গণমাধ্যম রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

  • ডা: মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
  •  ১৬ মে ২০২৩, ২০:১৫
গণমাধ্যম রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । – ছবি : সংগৃহীত

৩ মে ছিল বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস-২০২৩। সংবাদপত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও সংবাদকর্মীদের মেধা, মনন শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে প্রতিদিনই প্রকাশিত হয় একটি সংবাদপত্র। সংবাদপত্রকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। জ্ঞানের ভাণ্ডার। আবার বলা হয়, সভ্যতার অগ্রদূত ও সৃজনশীল প্রতিভাধর সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি। বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে এ দিবসটি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ইউনেস্কো দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচির জানান দেয় আগে থেকেই। প্রতি বছর একটি করে প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে।

এবার বিশ্ব গণমাধ্যম দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা সর্ব প্রকার মানবাধিকারের চালিকাশক্তি।’ গুরুত্বকে নিশ্চিত করার এবং সাংবাদিকতা জোরদার করার জন্য ব্যবহার সামগ্রীর উৎপাদন, বিতরণ এবং সংবর্ধনা প্রভৃতি বিষয়ে অনুসন্ধান করার আহ্বান হিসেবে কাজ করা এবং কাউকে পেছনে না রেখে স্বচ্ছতা ও ক্ষমতায়নের অগ্রগতি করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা।

থিমটি বিশ্বজুড়ে সমস্ত দেশের জরুরি ও প্রাসঙ্গিক বলে মনে করা হচ্ছে। এটি আমাদের স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও টেকসই উন্নয়নের ওপর প্রভাব ফেলছে এমন পরিবর্তনশীল যোগাযোগ ব্যবস্থাটিকে স্বীকৃতি দেয়। সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম বিশেষ প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করে। এসব আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দিনটি পেরিয়ে যায়। দিবসটি প্রতি বছর আসে-যায়।

প্রতি বছর ৩ মে বিশ্বজুড়ে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ বা মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশেও সাংবাদিক সংগঠন ও বিভিন্ন সংস্থা এ উপলক্ষে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। একটি সংবাদপত্রে দেশ ও জাতির সব বিষয়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে সংবাদপত্র প্রকাশের স্বাধীনতা যতটুকু রয়েছে, ততটুকুতেই দেশের নাগরিকদের মতামত প্রকাশে সুযোগও রয়েছে।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মৌলিক আদর্শগুলো চিহ্নিত করে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত আফ্রিকার নামিবিয়ায় উইন্ডোহোয়েক শহরে ইউনেস্কো ও ইউএনডিপিআইয়ের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে ডিক্লারেশন অব উইন্ডোহোয়েক ঘোষণা করা হয়।

১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ ‘৩ মে বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। সংবাদপত্রই প্রথম সৃষ্টি করেছে সভ্যতার উন্নয়নের উত্তাল ঢেউ। বাংলাদেশ বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির দেশ হিসেবে এগিয়ে চলছে। ধীরে ধীরে এর ধাপ আরো বৃদ্ধি পাবে। শিল্প, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির নীতি গ্রহণ করা হয়। সংবাদপত্র শিল্পেও এটি চলে আসছে। বৈশ্বিক করোনাকালেও সংবাদপত্র ও সাংবাদিক বন্ধুরা থেমে নেই। দেশের প্রিন্টিং, ইলেকট্রনিকস ও অনলাইন মিডিয়াগুলো বিরামহীন গতিতে তাদের সংবাদ দেশ ও জাতির সামনে তুলে ধরছে।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে দৃষ্টিপাত করা যাক, আমরা কোথায় দাঁড়িয়েছি। এ দিবসটির প্রাক্কালে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো প্রতি বছরের মতো গণমাধ্যমের স্বাধীনতার একটি বৈশ্বিক সূচকও প্রকাশ করে থাকে।

আমাদের দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ১৯৬২ সালে কলা অনুষদে ডিপ্লোমা-ইন-জার্নালিজম নামে একটি কোর্স চালু হয়েছিল। স্বাধীনতার পর এ কোর্সটি বন্ধ করে অনার্স কোর্স চালু করা হয়। ১৯৮০-র দশকে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৯০ দশকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার ডিগ্রি কোর্স চালু করা হয়; বলা যায়- যার হাওয়ায় আমাদের দেশে সংবাদপত্রের বিকাশ লাভ করে আসছে।

২০০০ সালে এসে সম্পৃক্ত হয় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের কম্পিউটার। বর্তমান সরকারের সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ২০১৪ সালে সংবাদপত্রকে শিল্প বলে ঘোষণা দিয়েছেন- যা সংবাদপত্রের জগতে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচ্য। ২০০০ সালের আগে দেশের সংবাদপত্রগুলো মুদ্রণশিল্পের মাধ্যমে প্রকাশিত। সিসা বা তামা কিংবা লোহার ধাতব পদার্থের মাধ্যমে বাংলা ভাষা প্রতিটি বর্ণ বসিয়ে বসিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করে সংবাদপত্র ছাপানো হতো যা ছিল ধৈর্য ও কায়িক শ্রমের বহিঃপ্রকাশ।

বর্তমানে এর পরিবর্তে স্বল্প সময়ে, কম্পিউটার কম্পোজে, পেস্টিং করে দ্রুততম সময়ে অটোমেটিক বৈদ্যুতিক ছাপাখানার মাধ্যমে সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে খুব অল্প সময়ে দেশের যেকোনো স্থান থেকে ইমেইল করে সংবাদ প্রেরণে একটি মাইলফলক উন্মুক্ত হয়। শুধু তাই নয়, ভিডিওতে দৃশ্য ধারণ করেও সংবাদ প্রাণবন্ত করে তোলা হচ্ছে পাঠকের কাছে। এর কারিগর হলেন আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা।

সাংবাদিক বন্ধুরা দিনের পর দিন অবাধ তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহারে জ্ঞানার্জন করে সংবাদপত্র অতি আধুনিক পদ্ধতিতে বের করতে সাহায্য করছেন। যার ফলে যেকোনো সংবাদ, বিষয়, ছবি ও সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষাপটগুলো খুবই চমৎকার ও শিল্পনৈপুণ্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে। তাই গণমাধ্যমকে বলা হয় একটি সমাজের দর্পণ। আমাদের চারপাশের নানান ঘটনার মধ্যে জরুরি এবং ব্যতিক্রম যা সাধারণের জানার আগ্রহ আছে, জানার প্রয়োজন আছে তা গণমাধ্যমে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়। একটি সংবাদ একজনের প্রয়োজন মেটায়, একটি সমাজের অসঙ্গতি দূর করে, ইতিহাস ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করে। অর্থাৎ মানুষের জানার ক্ষুধা মেটায় সংবাদ। আর সেটি যে মাধ্যমে প্রকাশ পায় তাই গণমাধ্যম। সংবাদের সংজ্ঞায় জন বোগার্ট বলেছিলেন, কুকুর মানুষকে কামড়ালে সংবাদ হয় না, কিন্তু মানুষ কুকুরকে কামড়ালে তা সংবাদ হয়।’

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। পাকিস্তান আমলে আমাদের গণমাধ্যম ছিল হাতেগোনা। কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না বলে সাংবাদিকদের অনেক কৌশলে সংবাদ পরিবেশন করতে হয়েছে এ দেশের মানুষের জন্য। স্বাধীনতার পর, মত প্রকাশে সাংবিধানিক স্বাধীনতা পান সাংবাদিকরা। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার পর, আমাদের আবার বন্দী হতে হয় সামরিক শাসনের কব্জায়। ফলে সঙ্কুচিত হয় মত প্রকাশের স্বাধীনতা। বলা যায়, সত্তরের মাঝামাঝি থেকে আশির দশকের লম্বা সময় সংবাদ সাংবাদিকতা চলে নানান সেন্সরশিপে। কিন্তু নব্বইয়ের গণ আন্দোলনের পর মুক্তি পায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা। ফলে বিকাশ ঘটে গণমাধ্যমের। বেসরকারি টেলিভিশনের লাইসেন্স প্রদান এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল আমাদের গণমাধ্যমে যুক্ত হয়। এতে আজ মানুষ খুব সহজেই সব ধরনের খবর তাৎক্ষণিক জেনে যায়। এর সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যুক্ত হয়েছে অসাংবাদিক প্লাটফর্মে। গণমাধ্যমের এই বিকাশের সুযোগে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ও অসাংবাদিক চলে আসে সাংবাদিকতা পেশায়। তারা লেজুড়বৃত্তিক সাংবাদিকতা শুরু করে স্বার্থান্বেষী মহল ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে। ফলে সাংবাদিকতার মান ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আজ যে কেউ এসেই একটি গণমাধ্যমের সম্পাদক হচ্ছেন। অথচ সাংবাদিকতায় ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা ছাড়া সম্পাদক হওয়ার বিধান নেই। কিন্তু হচ্ছেন। এ কারণে যে কেউ সাংবাদিকতাকে বিকৃত করে সংবাদ পরিবেশন করছেন। নিজস্ব স্বার্থে সংবাদকে প্রভাবিত করছেন। ভুল সাংবাদিকতা দিয়ে সমাজে উসকানি দিচ্ছেন। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন পাস হওয়া ‘নিউজ পেপার ডিক্লারেশন অ্যানালমেন্ট অর্ডিন্যান্স’ নামে আইনটি করা হয়েছিল তখনকার সাংবাদিক নেতাদের পরামর্শে। এর আগে পর্যন্ত সাংবাদিকদের কোনো বেতন কাঠামো ছিল না। মালিকরা সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন দিতেন না। বঙ্গবন্ধু এসব জানতেন। এ জন্য পঁচাত্তরের ১৬ জুনের পর যেসব পত্রিকা বন্ধ করা হয় তিনি সেসব সাংবাদিক-কর্মচারীর বেতন নিশ্চিত করেছিলেন।

তারা ১ তারিখ ট্রেজারিতে গিয়ে বেতন নিয়ে আসতেন। এ কারণে বঙ্গবন্ধুর গণমাধ্যম নীতির সমালোচনা করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস সফল হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না।’

গণসচেতনতা তৈরিতে মিডিয়ার ভূমিকা বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই গুরুত্বের সাথে স্বীকৃত। স্বাধীনতার পর থেকেই দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় বহুবিধ আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আরো কিছু নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উন্নয়নে বেশ কিছু নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং এগুলোর ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতির উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে।

বাকি অংশ আগামীকাল
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী
কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল : drmazed96@gmail.com