দেশে গত জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে খাদ্যপণ্য আমদানি কমেছে ৬২ শতাংশ। কমেছে সরকারের খাদ্যমজুতও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ এবং সর্বশেষ গাজায় সংঘাতের কারণে খাদ্যপণ্যের বিশ্ববাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশের ডলার–সংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আমদানি কমে যাওয়ায় দেশে বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য গমের মোট চাহিদার ৮৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়। অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গমের আমদানি কমেছে ৫১ শতাংশ। এতে চাল, গম ও ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপণ্যের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। এতে নিম্ন আয়ের ৩৬ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়েছেন।
গত ২৭ ডিসেম্বর ডব্লিউএফপির ‘বাংলাদেশ বাজার পর্যবেক্ষণ-নভেম্বর-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। দেশের খাদ্য পরিস্থিতি, খাদ্যপণ্যের মূল্য এবং দরিদ্র মানুষের ওপরে তার প্রভাব নিয়ে জরিপ করে দুই বছর ধরে সংস্থাটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গমের আমদানি কমায় গরিব মানুষ চালের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এতে চালের ওপর চাপ বাড়ছে। তবে গত আমন ও বোরো মৌসুমে ধানের ভালো ফলন হয়েছে। এতে চাহিদা বাড়লেও জুলাই থেকে নভেম্বরের মধ্যে দেশের প্রধান খাদ্য চাল আমদানি করতে হয়নি। তুলনামূলক দামও খুব বাড়েনি। এতে নভেম্বরে সামগ্রিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নভেম্বরে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত সাত মাসের তুলনায় সবচেয়ে কম, ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আগের মাসের তুলনায় যা ১৪ শতাংশ কমেছে। খাদ্যের বাইরে অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমেছে ২ শতাংশ।
খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির জন্য বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক সংঘাতের প্রভাবকে দায়ী করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো চরম আবহাওয়ায় কৃষি উৎপাদন কমছে। ডলার–সংকট ও টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পরিস্থিতিকে কঠিন করে তুলেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত নভেম্বরে একজন মানুষের খাবার কিনতে ২ হাজার ৮৩৩ টাকা খরচ হয়েছে। যা গত বছর একই সময়ের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি। এতে খাবার কেনার খরচ জোগাতে বেশির ভাগ মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডলার ও জ্বালানিসংকটের কারণে পাঁচ মাসের মধ্যে দেশে ১২ কেজির একটি এলপিজি বোতলের দাম ১৮ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৩৮১ টাকা হয়েছে।
এ ব্যাপারে খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় গরিব মানুষের জন্য খাদ্য সরবরাহ বাড়িয়েছি। ভবিষ্যতে আরও বাড়ানো হবে। দেশে গরিব মানুষের খাদ্যের সংকট নেই।’
সংঘাতের প্রভাব ও সুশাসনের সমস্যা
প্রতিবেদনে বলা হয়, জ্বালানি তেলের সঙ্গে গমের মতো খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির যোগসূত্র রয়েছে। সর্বশেষ গাজা সংঘাতের পর জ্বালানি তেলের দাম আবার বেড়েছে। এর ওপর দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অর্থনীতিকে নাজুক করে তুলেছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে অস্থিতিশীলতা, দেশের ভঙ্গুর ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং দুর্বল মুদ্রানীতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। অভ্যন্তরীণ সুশাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা বাংলাদেশের সংকট থেকে উত্তরণে বড় বাধা।
চাল–আটার দামে আবার ঊর্ধ্বগতি
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চালের দাম গত অক্টোবরে কিছুটা কমলেও নভেম্বরে আবার বেড়ে যায়। ওই মাসে চালের দাম ৩ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছে। ওই মাসে প্রতি কেজি চালের দাম গড়ে ৪৬ টাকা ছিল, যা গত এক বছরের মধ্যে ৪ শতাংশ বেশি। বিভাগ ভেদে চালের দামে পার্থক্য দেখা গেছে। অন্যান্য বিভাগের তুলনায় বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রামে চালের দাম বেশি। জাতীয় গড় ধরে হিসাব করলে চালের দাম এখনো অনেক বেশি। বলা হচ্ছে, সার ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং চাল আমদানি না হওয়ায় চালের দাম বেড়েছে।
ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের পর গমের দাম এক লাফে দ্বিগুণ বেড়ে যায়। গত বছরের জানুয়ারি থেকে গমের দাম ধারাবাহিকভাবে কমছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমলেও গত নভেম্বরে দেশে গমের দাম আবার বাড়তে শুরু করে। নভেম্বরে আটার কেজি ছিল ৫৪ দশমিক ৩ টাকা, যা আগের মাসের তুলনায় ৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি।
সয়াবিন তেলের দাম গত জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত টানা কমেছে। তবে নভেম্বরে আবার ১ শতাংশ বেড়ে প্রতি লিটার ১৫৯ টাকা ৩ পয়সা হয়েছে। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ শতাংশ কম। পাম তেলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দাম কমলেও নভেম্বরে তা দেড় শতাংশ বেড়েছে। প্রতি লিটার হয়েছে ১২৯ টাকা।
তবে আমদানি মূল্য বেড়ে যাওয়ায় মসুর ডালের দাম ১ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি ১১২ টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ডালের দাম ১১ শতাংশ বেড়েছে। দেশে চাহিদার ৮০ শতাংশ মসুর ডাল আমদানি করতে হয়।
মজুত কমছে
প্রতিবেদনে সরকারের খাদ্যমজুত পরিস্থিতি তুলে ধরে হয়। বলা হয়, অক্টোবরে দেশের খাদ্য মজুত ছিল ১৪ লাখ টন। এর মধ্যে চাল ১২ লাখ টন ও গম দুই লাখ টন। অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে মজুত ১৫ শতাংশ কমেছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ শতাংশ কম। বৈশ্বিক সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের সরবরাহব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় আমদানি কমেছে। ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এক বছরে সামগ্রিকভাবে খাদ্য আমদানি ৬২ শতাংশ কমেছে।
সাবেক কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, খাদ্যপণ্য আমদানি কমার অর্থ এই নয়, দেশে খাদ্যনিরাপত্তার অবস্থা ভালো। কারণ, দেশের খাদ্য চাহিদার বড় অংশ আমদানি করতে হয়। আমদানি কমায় এবং নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরিব মানুষ আগের তুলনায় কম খাচ্ছেন। এটা দীর্ঘমেয়াদে পুষ্টিহীনতা তৈরি করবে। তাই প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানিকে সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
প্রথম আলো