খরচ সামলাতে নিত্যপণ্য কেনায় কাটছাঁট, কমেছে আমদানি

দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমার কোনো সুখবর নেই। যদিও বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমেছে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ডলারের বাড়তি দামসহ নানা কারণে সেই সুফল পাচ্ছেন না দেশের মানুষ। নিত্যব্যবহার্য পণ্য থেকে নিত্যপণ্য—সবকিছু কিনতে হচ্ছে এখন বাড়তি দামে। আয়-ব্যয়ের সঙ্গে কুলাতে না পেরে অনেকে নিত্যপণ্য কেনাকাটায় কাটছাঁট করছেন। এতে নিত্যপণ্য বিক্রি ও আমদানি কমে গেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) নিত্যপণ্যের মধ্যে ডাল, চিনি, সয়াবিন ও পাম তেলের আমদানি আগের বছরের চেয়ে গড়ে ৩০ শতাংশ কমেছে। ব্যবসায়ীরাও বলছেন, ঋণপত্র–সংকটে পণ্যের আমদানি এখন কম। আবার আমদানি কমার পরও বাজারে সরবরাহ–সংকট তীব্র হয়নি। এর মানে হলো, পণ্য বিক্রি হচ্ছেও কম।

চট্টগ্রামের বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পণ্যের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবে চাহিদাও কমে যায়। এখন যেহেতু জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে, তাই মানুষ খরচ সামলাতে নিত্যপণ্য কেনায় কাটছাঁট করছেন।

বাজারে বেচাকেনা পর্যবেক্ষণ করে এই ব্যবসায়ীর মত, ঋণপত্র–সমস্যায় আমদানি যে হারে কমেছে, চাহিদা সেই অনুযায়ী কমেনি। সব মিলিয়ে চাহিদা গড়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমে গেছে।

দেশে চাহিদানুযায়ী উৎপাদন না হওয়ায় মসুর ডাল, মটর ডাল, ছোলা, সয়াবিন তেল, পাম তেল ও চিনি আমদানি করতে হয়। তাই আমদানির চিত্র থেকে চাহিদা বৃদ্ধি ও কমার একটা ধারণা পাওয়া যায়।

এনবিআরের তথ্যে দেখা যায়, মসুর ডালের আমদানি এক বছরে সবচেয়ে বেশি কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে মসুর ডাল আমদানি হয়েছে ৯২ হাজার টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি ছিল ১ লাখ ৬৪ হাজার টন। এই মসুর ডাল আমদানি কমেছে প্রায় ৪৪ শতাংশ।

মটর ডাল ও ছোলার সরবরাহ কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে মটর ডাল আমদানি হয়েছে ৫০ হাজার টন, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ লাখ ৮৯ হাজার টন। একই অবস্থা ছোলার ক্ষেত্রেও।

ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন তেল শতভাগ আমদানিনির্ভর। সয়াবিন বীজ মাড়াই করে সয়াবিন উৎপাদন যেমন হয়, তেমনি অপরিশোধিত সয়াবিন এনে পরিশোধন করেও বাজারজাত করেন উদ্যোক্তারা। চলতি অর্থবছরে সয়াবিন বীজ ও অপরিশোধিত সয়াবিন—দুটোরই আমদানি কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সয়াবিন বীজ আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৯৭ হাজার টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৮১ হাজার টন। সেই হিসাবে সয়াবিন তেলের কাঁচামালের আমদানি কমেছে ৪৯ শতাংশ। অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি কমেছে ১৬ শতাংশ। ভোজ্যতেলের আরেকটি পাম তেল আমদানি কমেছে ২ শতাংশ।

একই অবস্থা চিনির ক্ষেত্রেও। দাম বাড়ার পর চিনি আমদানি কমতে শুরু করে। চলতি অর্থবছরে প্রথম চার মাসে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৩৮ হাজার টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৭১ হাজার টন। অর্থাৎ আমদানি কমেছে ২০ শতাংশ।

নিত্যপণ্যের মধ্যে আমদানি বেড়েছে শুধু গমের। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে গম আমদানি হয়েছে ১৭ লাখ টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি ছিল ১০ লাখ ৬৬ হাজার টন। তাতে এক বছরের ব্যবধানে আমদানি বেড়েছে ৬০ শতাংশ।

নিত্যপণ্যেও কাটছাঁট

বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। তাতে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মানে হলো, গত বছর অক্টোবরের চেয়ে খাবারের পেছনে ১০০ টাকায় ১২ টাকা ৫৬ পয়সা বেশি খরচ হচ্ছে। তাই নিত্যপণ্য কেনায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকার বেসরকারি চাকরিজীবী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘দাম বাড়ায় নিত্যব্যবহার্য অনেক পণ্য আগেই কেনা কমিয়েছি। কয়েক মাস ধরে নিত্যপণ্য কেনাও কমাতে বাধ্য হয়েছি। চাল ও আটা ছাড়া বাকি সবকিছুই কাটছাঁট করে সংসার খরচ সামাল দিতে হচ্ছে।’

বাড়াতে হবে নজরদারি

বেসরকারি গবেষণা সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্য কেনা কমিয়ে দিতে পারে মানুষ। ডলারের বিনিময় মূল্যে এখনো অস্থিরতা রয়ে গেছে। ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়লে আমদানিনির্ভর পণ্যের দামেও তার প্রভাব পড়ে। আবার বাজার ব্যবস্থাপনাও ঠিকমতো হচ্ছে না। এ পরিস্থিতি উত্তরণে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়াতে হবে। বাজারে নজরদারিও করতে হবে। কারণ, পণ্যের দাম স্থিতিশীল না হলে মানুষের কষ্টও কমানো যাবে না।’

প্রথম আলো