৪৬০ টাকার হিসাব পাওয়া যায়। এর মধ্যে গত বছরের ১৫ অক্টোবর ট্রাস্টি বোর্ডকে সিদ্ধান্তের তালিকায় ৯টি চেকের বিপরীতে ৪২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দেয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ১০ মাসে ১২টি চেকে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ থেকে ফখরুল নেন ৩১ লাখ ২০ হাজার টাকা। অন্যদিকে ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর গণস্বাস্থ্য ক্রেডিট কো-অপারেটিভ সোসাইটি থেকে ২০ লাখ টাকা ঋণ নেন ফখরুল। কিন্তু এ পর্যন্ত এর ১টি টাকাও পরিশোধ করেননি, যা চলতি বছরের ৩১ মে সুদে-আসলে ২৫ লাখ ১৮ হাজার ৪৬০ টাকা হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম গত ৬ জুন এক চিঠিতে বারবার তাগাদা দেয়ার পরও ঋণ পরিশোদের উদ্যোগ না নেয়ার বিষয় উল্লেখ করে সুদসহ অবিলম্বে টাকা পরিশোধের চাপ দেন ফখরুলকে।
গণস্বাস্থ্য ঘিরে অনিয়মের বিষয়ে প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. নাজিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, গরিব মানুষের প্রতিষ্ঠানের অর্থ কোনো জালিয়াত চক্র হাতিয়ে নেবে তা হতে দেয়া যায় না। গণস্বাস্থ্যের মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত ফখরুল কোনোপ্রকার আইনি সহায়তা না করেই ৯৮ লাখ ৮৩ হাজার ৪৬০ টাকা আত্মসাত করেছেন। এর মধ্যে অনিয়মের অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকারের যোগসাজশে ৩১ লাখ ২০ হাজার, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ট্রাস্টের চেয়ারপারসন প্রফেসর আলতাফুন্নেসার যোগসাজশে ৪২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা আত্মসাত করেছেন। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ বিষয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ট্রাস্টের চেয়ারপারসন প্রফেসর আলতাফুন্নেসা বলেন, ২৮ মামলায় ৭২ লাখ টাকার চুক্তি হয়েছিল। আমার একার পক্ষে আইনজীবীকে টাকা দেয়া সম্ভব নয়। মামলা পরিচালনা করতে তিনজনের সম্মতিতে আইনজীবীকে ফি দেয়া হয়। একই বিষয়ে ব্যারিস্টার এ কে এম ফখরুল ইসলাম বলেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ট্রাস্টি বোর্ডের অনুমোদনক্রমে আমাকে তাদের আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জীবিত থাকাকালে এসব কথা উত্থাপিত হয়নি। এখন হঠাৎ করে কেন তোলা হচ্ছে। এখানেই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, জাল-জালিয়াতির জন্য জাতীয়ভাবে পরিচিত ব্যারিস্টার এ কে এম ফখরুল ইসলাম। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর রায় ফাঁস মামলায় এই আইনজীবীর ১০ বছর কারাদ- হলেও তিনি জামিনে বেরিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন। এই মামলার আপিল শুনানি প্রায় সাত বছর ধরে ঝুলে আছে। সাজা হওয়ার পরও ব্যারিস্টার ফখরুল দিব্যি আইন পেশায় আছেন। গত বছরের ২৬ জানুয়ারি তিনি ফরিদপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন একটি মামলার ছয় আসামিকে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিনের ভুয়া সনদ দেন। এ তথ্য ফাঁস হলে আদালত তাকে সতর্ক করেন।