2 October 2019
ফারাক্কার বিপরীতে বাংলাদেশ গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প করার জন্য বর্তমান সরকার ২০১১ সালে একটা প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের নকশা এবং সম্ভাব্যতা যাচাই এর সময় বাধে গণ্ডগোল। অবশেষে ১১ এপ্রিল ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পকে বাতিল করেন এবং এই প্রকল্পকে আত্মঘাতী বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু কেন??? এই ব্যাপারে আলোচনা টা লেখার শেষ অংশে পাবেন।
পাকিস্তান আমলে ফারাক্কা ব্যারেজের কাজ শুরু হলেও পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রতিবাদ জানানো হয়নি। ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা চালু হবার পর থেকে ভারত বেশ কিছু ভয়ানক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।
ফারাক্কার উদ্দেশ্য ছিলো মূলত তিনটি:
১. কলকাতা বন্দরের দিকে অতিরিক্ত পানি সরবরাহ করে পলি জমে যাওয়ার হাত থেকে বাচানো
২. কোলকাতা শহরে সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা
৩. হুগলী সহ অন্যান্য নদীতে পানি প্রবাহ বাড়িয়ে জীবিত রাখা।
১৯৭৫ সালে ফারাক্কা চালু হবার পরের বছরেই মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ফারাক্কার বিরুদ্ধে লং মার্চ করে এর প্রতিবাদ জানান। কিন্তু ওই সময়েও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শক্তিশালী প্রতিবাদ আসেনি। ওই সময় থেকে ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত পদ্মার পানী বন্টন নিয়েও বাংলাদেশ শক্তিশালী কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি।
সমস্যার শুরু বেশ আগে থেকেই। যেই উদ্দেশ্যে ভারত ফারাক্কা বাধ করেছিল তার কোনটিই পূর্ন হয়নি। তবে হারাতে হয়েছে অনেক বেশি। ফারাক্কার কারনে ভারতে ইলিশ আসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
ভারত চেয়েছিল বাধের রিজার্ভারের পানি কলকাতা বন্দরের পলি জমা কমাবে। কিন্তু সেটা তো হয়নি বরং উলটা হয়েছে। পদ্মা দিয়ে বয়ে আসা পলি গুলি প্রকৃতির নিয়মে সমুদ্র পর্যন্ত পৌছাতে না পারার কারনে ভারতে উজানে বিভিন্ন নদীতে জমে নদীগর্ভ ভরে ফেলেছে। নিয়মিত ড্রেজিং করে পলি না সরানোর জন্য প্রতিবছর ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়তে হচ্ছে ভারত কেই।
সেই সাথে ভূগর্ভস্থ পানির স্থর নেমে গেছে। সাম্প্রতিক। বিহার, উত্তর প্রদেশ এবং পশ্চিম বঙ্গে ভয়াবহ বন্যার জন্য দায়ি ছিল এই ফারাক্কা বাধ। বাস্তুসংস্থান কে নষ্ট করে দিয়েছে এই বাধ।
২.৬২ কিলোমিটারের এই বাধ বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত।
এই প্রকল্প যখন শুরু হয় তখন পশ্চিম বঙ্গের চীফ ইঞ্জিনিয়ার কপিল ভট্টাচার্য ১৯৬১ সালেই ফারাক্কার বিরুদ্ধে সরব হন। তিনি বলেছিলেন যে এই বাধ করলে যেই উদ্দেশ্যে করা হয়েছে সেটাতো হবেই না উলটা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পলি গুলি নদীগর্ভে জমে গভীরতা কমিয়ে দিবে। এতে ভয়ানক বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করা লাগবে ভারত কে। ভাসানীর আগেও কপিল ভট্টাচার্য এই বিরোধিতা করেন যার জন্য তাকে পাকিস্তানি গোয়েন্দা হিসাবে ভাবা হত। নানান সমালোচনার মূখে পড়তে হয়েছে তাকে।
আজ তার কথায় সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তিনি একটি বই রিপোর্ট লিখেছিলেন যার টাইটেল ছিল “Silting of Calcutta Port”। সেখানে তিনি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছিলেন যে বাধ পরবর্তী বিভিন্ন সমস্যা গুলিকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন এই বাধ করলে কলকাতা বন্দরকে মেরে ফেলা হবে। প্রধান ড্রেইনেজ চ্যানেল কে সংকুচিত করে ফেলা হবে যার ফলে ভয়াবহ বন্যা হবে সেই সাথে বণ্যার পানির সাথে অতিরিক্ত পলি এসে নদীগুলাকে শেষ করে দিবে। হয়েছেও তাই।
তার ধারনা ছিল শুকনার সিজনে প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র অর্ধেক পানি পাওয়া যাবে যার ফলে হুগলী সহ অন্যান্য রিভারে পলি জমে মেরে ফেলা হবে নদীগুলাকে।
বিহারে ২০১৬ সালের ভয়াবহ বন্যার পর মূখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার সরাসরি ফারাক্কা বাধকে দায়ি করেন। কেন্দ্র সরকারের কাছে আর্জি জানান এই বাধ ধ্বংস করার জন্য।
যাহোক ফারাক্কার মাধ্যমে প্রাকৃতিক প্রবাহ কে ধ্বংস করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ফারাক্কা চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ৩৫০০০ কিউসেক পানি। কিন্তু ভারর সেটা ৬৫% এর ও বেশি সময় দেয়নি।
এখন গঙ্গা ব্যারেজ নিয়ে আলোচনার আগে তিস্তা ব্যারেজ নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। বাংলাদেশের গলার কাটা হল তিস্তা ব্যারেজ। অতিরিক্ত পলি জমে তিস্তার গভীরতা কমে যাবার জন্য এই ব্যারেজ দায়ি। ফলে প্রতিবছর তিস্তার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বণ্যার সৃষ্টি করছে। এর প্রধান কারন রিজার্ভার। প্রশ্ন আসতে পারে রিজার্ভার কি? মূলত যেখান্র বাধ দেয়া হয় সেখানে মূলত পানির প্রবাহ আটকে পানিকে জমা করা হয়। বিপুল পরিমান পানি জমিয়ে আটকে রাখার জন্য সেই পরিমান ধারন ক্ষমতার রিজার্ভার তৈরি করতে হয়ে। অনেক গভীর করে এবং অনেক সময় দুই পাশে উচু প্রাচীর তৈরি করে এই রিজার্ভর তৈরি করা হয়। কিন্তু পানিতে যদি পলি বেশি পরিমানে থাকে তবে এই রিজার্ভারে পলি জমে গভীরতা কমে যাবে। ফলে একটু বেশি বৃষ্টি হলেই বাধ উপচে পানি আশেপাশে বণ্যার সৃষ্টি করবে।
আমি সহজ ভাষায় বুঝানোর চেষ্টা করছি। তাই অনেক টার্ম ব্যাবহার করছিনা।
গঙ্গার ক্ষেত্রে যখন প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে নেয়া হয় তখন প্রধানমন্ত্রী এই রিজার্ভারের ব্যাপারেই প্রথম ইঞ্জিনিয়ার দের কাছে জানতে চান। এর প্রভাব কেমন পড়বে সেটা জানতে চান। বাংলাদেশ রাজবাড়ী জেলার পাংশায় প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ করা হলে নদীকে খনন করে বিশাল রিজার্ভার তৈরি করা লাগত। দুই পাশে পাড় উচু করে প্রাচীর দেয়া লাগত যেন পানি উপচে বন্যার সৃষ্টি না হয়।
কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার দের কাছে এই ব্যাপারে সমধান জানতে চাওয়া হলে তারা সঠিক সমাধানের পথ বাতলে দিতে পারেনি। আসলে কারো পক্ষেই এটা সম্ভব না। কেন সম্ভব না??
বাংলাদেশ ভাটির দেশ। সমতল ভূমির গঠনে রিজার্ভার সৃষ্টি করা ভয়ানক বিপদজনক। কারন সমতলে পানি আটকে রাখার মত দুই পাশের প্রাকৃতিক প্রাচীর থাকে না। পাহাড়ী নদী গুলাতে এরকম বাধ নির্মাণ করতে গেলে সেখানে রিজার্ভার নিয়্র তুলনামূলক কম চিন্তা করতে হয়। কারন পাহাড় প্রাকৃতিক ভাবেই উচু প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে পানিকে আটকে রাখে। সমতলে সেটা সম্ভব না।
আর শুধু এই রিজার্ভরের কারনেই আটকে গেছে গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প। তবে প্রধানমন্ত্রী রিজার্ভরের জন্য উজানে ভাল লোকেশনের খোজ করতে বলেছেন। যদিও বাস্তবিত অর্থে সেটা সম্ভব না। আমরা গঙ্গা ব্যারেজ করতে পারব। সেই টাকাও আছে।
কিন্তু এই ব্যারেজ করলে রাজবাড়ীর পরে অংশে পানির জন্য হাহাকার পড়বে। উপরের অংশে ভয়াবহ বণ্যা হবে। প্রকৃতি কে প্রকৃতির মতই চলতে দেয়া উচিত। কিন্তু আমরা মানব সভ্যতা সেটাকে নষ্ট করছি বাড়তি লাভের আশায়। কিন্তু প্রকৃতি ঠিকি শোধ তুলে নিচ্ছে। ভারত তার উদাহরণ।