খেলাপিদের জন্য দেয়া হলো আরো সুবিধা

  • নয়া দিগন্ত অনলাইন
  •  ২১ জুন ২০২৩, ২৩:২৯

বাংলাদেশে ঋণ খেলাপিদের আরো সুবিধা দেয়া হলো। এবার তারা কিস্তির অর্ধেক শোধ করতে পারলেই তাদের আর ঋণখেলাপি বলা হবে না। এর আগেও তাদের বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেয়া হলেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ না কমে, বরং বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) কিস্তির ৫০ ভাগ ঋণ পরিশোধ করলেই তাদের আর ঋণখেলাপি হিসেবে বিবেচনা করা হবে না। এর ফলে যারা খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে ছিলেন, তারা কিস্তির ৫০ ভাগ দিয়ে নিয়মিত গ্রাহক থাকতে পারছে। তবে এ সুবিধা দেয়া হচ্ছে মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে। আর ব্যাংক খাতের ১৫ লাখ কোটি টাকার মধ্যে অর্ধেকই মেয়াদি ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যসায়ীদের ছাড় দেয়ার জন্য এই নিয়ম করা হয়েছে। এর আগেও ঋণখেলাপিদের অনেক সুবিধা দেয়া হয়েছে। করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে কোনো ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপি ঘোষণা থেকে মুক্ত ছিল গ্রাহকেরা। ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রেও সুবিধা দেয়া হয়। ঋণের আড়াই থেকে চার ভাগ ব্যাংকে জমা দিয়ে নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়। আগে এই হার ছিল ১০ ভাগ। কিন্তু তারপরো খেলাপি ঋণ কমছে না, উল্টা বাড়ছে।

গত মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব তৈরি করেছে তাতে চলতি বছরের মার্চ শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। আগের বছর ২০২২ সালের একই সময়ের চেয়ে তা ১৬ ভাগ বা ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা বেশি। আর সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বরের চেয়ে জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিক শেষে তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে নয় ভাগ বা ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা।

এই খেলাপি ঋণের সাথে অবলোপন করা ঋণ যুক্ত করা হয়নি। জানুয়ারি শেষে এর পরিমাণ ৪৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি হয়ে যাওয়া আদায় অযোগ্য ঋণকে তিন বছর পর অবলোপন (রাইট) করতে পারে ব্যাংক, যা খেলাপির তালিকায় না রেখে পৃথক হিসেব রাখা হয়।

পুনঃতফসিল করা ঋণের হিসাবও খেলাপি ঋণের তালিকায় থাকে না। আর আদালতে রিট করেও অনেকে খেলাপি হওয়া আটকে রেখেছে। ব্যাংক চাইলেই বিভিন্ন কৌশলে খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে বাংলাদেশে প্রকৃত খেলাপি ঋনের পরিমাণ তিন লাখ কোটি টাকা। তাই খেলাপি ঋণের বাংলাদেশ ব্যাংকের এই তথ্য প্রকৃত চিত্র নয়। অনেক ব্যাংক ঋণ আদায় করতে না পেরে তারল্য সঙ্কটে ভুগছে।

সিরডাপের পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব উদ্যোগ বা সুবিধা কোনো কাজে আসে না। খেলাপি ঋণ আরো বাড়ে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত না দেয়া বাংলাদেশে কালচারে পরিণত হয়েছে। তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া যায় না। ফলে যাদের ক্ষমতা আছে তারা এভাবেই ব্যাংকের টাকা নিয়ে যায়।’

তার কথায়, ‘এখানে একটি অংশ আছে যারা প্রকৃতই খেলাপি। যারা ঋণ নিয়েছেন ব্যবসা করতে, সফল হননি। কিন্তু একটি গ্রুপ আছে যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি। তারা একটি পরিকল্পনা করেই ব্যাংকের টাকা নেয়। তাদের উদ্দেশ্যই থাকে ব্যাংক থেকে টাকা নেয়া এবং ফেরত না দেয়া। এদের কেউ আছে এ টাকা নেয়ার জন্য তথাকথিত কিছু অবকাঠামো তৈরি করে। আরেক গ্রুপ আছে তারা ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেয়। ওই সব প্রতিষ্ঠানের আদৌ কোনো অস্তিত্ব নেই। তাহলে প্রশ্ন তারা কিভাবে ঋণ নেয়? এর সাথে ব্যাংকের পরিচালক থেকে শুরু করে অন্য কর্মকর্তারাও যুক্ত থাকে। যদি ধরে নেয়া হয় যে ব্যাংক ঠিক মতো যাচাই করতে পারেনি। তাহলে তাদের এই প্রতারণা যখন ধরা পড়ে, তখন কেন ব্যবস্থা নেয়া হয় না? তাদের রাজনৈতিক বা অন্য কোনো ক্ষমতার কারণেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। নেয়া হলে তো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।’

যমুনা ব্যংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো: নুরুল আমিন গত মাসে ঋণ খেলাপির পরিমাণ বাড়ার পর বলেছিলেন, ‘উচ্চ আদালতে রিটের মাধ্যমেও অনেক খেলাপি ঋণ হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে। রিসিডিউল করা ঋণ হিসাবে রাখা হয় না। আরো অনেক কৌশল আছে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর। তাই বাস্তবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। এর বড় একটি অংশ আর কখনোই ফেরত পাওয়া যাবে না।’

তার মতে, ‘এখানে ইচ্ছাকৃত খেলাপিই বেশি। আর মোট খেলাপি ঋণের ৮০ ভাগেরও বেশির জন্য অল্প কিছু প্রভাবশালী লোক দায়ী। তারা স্বেচ্ছায় খেলাপি। আসলে বছরের পর বছর এদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় বাংলাদেশে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত না দেয়ার ব্যবসার একটি ঋণ খেলাপি মডেল দাঁড়িয়ে গেছে।’

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব উদ্যোগ বা সুবিধা খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য নয়, বড় বড় ঋণ খেলাপিদের আড়াল করার জন্য। এখনকার অর্থমন্ত্রী যত দিন থাকবেন, সালমান এফ রহমান যত দিন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা থাকবেন ততদিন এভাবেই আড়াল করার চেষ্টা চলতে থাকবে। আমরা এ সময়ে কোনো খেলাপি ঋণ আদায় হতে দেখিনি। বেক্সিমকো তো বড় ঋণ খেলাপি ছিল। এখন আড়াল করে ফেলা হয়েছে।’

তার কথায়, ‘বাংলাদেশের এই যে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের ৮৫ ভাগই বড় বড় ঋণখেলাপিদের, রাঘব বোয়ালদের। আর বাকি ১৫ ভাগ কয়েক হাজার ছোট ঋণখেলাপির। এই ১৫ ভাগ বড় সমস্যা নয়। বড় সমস্যা রাঘব বোয়ালরা। তাদের বিরুদ্ধে তো কখনোই কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’

২০১৯ সালে শীর্ষ ৩০০ খেলাপির তালিকা সংসদে প্রকাশ করা হয়। সংসদে তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত জানিয়েছিলেন, তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। গত জানুয়ারিতে শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকা সংসদে প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। তবে ওই পর্যন্তই। বাস্তবে তাদের ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
সূত্র : ডয়চে ভেলে