- এ এইচ খান রতন
- ২০ মার্চ ২০২৩, ১৯:২৮
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্য, বাকস্বাধীনতা, বস্ত্র এই অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলো মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও কালক্রমে মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্র এখন বহুধা বিস্তৃত। সময়ের সাথে মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে নতুন নতুন চাহিদা যুক্ত হচ্ছে। পরিবর্তনের এই ধারাবাহিকতায় মৌলিক অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে যুক্ত হয়েছে গণপরিবহন। মানুষ এখন অহর্নিশি কর্মব্যস্ত সময় পার করছে। আর সঙ্গত কারণেই গণপরিবহন এখন মৌলিক অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত কিম্বা কর্মস্থলে যাতায়াতে ব্যক্তিগত গাড়ি না থাকলে গণপরিবহনই একমাত্র বিকল্প । ব্যয়বহুল রাইড শেয়ারিং নিম্নমধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে।
পৃথিবীব্যাপী পরিবহনের গতি ও ধরনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। দ্রুতগতি এবং বিলাসবহুল পরিবহন ব্যবস্থার প্রতিযোগিতা এখন বিশ্বময়। জল-স্থল ও আকাশপথে সর্বত্রই মানুষের জীবন এখন ঘড়ির কাঁটার সাথে গতি মিলিয়ে বহমান। মেট্রোরেল, নদীর তলের টানেল, আকাশপথের উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকার কর্মযজ্ঞ ইত্যাদি সেই গতির সাথে তাল মেলানোর উদাহরণ।
কিন্তু, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ, যারা নিয়মিত গণপরিবহনের যাত্রী, তাদের যাতায়াতের জন্য সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের পরিবহন ব্যবস্থার কতটা উন্নতি হয়েছে? সমাজে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু, যে পরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার বিনিময়ে সাধারণ, মধ্যবিত্ত, এমনকি ধনিক শ্রেণীর নাগরিকরাও প্রয়োজনে যাতায়াত করে সেখানেই মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
গণপরিবহনের যানবাহনে যাত্রীরা ন্যূনতম স্বস্তির সাথে যাতায়াতের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যানবাহনে আসন ব্যবস্থা রীতিমতো অস্বস্তিকর। যাত্রীকে একরকম যুদ্ধ করে আসন খুঁজে নিতে হয়। সিটকভারগুলোর অবস্থা শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসে নতুনদার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা করেও নিতান্ত বাধ্য হয়ে ব্যবহার করা র্যাপারের কথা মনে করিয়ে দেয়। তেল চিটচিটে সিটকভার এমনই যে, নিতান্ত বাধ্য না হলে কেউ ওইসব নোংরা আসন ব্যবহারের কথা ভাবতেও পারে না। বাধ্য হয়েই নাক-মুখ বন্ধ করে যাতায়াতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। দেশের ৯০ শতাংশ পাবলিক পরিবহনের বাস্তব চিত্র এমনই। অনেক সময় অস্বস্থিকর এ পথযাত্রায় পরিবহনকর্র্মীর সাথে যাত্রীকে অহেতুক তর্কে জড়াতে দেখা যায়।
অথচ মাত্র দুটো আসন কম বসালেই অনেকটা স্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করা যায়। জঘন্য এই পরিবেশ, দেখার কেউ আছে বলে মনে হয় না। যদি বা সৌভাগ্যক্রমে কোনো যাত্রী আসনে বসার সুযোগ পায়, তাহলে হাঁটুর জোড়া বা মালাইচাকি ছিটকে বেরিয়ে আসার অবস্থা তৈরি হয়। নোংরা সিটকভার থেকে জীবাণু সংক্রমণের মতো ঘটনাও ঘটে। দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা না পারেন ঠিকমতো দাঁড়াতে, না পারেন সহযাত্রীর সাথে সৌজন্য রক্ষা করতে। নারী যাত্রীদের তো কথাই নেই। কারণ, যে পরিবহনে মানুষ যাতায়াত করছে, অনেক আস্তাবলের অবস্থাও তার চেয়ে ভালো। যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা অনিয়মই এখন নিয়মে পরিণত।
গাদাগাদি করে যে স্থানে ১০-১২ জন যাত্রী যাতায়াত করছে, সেই একই পথে এই পরিমাণ জায়গা দখল করে কেউ একজন বিশালাকায় জিপ হাকিয়ে একাই চলে যাচ্ছে। সরকারি বড় বড় পদে আসীন কর্মকর্তার জন্য একটি গাড়ি তো বটেই, বরাদ্দের বাইরেও একাধিক গাড়ি অবৈধভাবে ব্যবহারের নজির আছে। বৈষম্যের চিত্র এতটাই ভয়াবহ। বিশেষ কিছু বাহিনীর সন্তানদের স্কুল-কলেজে যাতায়াতে শুধু সরকারি গাড়িই নয়, সাথে ইডনিফর্ম পরা ড্রাইভারসহ বডিগার্ড ব্যবহার করার দৃশ্য অহরহ চোখে পড়ে। এ দেশে ক্ষমতায় যাওয়া মানুষগুলো খুব সহজেই ভুলে যায় যে, সেও ওই সাধারণ মানুষদেরই একজন। কিন্তু অন্য দেশে ক্ষমতাসীনরা দেশের প্রতি কতটুকু দায়িত্ববান হতে পারেন তার একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের একদল শিক্ষার্থী শিক্ষাসফরে চীনে যায়। কর্মসূচির মধ্যে চীনের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের পর্ব ছিল। সফরকারী দলটি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌঁছলে অভ্যর্থনা জানাতে আসা ভদ্রলোককে দেখে শিক্ষার্থীদের কেউই অনুমান করতে পারেনি, তিনিই প্রধানমন্ত্রী। কারণ, তিনি তখন রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আলোচনা শুরুর পর ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের কাছে বিষয়টি খোলাসা হলো, তিনিই চৌ এন লাই, চীনের প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানালেন, তিনি আজ তার চাকরিজীবী স্ত্রীর আগে বাসায় ফিরেছেন বলে রান্নার কাজটি সেরে নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী তার আধা পুরোনো একটি বাই-সাইকেল দেখিয়ে বললেন, এটি তার যাতায়াতের বাহন। ঘুরেফিরে নিজেদের শাকসবজির বাগান দেখালেন, যেখান থেকে পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করেন। বললেন, পৃথিবীতে যতদিন না তারা অর্থনৈতিকভাবে সবার চেয়ে এগিয়ে যাবেন, ততদিন নিজেরা আরাম-আয়েশের কথা ভাবছেন না।
চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি আজ গোটা পৃথিবীর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে, যা আপনি আমি টের পাচ্ছি প্রতি মুহূর্তেই। কিন্তু সেই সময় নিজেরা আয়েশি জীবন ত্যাগ করেছিল বলেই আজ তাদের প্রজন্ম বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত। আর আমরা! গণপরিবহন আর ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে এই যে বৈষম্য, তা ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। অধিক সুবিধাভোগী ব্যক্তি, রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ববোধ ভুলে গেছে। ব্যক্তিগত গাড়ি ও পাবলিক পরিবহনের জ্বালানির মূল্যে ব্যবধান থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ, ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে সুবিধাভোগী বাসার ড্রয়িংরুমের বিলাসী জীবন উপভোগ করছে, গাড়িতে বসেও। অন্যদিকে, গণপরিবহনের যাত্রীরা অস্বস্থিকর ও দুর্বিষহ যন্ত্রণা সহ্য করেও সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছেতে পারছে না। সেই সাথে অনিয়ন্ত্রিত ভাড়ার বিড়ম্বনা তো আছেই।
গণপরিবহনগুলোর ভেতরে যেখানে-সেখানে লোহার ধারালো বাড়তি অংশের কারণে মানুষের পরিধেয় বস্ত্র ছিঁড়ছে অহরহ। কখনো রক্তাক্ত হচ্ছে মানুষ। এত সব যন্ত্রণার পরও না আছে অভিযোগের স্থান না আছে সমাধানের উপায়। বাসস্ট্যান্ডে অকারণেই পেছনের পরিবহনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে আগে আসা গাড়িটি। কোন বিশেষজ্ঞের অনুর্বর মস্তিষ্কের উদ্ভাবন এ পদ্ধতি বা বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে কেন আসছে না, তার উত্তর কেউ জানে না। ৩০ জন যাত্রী ধারণক্ষমতার পরিবহনে ৫০ জনের দুর্বিষহ ধাক্কাধাক্কি এটি কি কোনো সভ্য সমাজের পরিবহনে চলতে পারে? পরিবহন সংশ্লিষ্ট সবার কাছে এ প্রশ্নটি কি জাতির পক্ষ থেকে প্রাসঙ্গিক নয়। সরকারের উচিত এমন গণপরিবহন চালু করা যা হবে স্বস্তিকর, দ্রুত ও সাশ্রয়ী। সুষ্ঠু পরিষেবার কারণে মানুষ যেন বাধ্য হয়ে গণপরিবহন ব্যবহারে উৎসাহী হয়। এতে রাস্তায় যানজট কমবে, সময়ও বাঁচবে।