মাহবুব উল্লাহ্ :
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন বিবেচনার প্রস্তাব রোববার যেভাবে আইন মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি ‘না’ করে দেওয়া হয়েছে, তা খারাপ দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকবে। এর প্রথম কারণ হলো– সরকার বলছে, সাজাপ্রাপ্ত কোনো বন্দির বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশেই এর দৃষ্টান্ত রয়েছে। আমরা দেখেছি, জিয়াউর রহমানের আমলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) নেতা আ স ম আব্দুর রবকে সে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি বন্দি থাকলেও এবং সাজাপ্রাপ্ত হলেও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন। ১০ বছরের সাজা বহাল থাকা অবস্থাতেই তাঁকে চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে পাঠানো হয়েছিল। শুধু তাই নয়; রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নিয়ে হত্যা মামলার অনেক দণ্ডিত আসামিও ছাড়া পেয়ে গেছেন। বিদেশে পলাতক আসামিকে দেশে এনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার সুবিধা দেওয়ার উদাহরণও আছে। স্বাধীনতার পর বিগত রাষ্ট্রপতির সময় পর্যন্ত মোট ২৫ জন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এ রকম ক্ষমার সুযোগ পেয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়া কঠিনভাবে অসুস্থ। বাংলাদেশে যতটুকু চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে, সে অনুযায়ী তাঁর চিকিৎসা ইতোমধ্যে হয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমে তাঁর পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা সম্ভব নয়। এদিকে ভালো চিকিৎসার অভাবে তিনি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় তাঁর অনেক অবদান। এই মানুষটিকে এমন অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, অনেকেই মনে করেন, সেটা আদৌ অভিযোগ নয় এবং ঠিকও নয়।
বর্তমানে খালেদা জিয়ার যে শারীরিক অবস্থা, তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া জরুরি। তাঁর জীবন রক্ষার্থে বিদেশে নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দেওয়া পত্রেও অনেক জটিল রোগের কথা বলা হয়েছে। তিনি যে লিভার সিরোসিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তার আধুনিক চিকিৎসা বিদেশেই উত্তম। এ অবস্থায় চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দেওয়া মানে টেকনিক্যালি তাঁর জীবন রক্ষার সুযোগ নষ্ট করা। তিনি এ অবস্থায় মারা গেলে কার্যত এটা হত্যার শামিল হবে।
বস্তুত খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি অনেক দিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে। এর ঘটনাপ্রবাহ আমরা সংবাদ মাধ্যমের সূত্রে দেখতে পারি। শুরুতে মনে হচ্ছিল, সরকার এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে। তাই প্রশ্ন ওঠে, সরকারের দিক থেকে সবুজ সংকেত না থাকলে কি খালেদা জিয়ার পরিবার আবেদনপত্র পাঠাত? যেমন ২০২১ সালের ৭ মে যুগান্তরে প্রকাশিত এক খবরের শিরোনাম ছিল– খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিদেশ কারা যাচ্ছেন?
সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের বিষয়টি উল্লেখ করেই ২০২১ সালের ৮ মে দেশ রূপান্তরের রিপোর্ট ছিল– ‘বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন খালেদা জিয়া’। যদিও একই বছরের ৯ মে বিবিসি বাংলার খবর নিশ্চিত করে– ‘বিএনপি নেত্রীকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেবার অনুমতি দেয়নি সরকার’। ওই দিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য প্রকাশিত হয় ডেইলি স্টারে– ‘আইন অনুযায়ী খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার সুযোগ নেই’। অবশ্য পরিবারের পক্ষ থেকে তারা প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।
২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর বিবিসি বাংলার খবর ছিল– খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে সরকারের কাছে আবারও চিঠি দেয় পরিবার। আইনমন্ত্রী এখন যা বলছেন, তখনও প্রায় অনুরূপ বক্তব্য দেন। ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর যেমনটা জনকণ্ঠে প্রকাশ হয়– বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই বছরের ২৯ এপ্রিল সমকালে আইনমন্ত্রীর অনুরূপ বক্তব্য প্রকাশ পায়– ‘খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার কোনো সুযোগ নেই।’ গত ৯ সেপ্টেম্বর যুগান্তরে প্রকাশিত বক্তব্যও ভিন্ন নয়– ‘খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ নেই: আইনমন্ত্রী’। যদিও দু’দিন আগে তথা ৩০ সেপ্টেম্বর ইত্তেফাকের খবর ছিল– আইনি প্রক্রিয়া মেনেই বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন খালেদা জিয়া: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আইনি প্রক্রিয়াটি কি ৩০ সেপ্টেম্বর ভয়েস অব আমেরিকায় প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য– ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা নিতে হলে তাঁকে আবার জেলে যেতে হবে’?
রোববার তো আমরা জেনে গেলাম, খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আবেদনে আইন মন্ত্রণালয়ের ‘না’। এ অবস্থায় কি আমরা এতটুকু উদার হতে পারি না? এখানে ব্যাপারটা উদারতার নয়; মানবিকতার। এ ধরনের সমস্যা যে কোনো রাজনীতিবিদের হতে পারে। রাজনীতিবিদরা সঠিক-বেঠিক বিভিন্ন কারণেই জেলে যেতে পারেন; শাস্তিও পেতে পারেন। পরে দেখা যাবে, সেই শাস্তি যথাযথ ছিল না। এমতাবস্থায় তাঁরা চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাবেন? রাজনীতিবিদ বা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত যারা সিদ্ধান্ত নেন, তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় চিন্তা করতে হবে, তারা কী ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে, দুরভিসন্ধিমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এভাবে খালেদা জিয়ার কিছু হলে তার দায়দায়িত্ব কে নেবে? এটা এক ধরনের
চরম নিষ্ঠুরতা।
ড. মাহবুব উল্লাহ্: অর্থনীতিবিদ; প্রাক্তন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়