খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির সবচেয়ে বড় প্রভাবক স্বাস্থ্য ব্যয়

হাসপাতালগুলো গত এক বছরে রোগ নির্ণয়ে করা বিভিন্ন পরীক্ষার ফি বাড়িয়েছে (সরকার নির্ধারিতগুলো ছাড়া) কমপক্ষে ১৫ শতাংশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ৪০ শতাংশও ছাড়িয়েছে। একই সময়ের মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ ফি ও ওষুধের ব্যয় বেড়েছে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতালে এ ব্যয় বেড়েছে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, এ মুহূর্তে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বড় প্রভাবক হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য ব্যয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত ডিসেম্বর শেষে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ। এ সময় খাদ্যবহির্ভূত খাতগুলোর মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে বেশি ছিল স্বাস্থ্যসেবায়। এর আগে অক্টোবরে জনসাধারণের স্বাস্থ্য ব্যয়ে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৩ শতাংশ। নভেম্বরে স্বাস্থ্য ব্যয়ের হার ছিল তুলনামূলক স্থিতিশীল। এ সময় খাতটিতে ব্যয় বেড়েছে দশমিক ৫ শতাংশ। আর ডিসেম্বরে স্বাস্থ্য ব্যয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

চিকিৎসকরাও বলছেন, রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা করা ও ওষুধের পেছনেই স্বাস্থ্যসেবা প্রত্যাশীদের ব্যয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে রাজধানীর বহুল পরিচিত একটি বেসরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত এক বছরে আমাদের হাসপাতালে রোগ নিরীক্ষায় ব্যয় বেড়েছে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো রোগীদের কাছ থেকে অত্যধিক মূল্য রাখছে। যে পরীক্ষায় ৩০০ টাকা ব্যয় হওয়ার কথা, সেখানে রোগীদের কাছ থেকে রাখা হচ্ছে ৮০০-৯০০ টাকা। আর বছর শেষে অনেক চিকিৎসকের কনসালটেশন ফি বাড়ানো হয়েছে। ডাক্তারভেদে ফি ১ হাজার থেকে বাড়িয়ে দেড় হাজার আবার দেড় হাজার থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৮০০ বা ২ হাজার টাকা করা হয়েছে। কারো কারো ক্ষেত্রে তা ৩-৪ হাজার টাকাও করা হয়েছে। আবার ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়িয়েছে কয়েক দফায়।’

মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘যাদের আয় নির্ধারিত ও সীমিত, তাদের জীবনযাপনকে অনেক কঠিন করে তুলছে মূল্যস্ফীতি। এ ধরনের মানুষ প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করে। স্বাস্থ্য তাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যখন স্বাস্থ্যসেবার খরচ বাড়ে, তখন তাদের অন্যান্য অনেক খরচ কমিয়ে দিতে হয়। যখন তাতেও হয় না, তখন তারা খাদ্য ব্যয়ও কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়। এতেও না হলে তারা ঋণ করে। স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ অতি প্রয়োজনীয়। এর কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যয় বহন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ অন্যান্য খরচ কমাচ্ছে। খাদ্যেও ব্যয় কমাতে হচ্ছে। ফলে অপুষ্টিতে পড়ছেন তারা। বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধ, শিশু ও গর্ভবতী নারীরা বেশি বিপাকে পড়ছেন। মানুষ রোগ ও শারীরিক জটিলতার একটি দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ছে। ঋণ নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিলে তা রাষ্ট্রের ক্ষতির কারণ হয়েও দাঁড়ায়।’

এ স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদের মতে, ‘‌মূল্যস্ফীতিতে স্বাস্থ্যের অবদান বা প্রভাব দিন দিন বাড়বে। এর সহজ সমাধান নেই। কিউরেটিভ কেয়ারের ৭০ শতাংশই বেসরকারি খাতে। অথচ বেসরকারি খাতের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ১৯৮২ সালের অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতালগুলো চলছে। নীতিমালার আধুনিকায়ন নেই। স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারের আগেও নিয়ন্ত্রণ ছিল না, এখনো নেই। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে ভালো করতে হলে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়কে শক্তিশালী করতে হবে। তাদের ক্ষমতায়ন করে জেলা ও উপজেলার বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার নিয়ন্ত্রণ জরুরি। একই সঙ্গে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি ও হয়রানিমুক্ত করতে হবে। তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যবীমা চালু করতে হবে।’

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্য বলছে, দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় কিউরেটিভ কেয়ার বা চিকিৎসায় প্রধান চালিকাশক্তি এখন বেসরকারি খাত। সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতের হিস্যা অন্তত ৬৫ শতাংশ। বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্রও বেশি।

সরকার রোগ নির্ণয়ে ১৩টি পরীক্ষা ও চার শ্রেণীর অক্সিজেন প্রবাহের মূল্য নির্ধারণ করে দেয় ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি হাসপাতালেই এগুলো ছাড়া অন্য সব ধরনের পরীক্ষার ব্যয় বেড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন পর্যায়ের ১০টি বেসরকারি হাসপাতালে তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এক বছরে প্যাথলজিক্যাল, বায়োকেমিক্যাল ও রেডিওলজির সব পরীক্ষার খরচ বাড়ানো হয়েছে ১২ থেকে ৩০ শতাংশ।

সরকার নির্ধারিতগুলোর বাইরে স্বাস্থ্যসেবায় সবকিছুর দাম বিভিন্ন মাত্রায় বেড়েছে বলে স্বীকার করলেন স্কয়ার হাসপাতালের চিফ অপারেটিং অফিসার মো. ইসাম ইবনে ইউসুফ সিদ্দিকী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সাধারণ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য বাড়েনি। কেননা সেগুলো সরকার কর্তৃক নির্ধারিত। তবে সেগুলোর মূল্য যখন নির্ধারণ করা হয় তখন ডলারের বিনিময় হার ছিল ৯০ টাকা। এখন অনেক বেশি। এগুলোর রি-এজেন্টে (পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যবহৃত রাসায়নিক ও উপকরণ) বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর। এগুলো সংগ্রহে ব্যয় বাড়লেও সরকার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ায় এখন ওইসব পরীক্ষার ফি বাড়ানোর সুযোগ নেই। বাকি পরীক্ষাগুলোর দাম কিছুটা বেড়েছে। এছাড়া চিকিৎসকের ফি, অস্ত্রোপচার খরচ, শয্যা ভাড়া কিছু বেড়েছে। আবার হাসপাতালে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ-গ্যাসের ব্যয় আগের চেয়ে বেড়েছে। এটিও স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়ার পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। ওষুধের দামও আগের মতো নেই। তবে সবকিছুর ব্যয় যে মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে, তা বলা ঠিক হবে না।’

রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়মিত স্নায়বিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন ষাটোর্ধ্ব রহিমা খাতুন (ছদ্মনাম)। তাকে নিয়মিতভাবেই কয়েকটি পরীক্ষা করাতে হয়। গত বছরের শুরুতে প্রতিবার চিকিৎসকের পরামর্শের জন্য তাকে ফি দিতে হয়েছিল ১ হাজার ৬০০ টাকা। বছরের শেষে এসে তা ২ হাজার ছাড়ায়। রোগের অবস্থা নির্ণয়ে প্রতি ছয় মাস বা এক বছরের ব্যবধানে তাকে বেশকিছু পরীক্ষা করাতে হয়। আগে এজন্য প্রতি দফায় ব্যয় হতো কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকা। তবে বছরের শেষে এসে সেই খরচ দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার টাকায়। একই সঙ্গে বেড়েছে তার ওষুধ কেনার খরচও।

২০২২ সালে ৫৩টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম বাড়িয়েছিল ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ওষুধগুলোর দাম বাড়ানো হয়েছিল ১৩ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত। এর বাইরে অন্যান্য ওষুধের দাম বিভিন্ন সময় বেড়েছে দফায় দফায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর কারণ সম্পর্কে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের লোকসানের কথা বলা হচ্ছে। একই সঙ্গে বলা হচ্ছে ডলার সংকট, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, এলসি জটিলতা, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কথাও। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির (বিএপিআই) নেতারা বলছেন, গত এক বছরে নানামুখী কারণে ওষুধের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা, চিকিৎসক ও রাজধানীর পাঁচটি ফার্মেসির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওষুধের দাম গত কয়েক বছরে বিভিন্ন হারে বেড়েছে। এ তালিকায় প্রায় সব ওষুধই রয়েছে। যেমন অ্যালার্জি, ঠাণ্ডার মন্টিলুকাস্ট জেনেরিকের ওষুধের দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশের মতো। গ্যাসের ওষুধ ওমিপ্রাজল জেনেরিকের ওষুধের দামও বেড়েছে ১০০ শতাংশের বেশি। বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের দাম ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের মতো বেড়েছে দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে। বহুল ব্যবহৃত হৃদরোগের ওষুধের দাম দ্বিগুণ হয়েছে।

স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য জটিলতা সৃষ্টিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট) অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এমনও দেখা যায় চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে কয়েকটি রোগের পরীক্ষা লিখেছেন ও ওষুধ দিয়েছেন। বেশি ব্যয়ে সামর্থ্য না থাকায় ব্যবস্থাপত্রের সব ওষুধ কিনে সেবন করছেন না রোগীরা। স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের কোনো লাগাম নেই। মূল্যস্ফীতির অনেক কারণ রয়েছে। তবে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ব্যয় বৃদ্ধি ঠেকাতে সরকারের কাজ করা উচিত। যে ফি ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা হয়েছে তা সর্বোচ্চ ১ হাজার ১০০ হলে মানা যায়। এসব বিষয় নিয়ে বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারের বসা উচিত। তাদের কাছ থেকে সেবা নেয়ার ফি নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা জবাবদিহিতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। রোগ নির্ণয়ের ব্যয় বেড়েছে। ওষুধের খরচ বেড়েছে। এমনকি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ক্ষেত্রেও ব্যয় বেড়েছে, যার কোনো কারণ নেই। এতে দেখা যাচ্ছে মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করছে না। শিশুমৃত্যু বাড়ছে। এসবের পেছনের অনেক কারণের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধিকে বড় একটি কারণ হিসেবে দেখা যায়।’

স্বাস্থ্য খাতের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের ব্যয় সরকারি খাতে বাড়েনি। সরকারি হাসপাতালে সেবার মূল্য সরকার বাড়ায়নি। যে মূল্য নেয়া হচ্ছে তা সহনীয়। স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ এবং ওষুধের যেটুকু ব্যয় বেড়েছে তার পুরোটাই বেসরকারি খাতের।

মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি সব ক্ষেত্রে সমান নয় বলে মনে করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সরকারি ব্যবস্থাপনায় হাসপাতালের সব সেবার মূল্য আগের মতোই আছে। সরকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে কাজ করছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) ওষুধের দামও আগের মতো রয়েছে। তবে বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সেবার মূল্য এবং ওষুধের দাম যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকে, তা আমরা তদারক করছি। আমরা ঈদের পরই তাদের সঙ্গে আলোচনা করব।’

bonikbarta