- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ২১ জুন ২০২২, ২০:০৮
বাংলার রাখাল রাজা জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘জিয়াউর রহমান’ শুধু একটি নাম নন; একটি অনবদ্য চরিত্র। গদ্য-পদ্যের সংমিশ্রণে সাহিত্য যেমন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে; তেমনি জিয়াউর রহমানের সামরিক এবং রাজনৈতিক জীবনের গৌরবময় অংশগুলোর সংমিশ্রণে বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। সংক্ষিপ্ত জীবনের পুরোটাই একেকটি ইতিহাসের জন্ম দিয়ে নিজের জীবনকে বর্ণিল ইতিহাসের অংশ করে রেখেছেন। কী নেই তার জীবন ইতিহাসে? মহান তিনি জীবনাদর্শে, চিন্তা-চেতনায়, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আর দূরদর্শিতায়।
জীবনের সবটুকুই দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জীবন ইতিহাসের কোনো অংশই সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনার বিষয় নয়। তার বহু কীর্তির মধ্যে আমার এই নিবন্ধে উল্লেখ করার চেষ্টা করব, তিনি কিভাবে এবং কেন সামরিক বাহিনীর একজন জেনারেল হয়েও গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
আমরা যদি পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখতে পাব, এমন কোনো সামরিক শাসক নেই, যিনি জোর করে ক্ষমতা দখল করেননি এবং ক্ষমতায় গিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করেননি। সে ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি একদিকে যেমন জোর করে ক্ষমতা দখল করেননি; অন্যদিকে ক্ষমতায় গিয়ে সামরিক পোশাক ছুড়ে ফেলে গণতন্ত্রের পোশাক পরিধান করেছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। তিনি বিশ্বাস করতেন, সংবিধানে মানুষের যে মৌল-মানবাধিকারের কথা বলা হয়েছে তা প্রতিষ্ঠা করতে হলে জনগণকে সাথে নিয়েই করতে হবে। তাদের স্বাধীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনের সুযোগ দিতে হবে, কথা বলার অধিকারকে স্বাধীন ও অবাধ করতে হবে। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, মানুষের মুক্তির জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা। আর এই অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার জন্য গণতন্ত্রের বিকল্প কিছু নেই। তাই তিনি তার রাজনৈতিক ক্ষমতার পুরোটাই গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর জোর দিয়েছিলেন।
অন্য মৌলিক বিষয়গুলোর পাশাপাশি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক মুক্তি।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক এসব অধিকার ভূলুণ্ঠিত হওয়ার কারণেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, যারা স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে দাবি করছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের হাতেই গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়েছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে যখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়েছিল তখন কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতা ষোলআনায় পূর্ণ হয়েছিল। সেই সময় দেশ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ তো দূরে থাক, মা-বোনের ইজ্জত এবং দেশের নিরীহ মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য কোনো দিকনির্দেশনা না দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা গ্রেফতার হয়েছিলেন, তেমনি অন্য নেতারা নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই বিপদময় সময়ে কিন্তু জিয়াউর রহমান দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে, দেশের মানুষকে মুক্ত করার মানসে নিজের ও তার স্ত্রী-সন্তান, পরিবার পরিজনের কথা চিন্তা না করে পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে ‘I revolt’ (আমি বিদ্রোহ করলাম) বলে গর্জে উঠেছিলেন। তারপর তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেশকে স্বাধীন করার জন্য নিজে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে, যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছেন। তার স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে সারা দেশের মানুষ উজ্জীবিত হয়েছিল এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা সেনাসদস্য জিয়াউর রহমানকে সেদিন যেমন রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছিল; দেশ স্বাধীন হবার পরে সেই ব্যর্থ রাজনৈতিক নেতাদের হাতে আবার যখন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং গণতন্ত্র ধ্বংস হচ্ছিল তখন সময়ের প্রয়োজনে এই দেশের মুক্তিপাগল মানুষ তাদের নেতা হিসেবে জিয়াউর রহমানকে দেশ শাসনের নেতৃত্বের সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। এই দেশের জনগণ বিশ্বাস করেছিলেন, জিয়াউর রহমানের পক্ষেই দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষিত হতে পারে। তিনিও জনগণের সেই বিশ্বাসের পরিপূর্ণ মূল্য দিয়েছিলেন। প্রকৃত অর্থে জেনারেল জিয়ার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, অসীম সাহসিকতা, আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা, দেশবাসীর চরম আস্থা জাতীয় সঙ্কট উত্তরণে সাহায্য করেছিল।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মানুষ মনে করেছিল রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশেষ করে ওই সময়ের একচ্ছত্র নেতার হাতে তাদের ভাগ্যাকাশের পরিবর্তন ঘটবে। ব্রিটিশ, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘ শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন, নির্যাতনের অবসান ঘটবে। কিন্তু এর কোনোটিই হয়নি। উপরন্তু দেশের মানুষের অধিকার রহিত করার মানসে গণতন্ত্রকে হত্যা করে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি দেশের সংবিধানের আমূল পরিবর্তন করে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা চালু করা হয় এবং এই সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে ‘বাকশাল’ গঠন করা হয়।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী মানুষের স্বাধীনতা ও সাম্যের অধিকারকে গলাটিপে ধরে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিলটির ওপর কোনো আলোচনার সুযোগ না দিয়েই খুব অল্প সময়ে (মাত্র ১১ মিনিটে) বিলটি পাস করা হয়। এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, ‘…অবশ্য পরবর্তীকালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রেসিডেনসিয়াল পদ্ধতির নামে একদলীয় শাসন কায়েম ও বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা নস্যাৎসহ বিভিন্ন ব্যাপারে এই শাসনতন্ত্রের ফান্ডামেন্টাল পরিবর্তন সাধন করা হয়েছিল। …জেনারেল ওসমানী, নূরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখের যুক্তিপূর্ণ ও জোরালো বক্তৃতার মুখে শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে কোনোরূপ সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকেই একান্ত আকস্মিকভাবে পার্লামেন্টারি পার্টির সেই বৈঠকটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল এবং পরবর্তী পর্যায়ে তাড়াহুড়া করে পার্লামেন্টে গৃহীত হয়েছিল চতুর্থ সংশোধনীটি।’ (ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, বাংলাদেশ : বাস্তবতা ও প্রত্যাশা, পৃষ্ঠা নং-৭৯)
গণতন্ত্রকে বিকশিত করার প্রধান মাধ্যম হলো সংবাদপত্র। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা না থাকলে গণতন্ত্রের রূপ ফুটে ওঠে না। কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষ যেখানে মুক্তকণ্ঠে তাদের অধিকারের কথা বলবে, মুক্তহস্তে অধিকারের কথা লিখবে, তাদের সেই অধিকার হরণ করার জন্য রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত চারটি পত্রিকা রেখে ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন বাকি সব পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করেন।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার কারণেই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধটা ত্বরান্বিত হয়েছিল। ইতিহাসের সত্যতাও তাই যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের বিজয়কে মেনে নিতে পারছিল না। এই ক্ষোভের বশবর্তী হয়েই সেদিন মানুষ জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য! স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচনই গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাল। দেশের নতুন সংবিধান কার্যকর হলে সংবিধান অনুযায়ী ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচনের জন্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে। মোট ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ২৯৩টি আসন। এই নির্বাচনে ১১ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছিল সেই প্রসঙ্গে অলি আহাদ তার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পরিতাপের বিষয়, নির্বাচন (১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের নির্বাচন) অবাধও হয় নাই, সুষ্ঠুও হয় নাই।’
নব্য স্বাধীন দেশের প্রথম প্রহরেই স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল চেতনা গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করার চেষ্টা শুরু হয়; যা একদলীয় বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণভাবে হত্যা করা হয়।
গণতন্ত্রকে হত্যা করার মধ্য দিয়েই দেশের আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের স্বকীয়তা কুক্ষিগত করা হয়। ফলে দেশে লুটতরাজ, হত্যা, গুম-খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বেড়ে যায়। নানাবিধ কারণে রাষ্ট্রময় এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এই আবহের মধ্যেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ মুজিবকে হত্যা করার পর তারই মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। ‘খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে দ্রুত মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। এই মন্ত্রিপরিষদে কোনো সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন না। বরং এই মন্ত্রিপরিষদে মুজিব মন্ত্রিপরিষদের ১৯ জন মন্ত্রীর ১১ জন এবং ৯ প্রতিমন্ত্রীর আটজন যোগদান করেন।’ (প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা, পৃষ্ঠা নং-৪৩০)
‘খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতায় বসার পর দেশে সামরিক আইন জারি করে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ৩ অক্টোবর আরো ঘোষণা করেন, দেশে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট থেকে রাজনৈতিক কার্যক্রম আবার চালু হবে এবং ১৯৭৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচনের জন্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ (ড. মোহাম্মদ আবদুল ওদুদ ভূঁইয়া, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া : সমাজ ও রাজনীতি, পৃষ্ঠা নং-২৭১)
খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। অধ্যাদেশটিতে দু’টি ভাগ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। এখানে উল্লেøখ্য যে, খন্দকার মোশতাক আহমদের শাসনামলে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। এমনই এক পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটান। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর ৮৩ দিনের মাথায় খন্দকার মোশতাক ক্ষমতাচ্যুত হন।
খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করার সাথে সাথেই সাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ঢাকা ব্রিগেডের সহায়তায় ৩ নভেম্বর রাত্রিতে বেতার ও টেলিভিশনসহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং সামরিক বাহিনীর স্টাফ প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে তিনি নিজেই সামরিক বাহিনীর স্টাফ প্রধানের পদে উন্নীত হন। খন্দকার মোশতাকের পদত্যাগের পর বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্ত হন। খালেদ মোশাররফ মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করেন, জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন এবং দেশে সামরিক আইন জারি করেন। খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা গ্রহণের পরই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সিপাহি-জনতার বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং ৬ নভেম্বর প্রথম প্রহরেই তাকে হত্যা করে সিপাহি জনতার বিরাট অংশ এবং জনতা মিলে রাতেই ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে উদ্ধার করে। তারা শ্লোগান দেয় ‘সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ, জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। ৭ নভেম্বরের ক্ষমতার পটপরিবর্তনকে ‘পরাধীনতার পরিসমাপ্তি’ হিসেবে উল্লেখ করে এনায়েতুল্লাহ খান সম্পাদিত পত্রিকা বাংলাদেশ টাইমস শিরোনাম দেয়- ‘বাংলাদেশ উইনস ফ্রিডম’।
৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পর সিপাহি-জনতার দাবির মুখেই জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ৭ নভেম্বর তিনি সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধানের পদে পুনরায় অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারিত হন এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি একাধারে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। (মোহাম্মদ আবদুল ওদুদ ভূঁইয়া, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া : সমাজ ও রাজনীতি, পৃষ্ঠা নং-২৭২)
রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেই তিনি ১৯৭২ সালের সংবিধানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করেন। সংবিধানের রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্রের’ পরিবর্তন সাধন করে যথাক্রমে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক বিশ্বাস ও আস্থা’ এবং ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার এ অর্থে সমাজতন্ত্র’-এর কথা উল্লেখ করেন। রাষ্ট্রপরিচালনার অপর দু’টি মূলনীতি ‘জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘গণতন্ত্রকে’ অপরিবর্তিত রাখা হয়।’ (মোহাম্মদ আবদুল ওদুদ ভূঁইয়া, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া : সমাজ ও রাজনীতি, পৃষ্ঠা নং-২৭২)
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক শুরুর প্রেক্ষাপটের বিষয়টি জনগণকে কেন্দ্র করে। জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতার শীর্ষে নিয়ে আসে সিপাহি-জনতার আন্দোলন। এখান থেকেই জিয়াউর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। জনগণকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাকে ব্যক্তিতন্ত্রের মন্ত্রে আবদ্ধ করলে জনগণ কিছুতেই তা বরদাশত করবে না। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষ তথা জনগণ তার নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে যথার্থভাবে, যা ছিল বাঙালির স্বাধীনতার চেতনার মূল চাওয়া। তাই রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে জিয়াউর রহমান চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত গণতন্ত্রকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য গণতন্ত্রায়নের উদ্যোগ নেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন। দেশের রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির আভাস দিয়ে তিনি বলেন, ‘I will make politics difficult for the politicians’.
রাষ্ট্রপতি সায়েম স্বাস্থ্যগত কারণে রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করলে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করে ১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বে-সামরিকীকরণের আভাস দেন। ঘোষণায় তিনি বলেন, ১৯৭৭ সালের ৩০ মে তার প্রতি আস্থা যাচাইয়ের জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে দেশব্যাপী গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। দেশের পৌরসভা ও জেলা পরিষদগুলোতে ১৯৭৭ সালের আগস্ট ও ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথাও তিনি ঘোষণা করেন। তিনি আরো বলেন, ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য কি না তা যাচাই করার জন্য ১৯৭৭ সালের ৩০ মে আস্থা গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ভোটারদের কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আপনি কি রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের (বীর উত্তম) প্রতি এবং তার দ্বারা গৃহীত নীতি ও কার্যক্রমের প্রতি আস্থাশীল? ভোটের ফলাফল ছিল, ৯৮.৯ শতাংশ- হ্যাঁ এবং মোট ভোট সংগৃহীত হয়েছিল ৮৮.১ শতাংশ।
জিয়াউর রহমান শুধু মৃত গণতন্ত্রকে পুনর্জীবিত করেছিলেন তা নয়; স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরু থেকে দেশের ক্রান্তিকালে এবং নিজে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে একটি দিশাহীন জাতিকে দিকের সন্ধান দিয়েছিলেন। সমরনায়ক থেকে নিজেকে জনতার নায়কে পরিণত করেছিলেন। বিশ্ব ইতিহাসে চারণ রাষ্ট্রপতি নামে খ্যাত সমরনায়ক জিয়া অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তিলে তিলে নিজেকে নির্মাণ করতে পেরেছিলেন নিখাদ, নিষ্কলুষ এক জনগণমন অধিনায়ক জিয়া করে।