প্রথম আলোর যুগ্ম–সম্পাদক ও কবি
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া জেলে যান ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। এই মামলায় তার পাঁচ বছর কারাদণ্ড হয়। একই বছর ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় তাঁর সাত বছর জেল হয়। সেই হিসেবে খালেদা জিয়ার কারাবাসের মেয়াদ পাঁচ বছর হলো ৮ ফেব্রুয়ারি। একটি মামলায় উচ্চ আদালত তাঁর শান্তির মেয়াদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিএনপির দাবি, দুটো মামলাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। খালেদা জিয়া কোনো দুর্নীতি করেননি।
দুটো মামলায় হাইকোর্ট রায়ের পর লিভ টু আপিল দায়ের করলেও তিন বছর ধরে তা ঝুলে আছে। বিএনপি একটিরও নিষ্পত্তির জন্য চেষ্টা করছে না। তাদের ভয়, আপিল বিভাগে নাকচ হলে আইনি লড়াইয়ের শেষ সুযোগটিও থাকবে না। আওয়ামী লীগের অভিযোগ, বিএনপিই খালেদা জিয়ার মুক্তি চায় না বলে লিভ টু আপিলের নিষ্পত্তি করছে না।
এই প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা না করার বিতর্ক সামনে আসে। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিনি এখনো দলের চেয়ারপারসন এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়েছেন, তা-ও তাঁর সিদ্ধান্তে।
বিএনপি নেতারা প্রথমে আওয়াজ তুলেছিলেন, গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবেন। কিন্তু সেই কাজটি তাঁরা করতে পারেননি। এমনকি ২০১৮ সালের নির্বাচনে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষিতেও বিষয়টি সেভাবে তুলে ধরতে পারেননি। বিএনপি নেতারা তখন বলেছিলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
এরপর বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়েছে। যখন দেখা গেল, বিএনপির আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়া মুক্তি পাচ্ছেন না, তখন তাঁর পরিবার থেকে নির্বাহী আদেশে শাস্তি স্থগিত করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়। সরকার সেই আবেদন গ্রহণ করে এবং ছয় মাস পরপর তাঁর শাস্তি স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ নিয়ে পরিবারের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একাধিকবার দেখাও করেন।
প্রশ্ন উঠেছে, একজন শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারেন কি না। এর উদাহরণ বাংলাদেশেই আছে। জিয়াউর রহমানের আমলে জাসদের সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবের শাস্তিও নির্বাহী আদেশে স্থগিত করা হয়েছিল। তিনি শাস্তির স্থগিতাদেশ নিয়েই বিদেশে চিকিৎসার জন্য জার্মানি (তখন এটি পশ্চিম জার্মানি নামে অভিহিত ছিল) গিয়েছিলেন। দেশে ফিরে এসেও রাজনীতি করেছেন।
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে এ নিয়ে টেলিফোনে কথা হয় মঙ্গলবার। তাঁরাও বলছেন, বিএনপি যখন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, তখন খালেদা জিয়ার প্রশ্নটি সামনে আনার উদ্দেশ্য বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলা। এটা বিএনপির জন্য এক ধরনের টোপ। কেননা তাঁর প্রতি দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রচণ্ড আবেগ আছে।
খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে কী হবে? যে ধারায় খালেদা জিয়ার শাস্তি স্থগিত করা হয়েছে, সেই ধারা শর্তযুক্ত হতে পারে। আবার শর্তমুক্তও হতে পারে। আ স ম রবের ক্ষেত্রে শর্ত ছিল না। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে সরকার দুটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে, যথাক্রমে তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা করাবেন এবং বিদেশে যেতে পারবেন না। বিএনপির নেতারা তাঁর শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে সরকারের কাছে বারবার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন করলেও সরকার তা গ্রাহ্য করেনি। সরকার বলেছে, দেশে থেকেই তাঁকে চিকিৎসা করাতে হবে।
মাসখানেক আগে আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য যখন জাতীয় সংসদে বললেন, খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন না মর্মে মুচলেকা দিয়ে শাস্তি স্থগিত করিয়েছেন, তখন বিএনপির নেতারা জোরগলায় প্রতিবাদ জানালেন। আমরা ধরে নিয়েছিলাম সেই বিতর্ক সেখানেই শেষ হবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতো শেষ হয়েও হলো না শেষ।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আবার বিষয়টি সামনে এনেছেন। পাঠকের সুবিধার জন্য তাঁর পুরো বক্তব্যটি এখানে তুলে ধরছি।
১৯ ফেব্রুয়ারি, রোববার ঢাকায় নবনিযুক্ত সহকারী জজদের ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী ‘অসুস্থতার গ্রাউন্ডে দুটি শর্তে তাঁকে (খালেদা জিয়া) মুক্ত করা হয়েছে। তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না বা রাজনীতি করা থেকে বন্ধ থাকতে হবে, এ রকম শর্ত সেটার (খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে করা আবেদন) মধ্যে ছিল না।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আরও বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) একজন স্বাধীন মানুষ, তিনি কী করবেন, সেটা আমার বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু তাঁকে যখন (ফৌজদারি কার্যবিধি) ৪০১ ধারায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতায় মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। অসুস্থ বলে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সেখানে লিখে রাখিনি তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না। আইনি প্রক্রিয়ায় যদি কার্যক্রমের কথাই বলি, তিনি নির্বাচন করতে পারবেন কি না, তাহলে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে যেতে হবে। ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, যদি নৈতিক স্খলনের দায়ে কেউ দুই বছর বা তার বেশি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন, তাহলে তিনি সাজা ভোগের পর পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।’
তাহলে কি খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন? এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তির সময় যে চিঠি লেখা হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল, ওনার শারীরিক অবস্থা এমন, সুচিকিৎসা না হলে তাঁর জীবন বিপন্ন হবে। আপনারাই বিচার করেন, যিনি অসুস্থ, তিনি কি রাজনীতি করতে পারেন? যদি আপনাদের (সাংবাদিকদের) বিবেচনায় মনে হয় তিনি রাজনীতি করতে পারেন, তাহলে আপনাদের বিবেচনা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। তিনি অসুস্থ, তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না, এটাই মনে হচ্ছে বেস্ট জাজমেন্ট।’ (প্রথম আলো, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে এ নিয়ে টেলিফোনে কথা হয় মঙ্গলবার। তাঁরাও বলছেন, বিএনপি যখন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, তখন খালেদা জিয়ার প্রশ্নটি সামনে আনার উদ্দেশ্য বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলা। এটা বিএনপির জন্য এক ধরনের টোপ। কেননা তাঁর প্রতি দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রচণ্ড আবেগ আছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই বক্তব্যের মাধ্যমে সরকার রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে। সরকারি দলের নেতারা বলবেন, সরকার তো খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা দিচ্ছে না। দ্বিতীয়ত খালেদা জিয়ার আবেগ ব্যবহার করে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আনার চেষ্টাও করবে সরকার। তৃতীয়ত খালেদা জিয়া যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন, তখন সরকার দেখাতে চাইবে যে শর্তে সাজা স্থগিতের আবেদন করেছিলেন, সেই শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে। তিনি এখন আর অসুস্থ নন। ফলে তাঁর শাস্তি স্থগিত রাখারও যুক্তি নেই। আর যদি বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে ছাড় দেয় বা অনড় না থাকে, তখন শর্তের বিষয়টি শিথিলও করতে পারে।
বিএনপি যে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন, সেটি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফের মন্তব্যেও টের পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, আইনমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা হবে। আবার বিএনপির কোনো কোনো নেতা মনে করেন, নিজের মতো করে নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগ অনেক টোপ দেবে। এটাও একটা টোপ হতে পারে।
- সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি